সাহাদাত হোসেন পরশ : কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার হামলার ঘটনায় হাতেনাতে গ্রেফতার জঙ্গি শরিফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম সোহান ওরফে ডন ওরফে আবু মোকাদ্দেল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, 'বড় ভাই' ও 'ওস্তাদের' নির্দেশে তারা সেখানে হামলা চালায়।
হামলার উদ্দেশ্যে চারজন শোলাকিয়ায় গেলেও ঈদের দিন দু'জন ওই এলাকা ত্যাগ করে। হামলার চূড়ান্ত ছক সম্পর্কে আগেই তাদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়। এক 'বড় ভাই' তাদের খাওয়া-দাওয়া, বাসা ভাড়াসহ সব খরচ বহন করতেন। হামলার আগে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে একটি টিনশেডের পুরনো বাড়িতে দেওয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ।
শরিফুলের কাছ থেকে উগ্রপন্থিদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে এরই মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। শুধু শোলাকিয়ায় নয়, এর আগে কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, গাইবান্ধায় আরও চারজনকে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত শরিফুল।
বর্তমানে কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একই জায়গা থেকে গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলার মূল পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
শিগগিরই গুলশান ও শোলাকিয়ায় জড়িত অন্য জঙ্গিদের গ্রেফতার করা যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জেএমবিসহ কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজন সদস্য গোয়েন্দা জালে রয়েছে।
এদিকে গুলশানের ঘটনায় জব্দ কিছু আলামত পরীক্ষার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত ডিসি সাইফুল ইসলাম এ ব্যাপারে সমকালকে বলেন, সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মামলার তদন্ত চলছে।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, মঠের পুরোহিত হত্যা মামলায় শফিউলসহ কয়েকজনের নামে এরই মধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে।
একাধিক সূত্র বলছে, উগ্রপন্থিরা কয়েকটি ধাপে কাজ করে থাকে। প্রথমে টার্গেট করা তরুণদের দলে ভিড়িয়ে করা হয় মগজ ধোলাই। সেখানে যাদের 'প্রতিশ্রুতিশীল' ও 'অনুগত' বলে মনে হয়, তাদের নেওয়া হয় পরবর্তী ধাপে।
ওই ধাপে চলে অস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ। শোলাকিয়ার হামলায় জড়িতদের গোবিন্দগঞ্জে কয়েক মাস ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। নাশকতা চালানোর ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত গোপন আস্তানায় দেওয়া হয় বয়ান। বয়ানে একেক সময় একেকজন 'বড় ভাই' অংশ নেয়।
তরুণদের কাছে দেয়া হয় কোরআন ও হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা। উদ্বুদ্ধকরণ শেষে জঙ্গিদের পাঠানো হয় ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকায়। সেখানে তারা পরিচয় গোপন করে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।
শোলাকিয়ার ঘটনায় জড়িতরাও ছদ্মবেশে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। ২৭ রমজান গাইবান্ধা থেকে সরাসরি তাদের শোলাকিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। হামলা চালাতে পরবর্তী দু'দিন তারা ঘটনাস্থল রেকি করে। গাইবান্ধায় যাদের সঙ্গে শরিফুলের যোগাযোগ ছিল, তাদের অনেককে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, শরিফুল ইসলাম গত এক বছরে আরও চারজনকে হত্যা করেছে। এই তরুণের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। সে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ছাত্র। তার বাবার নাম হাই প্রধান।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০ বছরের এই তরুণ একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি। তাকে হাতেনাতে আটক করা সম্ভব হওয়ায় উগ্রপন্থিদের ব্যাপারে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া গেছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, হামলা, পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের যেসব ঘটনা বিএনপি-জামায়াত করেছে, তাতে সক্রিয় ছিল তার বাবা হাই প্রধান। সে এ-সংক্রান্ত একাধিক মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে জঙ্গি দলে শরিফুল ভিড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আড়াই বছর ধরে সে নিখোঁজ ছিল।
শরিফুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে, পঞ্চগড়ে শ্রীশ্রী গৌড়ীয় মঠের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর হত্যার ঘটনায় সে সরাসরি অংশ নেয়। চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
২২ মার্চ কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আলী হোসেন হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিল সে। এ ছাড়া গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে তরুণ দত্ত হত্যা ও মহিমাগঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র হত্যাকাণ্ডে শরিফুল ও তার সহযোগীরা অংশ নিয়েছিল। পঞ্চগড়ে পুরোহিতকে হত্যার সময় মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দুই ভক্ত গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তা
দের ওপরও গুলি চালায় শরিফুল। ওই হামলায় তার সঙ্গে ছিল দুই জঙ্গি রাজিবুল মোল্লা ও নজরুল। পুরোহিত হত্যা মামলা ছাড়াও পৃথক বিস্ফোরক ও অস্ত্র মামলার আসামি সে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গাইবান্ধায় দুটি হত্যাকাণ্ডে প্রথমে শরিফুলের নাম না এলেও পরে তদন্তে তার জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে।
গোয়েন্দারা জানান, এত অল্প বয়সে শরিফুলের ভয়ঙ্কর জঙ্গি হয়ে ওঠার বিষয়টি বিস্ময়কর। এ ছাড়া শোলাকিয়া হামলায় জঙ্গি সন্দেহে জাহিদুল হক তানিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশ বলছে, তার কাছ থেকেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সমন্বয় করে 'বিশেষ দল' তৈরি করছে কয়েকটি চক্র।
গুলশান ও শোলাকিয়ার হামলায় এ ধরনের পৃথক দুটি দল অংশ নেয়। তবে হামলার ধরন ও অস্ত্র ব্যবহারে উভয় অভিযানের মধ্যে অনেক সমন্বয় থাকলেও কিছু পার্থক্য রয়েছে।
গুলশানে বিদেশিদের টার্গেট করে হত্যা করা হয়েছে। আর শোলাকিয়ায় ঈদের দিনেই হামলা করা হয়। শরিফুলের দাবি, শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের আশপাশে পুলিশের ওপর হামলা করে তারা কঠিন বার্তা দিতে চেয়েছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, জঙ্গিদের টার্গেট ছিল ঈদ জামাত ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
এদিকে গুলশানের ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসানাত করিম ও তাহমিদের ব্যাপারে নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান চলছে। আদালতের অনুমতি পাওয়ার পর নিহত পাঁচ জঙ্গির ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে। তবে পরিবার তাদের লাশ না নিলে যেকোনো সময় তা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে। -সমকাল
১৩ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম