মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই, ২০১৬, ০১:৩৪:০৫

‌‘বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের পরই সব দৃশ্য পাল্টে যায়’

‌‘বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের পরই সব দৃশ্য পাল্টে যায়’

ওমর ফারুক ও আশরাফুল হক রাজীব : স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ডের ৪২ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশের এসপি বাবুল আক্তার কাজে যোগ দেননি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তারের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় পুলিশ প্রশাসন তাঁকে কাজে ফিরতে দিচ্ছে না বলেও জোর গুঞ্জন আছে। শুধু চাকরিতে যোগদান নয়, বাবুল আক্তারের ভবিষ্যৎ নিয়েও যে প্রশ্ন উঠেছে, তার  উত্তর মিলছে না কোনো পক্ষ থেকেই। পুলিশ প্রশাসনসহ  স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। আবার বাবুল আক্তার দীর্ঘদিন ধরেই সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ রেখেছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও এ বিষয়ে কিছু জানে না। সব মিলিয়ে বাবুল আক্তারকে নিয়ে রহস্য ক্রমেই দানা বাঁধছে।

বাবুল আক্তারকে কাজে ফিরতে না দিলে বা তিনি নিজে কাজে যোগ না দিলে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের যে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, তাও তারা করছে না। বাবুল আক্তার অভিযুক্ত হলে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে বা তাঁর প্রাপ্যতা অনুযায়ী ছুটিতে পাঠাতে হবে। আর কেউ যদি স্বেচ্ছায় কর্মস্থলে অনুুপস্থিত থাকে, সেটাও একটা বিধির মধ্যে এনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কিন্তু ‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ১৯৮৫’-এর কোনো ধারাই অনুসরণ করছে না পুলিশ বাহিনী। বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না, প্লিজ।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। কিন্তু বাবুল আক্তারকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রামের মতো একটি ব্যস্ত শহরে প্রকাশ্যে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী খুন হয়েছেন। ওই ঘটনার পর থেকেই বাবুল আক্তারকে ঘিরে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। বিশেষ করে ওই হত্যার পেছনের কারণ আর ঘটনার পর বাবুলের কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।

গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন বাবুল আক্তারের বিষয় নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তদন্ত করতে সময় লাগে। তিনিও এর চেয়ে বেশি খোলাসা করে কিছু বলেননি।

সরকারি বিধিবিধানের উদ্ধৃতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক সচিব বলেন, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি অপরাধ করলে তাঁকে সরকারি বিধি অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে আদালতে তাঁর অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়।’

এদিকে বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন গতকাল বলেন, ‘বাবুল আক্তার যদি অপরাধী হয়ে থাকে তাহলে তার বিচারের জন্য আইন আদালত রয়েছে। সে দোষী হলে তার শাস্তি হবে। তার সঙ্গে চাকরি নিয়ে এই লুকোচুরির কী মানে থাকতে পারে?’

তিনি আরো বলেন, ‘বাবুল আক্তারকে যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছে পুলিশ। এ কারণে সে নিজে থেকে সংবাদমাধ্যমকে কিছু বলছে না। এমনকি পরিবারের সদস্যদেরও সে কিছু বলছে না। আমরাও তার ওপর চাপ প্রয়োগ করি না। সে তার দুই সন্তানকে সময় দিচ্ছে। এখন খুব বেশি দরকার সন্তানদের মানসিক বিপর্যয় কাটিয়ে তুলতে তাদের পাশে থাকা।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার বাইরে বের হলে তার কোনো বিপদ হবে না, এর নিশ্চয়তা কী? আমরা সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। বাবুল যখন এ বাড়িতে এলো সেদিন থেকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ দেওয়া হলো। এর পরই পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হলো। আমরা নিজেরাই এখন বুঝতে পারছি না আসলে কী হচ্ছে।’

এদিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, বাবুল আক্তারকে পদত্যাগ করতে ‘বাধ্য’ করা হয়েছে। বিষয়টিও পরিষ্কার করেনি বাবুল আক্তার বা পুলিশ বাহিনী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোশাররফ হোসেন জানান, বাবুল আক্তার পদত্যাগ করেছেন, এমন কথা তাঁরা জানেন না।

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখছি বাবুল আক্তারের নাকি পদত্যাগপত্র পড়ে আছে পুলিশ সদর দপ্তরে। আমার প্রশ্ন, ঘটনার পর থেকে বাবুল তো পুলিশ সদর দপ্তরে যায়নি। তাহলে তার পদত্যাগপত্র কী করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গেল? পত্রপত্রিকায় সংবাদ দেখছি, চাপ দিয়ে পদত্যাগপত্র নেওয়া হয়েছে।’ তিনি প্রশ্ন করে বলেন, জোর করে কি পদত্যাগপত্র নেওয়া যায়?

গত ৫ জুন বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত ৪২ দিন পেরিয়ে গেছে। শোক কাটিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে বাবুল আক্তার যোগ না দেওয়ার কারণে উঠছে নানা ধরনের প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর না পুলিশের কাছ থেকে, না বাবুল আক্তারের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাবুল আক্তার চাকরিতে আছেন কি নেই, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। তাঁর আত্মীয়রা বলছে, বাবুলের সঙ্গে অবিচার করা হচ্ছে। তিনি এখন অফিস করার মতো অবস্থায় পৌঁছানোর পরও তাঁকে রহস্যজনক কারণে চাকরিতে যোগদানের জন্য ডাকা হচ্ছে না।

গত ২৪ জুন শুক্রবার রাত থেকে পরদিন শনিবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ১৫ ঘণ্টা রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বসিয়ে রাখা হয়েছিল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে। সেই ১৫ ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, কারা এ সময় উপস্থিত ছিল, কোনো আসামিকে এ সময় হাজির করা হয়েছিল কি না? এ সময় বাবুল আক্তারই বা কী বলেছেন? এসব নিয়ে রহস্যের যেমন অন্ত নেই তেমনি নানা কথাও ছড়াচ্ছে চারদিকে। এখন পর্যন্ত এই বিষয়গুলো কোনো পক্ষ থেকে খোলাসা করা হয়নি। এর মধ্যেই সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে, বাবুল আক্তার বিদেশে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন। কেউ কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

আবার কেউ কেউ বলছে, তিনি শিগগিরই চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে এগুলোর কোনোটির সত্যতা পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের কাছ থেকে তথ্য মিললেও মিতু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আড়াল করতে দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশের দাবি অনুযায়ী, এই হত্যা মামলার দুই আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। তাদের নিহত হওয়ার পর মামলার তদন্ত নিয়ে আরো বেশি ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।

গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেও তাঁরা কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। যে কারণে জানা যায়নি আসলেই বাবুল আক্তার পদত্যাগ করেছেন কি না। যদি করে থাকেন, সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে কি হবে না সে বিষয়েও কারো কাছ থেকে কিছু জানা যায়নি। অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, বাবুল আক্তারের কাছ থেকে নেওয়া পদত্যাগপত্রের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবুল আক্তার যদি পদত্যাগ করে থাকেন তাহলে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসবে। তাঁর পদত্যাগপত্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ভূতপূর্ব ছুটি নেওয়ার বিধান রয়েছে সরকারি চাকরিবিধিতে। বাবুল আক্তারের অবস্থার কথা বিবেচনা করে তাঁর ডিপার্টমেন্ট তাঁকে ছুটি দিতে পারে। পরে তিনি যখন যোগদান করবেন তখন ভূতপূর্ব ছুটি নিয়ে নেবেন।’

এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বাবুল আক্তার ছোট অফিসার নন যে তিনি রিকশা দিয়ে গিয়ে অফিসে যোগ দেবেন। তিনি এসপি হওয়ায় বাড়তি কিছু সুবিধা পাবেন। তাঁকে অফিসে নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠানো হবে। সেই গাড়িতে চড়ে তিনি তাঁর কর্মস্থলে যাবেন। গত ২৪ জুন রাতে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই চিত্র পাল্টে যায়।

বাবুল আক্তারর ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় বলেন, ‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার। মিতু হত্যার পর পর সারা দেশের মানুষ মিতু হত্যা নিয়ে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছে। কিন্তু ২৪ জুন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পরই সব দৃশ্য পাল্টে যায়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাতে মনে হতেই পারে, সে-ই খুনি। সেদিনের আচরণ দিয়ে পুলিশ প্রশাসন যেন এমন রায়ই দিয়ে গেল।’ তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, বাবুল আক্তারের যোগদানে বাধা কোথায়? সেটা তাঁরা বুঝতে পারছেন না।

তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বাবুল আক্তার চাকরিচ্যুত না হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি পুলিশ অফিসার। যদি তাই হয় তাহলে কেন তিনি কাজে যোগ দিতে পারবেন না। যোগদানে বাধা কোথায়?’ -কালের কণ্ঠ
১৯ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে