নিউজ ডেস্ক: ঢাকার বাইরে দেশের ১২ জেলায় ২৮ জনের নিখোঁজ থাকার খবর মিলেছে। স্থানীয় পুলিশের ধারণা, তাঁরা জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, যদিও পরিবারগুলো থানায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিষয়ে জিডি করেছে। তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। বয়স ১৪ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে মাদ্রাসার ছাত্র যেমন আছেন, আবার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রও আছেন। একজন আছেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। পরিবার বলছে, তিনি আইএসে যোগ দিতে ইরাকে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর ইরাক ইলাইহি চৌধুরী বলেন, মাদ্রাসার সুবিধাবঞ্চিত যুবকেরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, এমন একটা ধারণা আগে থেকে ছিল। কিন্তু এখন উচ্চবিত্তের সন্তানেরাও এর সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। এর কারণ হলো, সব পাওয়ার মধ্যেও মৌলিক অনেক কিছু না পাওয়া। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের সময় দেন না। তাঁদের অবৈধ আয় একটা পর্যায়ে সন্তানদের নাড়া দিচ্ছে। শিক্ষার প্রতিযোগিতায় খারাপ করলে সে পরিবারের তোপের মুখে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। এসব বিষয় তাদের ওপর প্রভাব ফেলছে।
চট্টগ্রাম: গত বছরের শুরুতে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন চট্টগ্রামের মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. নজিবুল্লাহ আনসারী (২৮)। তাঁর বাবা এলপিআরে থাকা নৌবাহিনীর অনারারি লেফটেন্যান্ট মো. রফি
কুল্লাহ আনসারী ১০ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানায় এ বিষয়ে জিডি করেছেন।
ইপিজেড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জিডিতে রফিকুল্লাহ বলেছেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাঁর আরেক ছেলের কাছে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে নজিবুল্লাহ বলেছিলেন, ‘আমি আইএসে যোগদানের জন্য ইরাকে চলে এসেছি। আমি আপনাদের সঙ্গে কোনো দিন যোগাযোগ করব না।’ নজিবুল্লাহ রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি এবং মালয়েশিয়া মেরিন একাডেমি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।
এরপর ২০১২ সালে বিদেশি জাহাজে চাকরি নেন। তিনি মালয়েশিয়া থেকে ইরাকে চলে যান বলে পরিবার জানতে পেরেছে। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের চকপাড়ায়। এ ছাড়া দুজন মাদ্রাসাছাত্র নিখোঁজ রয়েছেন। এর মধ্যে রাউজানের গহিরা এফ কে জামেউল উলুম বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার ছাত্র মোহাম্মদ এমরান হোসেন (১৪) গত বছরের ১৩ অক্টোবর মাদ্রাসার ছাত্রাবাস থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি।
দুদিন পর ১৫ অক্টোবর তার বাবা মোহাম্মদ ইউনুস থানায় জিডি করেন। আর পটিয়ার শাহ মীরপুর তসবিতুল কোরআন মাদ্রাসার ছাত্র কাইয়ুম উদ্দিন (১৮) মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হন গত বছরের ৯ আগস্ট। তাঁর বাবা নাম আবদুল হক চলতি বছরের ১১ জুলাই পটিয়া থানায় এ বিষয়ে জিডি করেন।
যশোর: যশোরে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ হয়েছেন, এমন সাত তরুণের একটি তালিকা র্যাব-৬-এর যশোর কার্যালয় থেকে সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ওই সাতজনের নাম র্যাব প্রকাশ করেনি। তবে তাঁদের মধ্যে দুজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন যশোর সদর উপজেলার কিসমত নওয়াপাড়া এলাকার কাজী ফজলে রাব্বি (২১) ও শার্শা উপজেলার শ্যামলাগাছি গ্রামের মেহেদি হাসান ওরফে হুসাইন জীম (১৫)।
ফজলে রাব্বির স্বজনেরা জানান, ফজলে রাব্বি যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএমসি) পদার্থ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গত ৫ এপ্রিল সকালে কলেজে যাওয়ার কথা বলে ফজলে রাব্বি বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। বাড়ি ছাড়ার আগে তিনি কলেজ থেকে ভর্তি বাতিল করে সব কাগজপত্র তুলে নিয়েছেন। তাঁর বাবা কাজী হাবিবুল্লাহ ৭ এপ্রিল যশোর কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন।
শার্শার মেহেদি হাসান বাড়ি ছাড়ে ৭ এপ্রিল। এরপর সে বাড়ির কারও সঙ্গে আর যোগাযোগও করেনি। সে ঝিকরগাছা উপজেলার গাজীরদরগা ফয়জাবাদ ফাজিল মাদ্রাসায় আবাসিক থেকে লেখাপড়া করত। তার বাবা মো. আওরঙ্গজেব ওই বছরের ১২ এপ্রিল শার্শা থানায় নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়ে জিডি করেন। আওরঙ্গজেব বলেন, তিন মাস আগে মেহেদি বাড়িতে ফিরলে তার আচরণ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। সে কারও সঙ্গে তেমন কথা বলেনি। সন্দেহ হলে চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করেও তাকে ঘর থেকে বের করা যায়নি।
পরদিন সকালে চুল কাটাতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘গাজীরদরগা মাদ্রাসা থেকেই আমার ছেলের মাথা বিগড়ে গেছে। ওই মাদ্রাসা থেকে আরও কয়েকজন ছাত্র নিখোঁজ হয়েছে বলে আমরা শুনেছি।’ জানতে চাইলে ঝিকরগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা খবির আহমেদ বলেন, ‘মাদ্রাসা থেকে নিখোঁজ হওয়ার কথা আমরাও শুনেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ ঝিনাইদহ থেকে নিখোঁজ সাত তরুণের বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাব-৬-এর অধিনায়ক খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে তাঁদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা চলছে।
সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জ পুলিশ জানায়, এ জেলা থেকে ছয়জন নিখোঁজ রয়েছেন, যাঁদের সন্দেহভাজন জঙ্গি বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে উল্লাপাড়া উপজেলার শেখপাড়া গ্রামের রাকিবুল ইসলাম (২৩) দেড় বছর আগে নিরুদ্দেশ হন। তিনি ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ার ছাত্র ছিলেন। একই উপজেলার দাদপুর গ্রামের হাফেজ আবদুল মোমিন (২৭) আট মাস আগে এবং রাউতান গ্রামের জাভেদ সিদ্দিক (২৫) গত ৯ জুন বাড়ি ছাড়েন।
সাত মাস ধরে নিখোঁজ আছেন শাহজাদপুর উপজেলার উল্টাডাব গ্রামের হাবিবুর রহমান (২৭)। চৌহালী উপজেলার চেংটার চর গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র জাকির হোসেন ২ জুলাই থেকে ও কাজীপুর উপজেলার বেরী পোটল গ্রামের আরমান রেজা (১৫) নিখোঁজ আছে ১০ জুলাই থেকে। সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এসবি) আবু ইউসুফ বলেন, এই ছয়জন ছাড়া আরও পাঁচজনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।
রাজশাহী: রাজশাহীর তিনটি উপজেলার চারজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়েছে। এসব ব্যক্তি হলেন তানোরের লালপুর গ্রামের মোহাম্মদ বাশারুজ্জামান ওরফে আবুল বাশার (৩০), বাগমারার শ্রীপুর গ্রামের শরীফুল ইসলাম (২৩), গোদাগাড়ীর হরিশংকরপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম (১৫) ও তার চাচাতো ভাই আমিনুল ইসলাম (১৪)।
আবুল বাশারের মা বানিসা বেগম বলেন, তাঁর ছেলে ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে লেখাপড়া শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিলেন। সাত মাস আগে ঢাকার তেজগাঁওয়ের শ্বশুরবাড়ী থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। বাশারের শ্বশুর তেজগাঁও থানায় জিডি করেন। বাগমারার শরীফুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী।
তিনি বছর খানেক ধরে নিখোঁজ। তাঁর বাবা আবদুল হাকিম ৪ জুলাই ছেলে নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করেন।গোদাগাড়ী থানার ওসি এস এম আবু ফরহাদ বলেন, সাইফুল ও আমিনুল গত ২৩ জুন থেকে নিখোঁজ বলে জানিয়ে ২৬ জুন থানায় জিডি করেছে পরিবার।
গাইবান্ধা: গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার মধ্য ভাঙ্গামোড় গ্রামের ইদু মিয়া (২৮) গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর ও পালানপাড়া গ্রামের লিখন মিয়া (২০) গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে নিখোঁজ। উভয় ঘটনায় থানায় জিডি হয়েছে বলে জানান সাদুল্যাপুর থানার ওসি ফরহাদ ইমরুল কায়েস। নাটোর: নাটোরের লালপুর উপজেলার নুরুল্লাপুর গ্রামের আশিকুর রহমান ওরফে অপু (১৭) গত ১ জুন বাড়ি ছাড়ে।
এরপর আর কোনো খোঁজ নেই বলে জানান তার বাবা রবিউল ইসলাম। অপু লালপুরে মহরকয়া ভোকেশনাল স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র। অপুর মা আজিজা সুলতানা বলেন, বাড়ি ছাড়ার দুদিন আগে অপু তার মুঠোফোনটি ভেঙে ফেলে।
কুমিল্লা: কুমিল্লার হোমনা উপজেলার শ্যামপুর গ্রামের মেহেদী হাছান (১৭) নামের এক ছাত্র ঢাকা থেকে ২৫ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে। তার বাবা মহসীন মিয়া বলেন, মেহেদী কুমিল্লা মডেল স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে।
গত ১৯ জুন ঢাকার উত্তরা রাজউক কলেজে ভর্তি হতে যায়। সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। মহসীন মিয়া বলেন, ‘কলেজের সিসিটিভি থেকে দেখতে পাই, মেহেদী দুজন অপরিচিত লোকের সঙ্গে কলেজ থেকে বের হয়ে যায়। পরদিন ২০ জুন আমি উত্তরা পূর্ব থানায় জিডি করি।’
জয়পুরহাট: কালাই উপজেলার বেগুন গ্রামের আবদুল গাফফারের ছেলে আমিনুল এহসান (২০) নিখোঁজ প্রায় ১০ মাস ধরে। কালাই থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমিনুল বগুড়ার একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়তেন। তিনি ২০১৫ সালের ৪ অক্টোবর বগুড়া যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ। ৬ অক্টোবর তাঁর বাবা জিডি করেছেন।
বরগুনা: বরগুনা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মিরাজুল ইসলাম এক মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ। তার বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া গ্রামে। মিরাজুলের বাবা পনু মৃধা বলেন, তাঁর একমাত্র ছেলে মিরাজুল গত ১৫ জুন বই কেনার কথা বলে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর আর বাড়ি ফেরেনি। তার মুঠোফোনও বন্ধ। তিনি ১৭ জুন থানায় জিডি করেছেন।
খুলনা: দীঘলিয়া উপজেলার উত্তর চন্দনীমহল মুসলিমপাড়ার আকাশ শিকদার (১৬) নিখোঁজ গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে। এ বিষয়ে থানায় জিডি হয়েছে ১৪ জুলাই। আকাশের বাবা কাদের শিকদার বলেন, তাঁর ছেলে বাতিভিটা কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। সে এর আগেও মাঝে মাঝে সে হারিয়ে যেত।
নোয়াখালী: নোয়াখালীর চাটখিল পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাবিবুর রহমান ওরফে ইয়াছিন (১৬) চার মাসের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ আছে। তার বাবা পৌর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মাকছুদের রহমান এ ঘটনায় ৬ জুলাই চাটখিল থানায় জিডি করেন।
হাবিবুর চৌমুহনী দারুল কোরআন একাডেমি থেকে হেফজ পাস করে। মাকছুদের রহমান বলেন, তাঁর ছেলে গত ৬ মার্চ মাদ্রাসায় যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু সে মাদ্রাসায় যায়নি। এরপর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার সন্ধান মেলেনি।-প্রথম আলো
১৯ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ