বৃহস্পতিবার, ২১ জুলাই, ২০১৬, ০৫:৫৩:৩৭

জঙ্গিরা অস্ত্র কিনছে অনলাইনে, আসছে ডাকে কুরিয়ারে

জঙ্গিরা অস্ত্র কিনছে অনলাইনে, আসছে ডাকে কুরিয়ারে

ফারজানা লাবনী : হামলায় ব্যবহারের জন্য হালকা ও সহজে বহনযোগ্য অস্ত্র-বিস্ফোরক কিনছে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা। বড় ও ভারী অস্ত্র আনা-নেওয়া এবং ব্যবহারের সময় ধরা পড়ার ভয় থেকেই তারা নতুন এ কৌশল নিয়েছে। অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ হামলায় ব্যবহৃত সরঞ্জাম সংগ্রহেও তারা কৌশল বদলে ফেলেছে। হাতে হাতে চালান আনা-নেওয়ার বদলে তারা এখন সাহায্য নিচ্ছে প্রযুক্তির।

উচ্চমূল্যের অস্ত্র, গোলাবারুদসহ চাহিদামাফিক সরঞ্জামের অধিকাংশই বেচাকেনা চলে অনলাইনে। জঙ্গিসংশ্লিষ্টরা পরিচয় গোপন রেখে বিশেষ কোড ব্যবহার করে পণ্যের লেনদেন করছে। মিথ্যা ঘোষণা বা ঘোষণাবিহীনভাবে সেগুলো কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাকের (পোস্টাল) মাধ্যমে স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। হামলাকারীদের হাতে এসব মারাত্মক অস্ত্র, গোলাবারুদ মাদক পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দলে ভিড়িয়েছে।

দেশের সব স্থল ও সমুদ্রবন্দর এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চলমান বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন আইরিন’ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তাতে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিথ্যা পণ্যের ঘোষণা দিয়ে আনা অস্ত্র-বিস্ফোরকসহ অন্যান্য সরঞ্জাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিরাপদে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যাচ্ছে। মালামাল বুঝে নেওয়ার পর জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা ঠিকানা বদলে নতুন কোথাও ঘাঁটি গাড়ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে এবং জঙ্গি কার্যক্রম সমন্বয় করছে। ফলে এসব বিষয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসছে কম।

বিভিন্ন দেশে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে আসিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৩টি দেশে একযোগে চলছে ‘অপারেশন আইরিন’। এনফোর্সমেন্ট কমিটি অব দ্য কাস্টমস কো-অপারেশন কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে শুরু হয়েছে এই বিশেষ অভিযান। তা সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে ‘রিজিওনাল ইন্টেলিজেন্স লিয়াজোঁ অফিস ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ (রাইলো এপি)। ‘রাইলো এপি’র সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে অভিযান শুরু হয়েছে গত ৮ জুলাই, চলবে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। তাদের সহায়তা করছে র‌্যাব।

প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, অপারেশন আইরিন পরিচালনার সময় বিভিন্ন বন্দরে ধারালো ছুরি, বিস্ফোরক, ছোট আধুনিক অস্ত্র, ছোট আকারের দা, অপ্রচলিত মাদক, ইয়াবা, নেশাজাতীয় ওষুধ, কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক ও আধুনিক ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব পণ্যের মূল্য প্রায় ৪২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা জিপিও এয়ারপোর্ট সটিং অফিস থেকে ৩০ কেজি ওজনের একটি পার্সেল আটক করা হয়।

আমদানিনীতির যথাযথ শর্ত পূরণ না করে তাতে এক কোটি টাকা মূল্যের যৌন উত্তেজক দ্রব্য আনা হয়েছে। চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজারের প্রগতি মার্কেটের ঠিকানায় তাসলিম নামে এক ব্যক্তি সেগুলোর প্রাপক। আরেকটি পার্সেল থেকে বিভিন্ন আকারের ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সেগুলো এনেছেন জয়দেবপুরের মোস্তাফিজুর রহমান।

সূত্র জানায়, গতকাল ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অভিযানকালে কুরিয়ার গেট দিয়ে খালাসের সময় সন্দেহ হওয়ায় একটি পার্সেল আটক করা হয়। তল্লাশি শেষে আড়াই কেজি ওজনের পার্সেলটির ভেতর থেকে বিভিন্ন সার্কিট, বোর্ড, ব্রিজ ও তার এলোমেলো অবস্থায় পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে বহনকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তমা ট্রেডের প্রতিনিধি সদুত্তর দিতে পারেননি।

পরে বোমা তৈরির সরঞ্জাম উল্লেখ করে পার্সেলটি কাস্টমস গুদামে জমা দেওয়া হয়। গত ৩ জুলাই পার্সেলটি টিজি-৩২১ ফ্লাইটে এসসিএস এক্সপ্রেসের মাধ্যমে শাহজালালের ফ্রেইট ইউনিটে আসে। মিথ্যা ঘোষণায় বিই দাখিল করে সেটি খালাসের চেষ্টা করা হয়েছিল। পণ্যটি আনা হয়েছে চট্টগ্রামের একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির নামে।

শুল্ক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনফোর্সমেন্ট কমিটি অব দ্য কাস্টমস কো-অপারেশন কাউন্সিলের পর্যালোচনা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশের সীমান্তে অরক্ষিত এলাকা চিহ্নিত করে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ফলে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক ও মাদকের চালান আনা-নেওয়ার সময় জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অনেকে আটক হয়েছে।

তাই এসব অবৈধ পণ্য বেচাকেনা ও পরিবহনে এখন নতুন কৌশল নিয়েছে তারা। এখন তারা অর্ডার দিচ্ছে অনলাইনে। আর চালান আনা-নেওয়া করা হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাকের মাধ্যমে। মিথ্যা ঘোষণায় আনা এসব সরঞ্জাম তারা নানা কৌশলে বিভিন্ন বন্দর থেকে ছাড়িয়ে নিচ্ছে। বেচাকেনার সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে বিশেষ কোড ব্যবহার করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কুরিয়ার সার্ভিস ও ডাক বিভাগের মাধ্যমে আনা-নেওয়ার সময় হালকা ও সহজে বহনযোগ্য ভয়ংকর অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, প্রযুক্তিপণ্য এবং মাদকের চালান আটকের ঘটনা বেড়েছে।

সূত্র জানায়, অপারেশন আইরিন নামের বিশেষ এই অভিযানে শুল্ক গোয়েন্দার একাধিক দল দেশের স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর এবং তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সক্রিয় রয়েছে। এসব জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশেষ করে জঙ্গিদের ব্যবহৃত অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক, প্রযুক্তিপণ্য কোন দেশ থেকে কারা কিভাবে আনছে, ক্রেতা ও বিক্রেতা কারা, কারা বহন করছে, কাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে তা খুঁজে বের করতে কাজ চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনলাইনে অর্ডার দেওয়া অবৈধ পণ্য বাংলাদেশে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে অধিকাংশ সময়ে নিরাপদে পৌঁছে যাচ্ছে। পোস্টাল বা কুরিয়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট লোকজন প্যাকেট বা কার্টনে কী আছে, তা না জেনেই নির্দিষ্ট ঠিকানায় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। সেসব ঠিকানায় অবস্থান করা লোকজন বেশির ভাগ সময় ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে। অবৈধ পণ্য হাতে পাওয়ার পর তারা দ্রুত পণ্যসহ অবস্থান পাল্টায়। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ পণ্যের চালান বন্দরে পৌঁছার পর আমদানিকারকের পক্ষে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে এক বা একাধিক ব্যক্তি নিজস্ব পরিবহনে করে চালান বন্দর থেকে নিয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে ‘জরুরি কাজে নিয়োজিত’ লোগো, স্টিকার বা ব্যানার টানিয়ে এসব অবৈধ পণ্য দেশের মধ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিবহন করা হয়। একই এলাকার মধ্যে বা একটি শহরের মধ্যে অবস্থান করা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী কিংবা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, যারা জঙ্গিবাদে জড়িত, নিজস্ব ব্যাগে করে এসব অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, মাদক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেয়। তবে বহনকারীরা অনেক সময় জঙ্গি হামলায় অংশ নেয় না। তারা কেবল বহনের কাজ করে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামলাকারীদের হাতে এসব মারাত্মক অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদক পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দলে ভিড়িয়েছে। তাদের তত্ত্বাবধানে কুরিয়ার বা ডাকে আসা সরঞ্জাম দেশের মধ্যে জঙ্গি-সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোন জায়গা থেকে অস্ত্র আসছে এবং তা কিভাবে বিভিন্ন দেশের জঙ্গিদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সেই নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করতে বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথভাবে কাজ করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। তাদের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত করা হয়েছে। দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, “‘অপারেশন আইরিন’ থেকে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জঙ্গি কার্যক্রমে হালকা ও সহজে বহনযোগ্য দেশি ধারালো এবং বিদেশি আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকের ব্যবহার বাড়ছে। মাদকের ব্যবহার হচ্ছে বলেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব অস্ত্র অধিকাংশ সময়ে বিদেশি বিভিন্ন চক্রের কাছ থেকে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে উচ্চ মূল্যে কেনা হচ্ছে। বাংলাদেশি কিছু ব্যক্তির সহায়তায় কুরিয়ার ও পোস্টালের মাধ্যমে অবৈধ অস্ত্র বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আশা করি জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িতদের চিহ্নিত করে আটক করা সম্ভব হবে।”

তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে কুরিয়ার সার্ভিস বা পোস্টালে আসার পর আটক অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিস্ফোরকের চালানের সঙ্গে থাকা কাগজপত্রে অনলাইনে কেনাবেচার পক্ষে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে অনলাইনে এসব অবৈধ পণ্য বেচাকেনার নির্দেশ কোথা থেকে আসছে, কাদের মধ্যে এসব বিষয়ে যোগাযোগ হচ্ছে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশে যাতে জঙ্গি কার্যক্রমের বিস্তার না হতে পারে সে জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকের প্রবেশ বন্ধে চেষ্টা করা হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, অপারেশন আইরিনে র‌্যাবের ডগ স্কোয়াড ব্যবহার করা হচ্ছে। অভিযান সফল করতে র‌্যাব সব ধরনের সহযোগিতা করছে। -কালের কণ্ঠ

২১ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে