শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬, ১২:১৮:৪৫

জঙ্গি তত্পরতায় ভার্সিটির এক ডজন শিক্ষক

জঙ্গি তত্পরতায় ভার্সিটির এক ডজন শিক্ষক

আবুল খায়ের: রাজধানীর ৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল এবং একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ডজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।  নানা কৌশলে এসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে উত্সাহ দিয়েছেন। এছাড়া আরো ২টি সরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েক জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে গুলশান হামলায় জড়িত ও সেনা অভিযানে নিহত জঙ্গি নিব্রাস ইসলামের সাত সহযোগী আদালত থেকে জামিন নিয়ে নিখোঁজ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, এই সাতজনই রাজধানীর বিভিন্ন প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। জানা গেছে, ধানমন্ডির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জঙ্গি কার্যক্রমে অংশ নিতে ছাত্রছাত্রীদের নানাভাবে প্রভাবিত করা হয়। একজন অভিভাবক জানিয়েছেন, ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই তাকে জঙ্গিবাদে উত্সাহ দিয়েছেন। তাকে ওই প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘সারাবিশ্বে মুসলমানদের উপর হামলা হচ্ছে। চলেন আমরাও বিধর্মীদের উপর হামলার প্রস্তুতি নেই।’

অপর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক একটি জঙ্গি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তাকে একবার গ্রেফতারও করা হয়। পরে তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জঙ্গিবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রে তিনি এখনও তত্পরতা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন।

গুলশান এলাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাত্রদেরকে জঙ্গিবাদে সরাসরি উত্সাহ দিতেন। আত্মঘাতী হামলার প্রশিক্ষণও দিতেন তিনি। অপর একটি নামিদামি ইংলিশ স্কুলের শিক্ষকের পুত্র জেএমবির সদস্য। গুলশান হামলার সঙ্গে সে জড়িত ছিল। এই জঙ্গির মাও জঙ্গি তত্পরতায় জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। 

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, নর্থ-সাউথে খুব সহজেই হিযবুত তাহরীরের মতো জঙ্গি সংগঠন বেড়ে উঠতে পারার অন্যতম কারণ তাদের প্রশাসনের সহযোগিতা। প্রশাসন থেকে কখনো কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি তাদের গ্রন্থাগারে জঙ্গিবাদি বই পাওয়া গেলেও সে বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একটি তদন্ত দল গত বছর অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন দেয় যেখানে উল্লেখ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির গ্রন্থাগার পরিদর্শন করতে গেলে তারা সেখানে নিষিদ্ধ জঙ্গি তত্পরতামূলক হিযবুত তাহরীরের বই পান। তবে এসব বই পাওয়া গেলেও কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পর জানা গেল, হামলাকারীরা রাজধানীর নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। এরা সবাই বিত্তবান পরিবারের সন্তান। এছাড়া প্রত্যেকেই ঘটনার আগে নিখোঁজ ছিলেন। পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিলো না। এই ঘটনার পর অভিভাবকদের টনক নড়ে। অনেকে তাদের নিঁখোজ সন্তানদের বিষয়ে মুখ খুলেছেন। অনেকে আবার জেনেও পুলিশকে সহায়তা করছে না। উল্টো বিপথে যাওয়া সন্তানদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসব পরিবারের সন্তানদের অর্থের দাপটের পাশাপাশি রয়েছে ক্ষমতার দাপট। বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়াতে পারে- এটা ছিল গোয়েন্দাদের ধারণার বাইরে। প্রশাসনের উচ্চ পদে কর্মরত অনেকের সন্তানও জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। সন্তানদের এই পথ থেকে ফেরাতে কোন ভূমিকা রাখতে পারছেন না তারা। এসব বিষয়ও গোয়েন্দাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। 

গুলশানের হামলায় জড়িত নিব্রাসের সাত সহযোগীকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গত ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন ধাপে গ্রেফতার করেছিল। সেই সময় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। এই সাতজন পরে জামিনে বের হয়ে যান। এদেরকে পুলিশ খুঁজছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন নাশকতার সঙ্গে এরা জড়িত বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।

কোন কোন অভিভাবক সন্তানদের জঙ্গি কার্যক্রমে উত্সাহ দিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে জঙ্গিবাদে মদদদাতা এবং অর্থ সহায়তাকারী দুজনের নাম সন্দেহভাজন হিসেবে সামনে এসেছে। এরা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন।

এদিকে নিখোঁজ ১০ জঙ্গির বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। এদের একজন হচ্ছেন নজিবুল্লাহ আনসারী। তার বাবা রফিকুল আনসারী নৌবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত নাবিক। নজিবুল্লাহ ২০০৮ সালে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। পরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিন বছরের জন্য মালয়েশিয়া যান।

সেখান থেকে ইন্টার্নশিপ করতে এক বছরের জন্য আমেরিকা যান। সেখান থেকে ফিরে দেড় বছরের মতো নিখোঁজ রয়েছে ছেলেটি। গুলশানের ঘটনার পর তার বাবা চট্টগ্রামের ইপিজেড থানায় একটি জিডি করেছেন। নজিবুল্লাহ’র গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায়। তার পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। জঙ্গি সম্পৃক্ততায় নর্থ সাউথের পরেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 এছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত দেশের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ শিক্ষার্থীকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে নর্থ সাউথের ১১ জন, বুয়েটের ৬ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগের ২ জন। এছাড়া বাংলাদেশে জিহাদি গ্রুপ তৈরির চেষ্টায় ২০১৫ সালে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা একজনকে আটক করা হয়।

জঙ্গি ইস্যুতে ২০১০ সাল থেকে নর্থ সাউথের পাশাপাশি যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম বারবার সামনে এসেছে সেগুলো হলো- দারুল ইহসান, ব্র্যাক, বুয়েট এবং ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। তবে নর্থ সাউথের পর সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের নাম।

 কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, যেসব জঙ্গি জামিন পেয়ে নিখোঁজ রয়েছেন আমরা তাদের খুঁজছি। জঙ্গিদের মদদদাতা এবং সহায়তাকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।-ইত্তেফাক

১৫ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে