মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬, ০৫:০২:০৫

ঢাকা থেকে নিখোঁজ তরুণেরা কোথায়?

ঢাকা থেকে নিখোঁজ তরুণেরা কোথায়?

শেখ সাবিহা আলম ও আহমেদ জায়িফ: ‘আমি নিবরাসের সঙ্গে যাচ্ছি’ চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এই ছিল তাওসিফ হোসেনের শেষ কথা। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে নিহত হন নিবরাস ইসলাম। কিন্তু তাওসিফ এখনো নিখোঁজ। একই দিনে ঘরছাড়া শেহজাদ ওরফে অর্কেরও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

এ রকম নিখোঁজ তরুণের সংখ্যা আসলে কত? গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পর এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পুলিশের হিসাব ও অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত ২৭ জনের নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বলছে, তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে, এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

পুলিশ ও র‍্যাব সাম্প্রতিক সময়ে নিখোঁজ ১৫-৩০ বছর বয়সী কিশোর-তরুণ ও যুবকদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ তথ্য কোনো বাহিনীর কাছে নেই। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আটটি বিভাগ থেকে গতকাল পর্যন্ত সন্দেহভাজন ২৪ তরুণের নিখোঁজ বা নিরুদ্দেশের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে রমনা বিভাগে ১৪ জন, গুলশান বিভাগে ৫ জন, মিরপুর বিভাগে ২ জন ও উত্তরা বিভাগে ৩ জন রয়েছেন

এই তালিকার অন্তত তিনজন ইতিমধ্যে নিহত হয়েছেন। এঁদের একজন বিডিআর বিদ্রোহে নিহত এক সেনা কর্মকর্তার ছেলে মো. আশিকুর রহমান (২১) নিহত হয়েছেন সিরিয়ায়। বাকি দুজন হলেন গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী ও নিহত মীর সামেহ মোবাশ্বের এবং মাদারীপুরে কলেজশিক্ষককে হত্যাচেষ্টায় আটক ও পরে ক্রসফায়ারে নিহত গোলাম ফয়জুল্লাহ ফাহিম। এই তিনজনকে বাদ দিলে এখনো নিখোঁজ যাঁরা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে পারেন বলে অনুমান করা হচ্ছে, তাঁদের সংখ্যা ডিএমপির হিসাবে ২১।

পুলিশের এই তালিকায় নাম নেই, এমন আরও ছয়জনের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানা গেছে অনুসন্ধানে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন এক পরিবারের এবং একজন সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তা। এ ছয়জনসহ এখন পর্যন্ত ঢাকায় নিখোঁজ ২৭ জনের হিসাব পাওয়া গেছে।

এর বাইরে হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত তিন জঙ্গির পরিবারের সঙ্গে কথা বললে তারা তাদের পরিচিত মহলে ভিন্ন তিনটি পরিবারের তিন তরুণের নিখোঁজ থাকার তথ্য জানায়। তবে ওই তিন তরুণের পরিবারগুলো এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির চারজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, স্বজন নিখোঁজ এমন পরিবারগুলোকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এতে তদন্ত বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। নিখোঁজ থাকা এক তরুণের বোনের স্বামী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যারা হামলা করে মারা গেছে, তারা তো গেছেই। আমরা এখন সারাক্ষণ চিন্তায় আছি, আমাদের ছেলেরা কোথায় কী ঘটায় তা নিয়ে।’

পুলিশ বলছে, থানায় জিডির বাইরে আরও অনেকে নিখোঁজ থাকতে পারেন। অনেক পরিবারই জিডি করেনি। ডিএমপির মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ‘প্রেমঘটিত, ব্যবসায়িক, পারিবারিক সংকটসহ নানা কারণে মানুষ নিখোঁজ হয়। এদের মধ্যে কতজন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে নিখোঁজ, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাইনি। তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই চলছে।’

আর র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, র‍্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়নকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো বাহিনীর কাছেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই।

এক পরিবারের পাঁচজন সিরিয়ায়:

ঢাকার খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার এক পরিবারের পাঁচজন এক বছর ধরে নিরুদ্দেশ। তাঁরা হলেন ডা. রোকনউদ্দীন খন্দকার, তাঁর স্ত্রী নাইমা আক্তার, দুই মেয়ে রেজওয়ান রোকন (নাদিয়া), রমিতা রোকন ও নাদিয়ার স্বামী সাদ কায়েস। তাঁদের বিষয়ে থানায় কোনো জিডি নেই। তবে নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ বলছে, গত বছরের ১০ জুলাই এই পরিবারের সবাই দেশ ত্যাগ করেছেন। তাঁরা সিরিয়ায় পৌঁছে একজন আত্মীয়কে ফোন করে ভালো আছেন বলে জানিয়েছেন।

নিখোঁজ পিএসসির এক কর্মকর্তা: পিএসপির রংপুর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মশিউর রহমান (২৯) মাস চারেক ধরে নিখোঁজ রয়েছেন বলে তাঁর একাধিক বন্ধু জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিএসসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের ১২ মার্চ মশিউর চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র দেন। এরপর থেকে তাঁর সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। তাঁর মা পিএসসির একজন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন, পরিবারের সঙ্গেও তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই।

জানা গেছে, মশিউরের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। তিনি পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেছেন। ৩১তম বিএসএসে নন-ক্যাডারে পিএসসিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি রাজশাহীতে যোগ দেন। গত বছর রংপুরে বদলি হন। এরপর থেকে মশিউরের আচার-আচরণ বদলাতে শুরু করে বলে তাঁর একাধিক সহকর্মী জানিয়েছেন।

পুলিশের তালিকায় নিখোঁজ তরুণ:

কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইকবাল বলেন, তাঁর থানা এলাকায় তিনজন নিখোঁজ হওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন। তাঁদের পরিবার থানায় জিডি করেনি। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মো. গালিব ও সৈয়দ মো. রাজীব নামের দুই ভাই বছর দেড়েক ধরে নিখোঁজ। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলে তাঁদের স্বজনেরা দাবি করেছেন। অপর ব্যক্তি হলেন আশরাফ মো. ইসলাম, তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তাঁর বাবা পেশায় আইনজীবী।

জানা গেছে, সৈয়দ মো. গালিব নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাঁর ভাই ছিলেন স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষক। তাঁদের বাবা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। ফেনীর গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, পরিবারের কেউ গত ছয় বছরে ফেনীতে যাননি। পরশুরাম থানার ওসি আবদুল কাশেম চৌধুরী বলেছেন, গালিব হিযবুত তাহ্‌রীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ঢাকায় একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে তাঁদের কাছে তথ্য আছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে পাস করা তাওসিফ মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দেশ ছাড়েন ২০১১ সালে। এ বছরের শুরুর দিকে ছুটিতে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর মালয়েশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তার আগেই ৩ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ছেড়ে যান তিনি।

তাওসিফের চিকিৎসক বাবা ধানমন্ডি থানায় ৫ ফেব্রুয়ারি জিডি করেন। ধানমন্ডি অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন বলেন, ‘বাড়ি ছাড়ার পর থেকে তাওসিফের মুঠোফোন বন্ধ। জিডি করার পরপরই সব বিমানবন্দর ও সীমান্তে খবর দেওয়া হয়েছিল।’

একই দিনে নিখোঁজ শেহজাদ রউফ অর্ক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মার্কিন পাসপোর্টধারী শেহজাদের নিখোঁজ থাকার খবর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো এফবিআইকে জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর এক স্বজন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র বলেন, ‘ভালো ড্রামার হিসেবে শেহজাদের পরিচিতি ছিল। বছর তিনেক আগে তার মা মারা যান। তখন থেকেই সে কিছুটা চুপচাপ হয়ে যায়। শেহজাদ, নিবরাস ও তাওসিফ পরস্পরের বন্ধু ছিল। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ওয়াবি নামের আফ্রিকান বংশোদ্ভূত এক বিদেশি তরুণকে দেখা গেছে।’ এ বছরের শুরুর দিকে ওয়াবি সিরিয়ায় মারা যান বলে তাঁরা শুনেছেন।

গত ১ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটায় বই কেনার জন্য গুলশান ১ নম্বরের বাসা থেকে বাইরে যাচ্ছে বলে মাকে জানিয়েছিল একাদশ শ্রেণির ছাত্র আহমেদ আজওয়াজ ইমতিয়াজ তালুকদার। রাত আটটায় বাড়ি ফিরবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু এখনো বাড়ি ফেরেনি। এ বিষয়ে পরিবারের করা জিডির তদন্ত করছিলেন গুলশান থানার উপপরিদর্শক মাহবুব আলম। তিনি এখন মহাখালী থানায় কর্মরত। তিনি বলেন, ‘আজওয়াজের বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। আমি কিছুদিন খোঁজাখুঁজি করেছি, কিন্তু কোনো সন্ধান পাইনি।’

আরেক নিখোঁজ সন্দেহভাজন আশরাফুল মো. ইসলাম কবে থেকে অন্তর্ধান হয়েছেন, সে বিষয়ে জানতে গত শুক্রবার তাঁদের বাসায় গেলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাঁর বাবা ঘুমাচ্ছেন, তাই কথা বলতে পারবেন না। ফ্ল্যাট মালিকদের সভাপতি বলেন, ‘ওরা সপরিবারে বছরে কয়েকবার যুক্তরাজ্যে যাওয়া-আসা করে। শুনেছি সে এ লেভেলের পর যুক্তরাজ্যে পড়ালেখা করত। ছেলেটিকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ছবি প্রচারের পর আমরা জানতে পারি আশরাফুল নিখোঁজ।’

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, পেশাগত অভিজ্ঞতায় তাঁরা দেখেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই জঙ্গিবাদের সূচনা হচ্ছে। স্বজন নিখোঁজ আছেন বা ছিলেন এমন কয়েকটি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা দাবি করেছেন, সন্তানের আচরণে কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন তাঁদের চোখে পড়েনি। কারা সন্তানদের এভাবে বিপথগামী করছে, তাঁরা জানতে চান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী ও টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘অবশ্যই এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের। তবে আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশ্চর্য হয়েছি, এমন না। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এমন সংবাদ আসছিল।’

তিনি বলেন, অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চিন্তা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কোন কোন মূল্যবোধ সন্তানদের সঠিক পথে রাখবে। পরমতসহিষ্ণুতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সব মানুষের সমান অধিকার ও সম্মান এই মূল্যবোধগুলো তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে।-প্রথম আলো

১৯ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে