ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : সময়টা বেশি দূর গড়ায়নি, মাঝখানে মাত্র চার মাস। আজও দৃশ্যপটে ভাসছে এপ্রিল মাসের কথা, চতুর্দিকে নির্বাচনী আমেজ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থীরা সবাই নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যস্ত। নুতন ঢাকা গড়ার স্লোগানে মুখরিত। ১১ এপ্রিল পরিচ্ছন্ন-সবুজ-আলোকিত-মানবিক’স্লোগানে ঢাকা উত্তরের প্রার্থী (বর্তমান মেয়র) হাস্যোজ্জ্বল আনিসুল হক নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। পরদিন ১২ এপ্রিল ইশতেহার ঘোষণা করেন ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী সাঈদ খোকন। তারা উভয়েই ঢাকাবাসীকে দেখালেন এক নতুন স্বপ্ন। এতে নগরবাসী সবাই উচ্ছ্বসিত হন।
আগে থেকেই সজ্জন বলে পরিচিত আনিসুল হক বললেন- ‘নির্বাচিত হলে রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসাবে গড়ে তুলবো। তিনি ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী রাখতে ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন- পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও পরিবেশবান্ধব ঢাকা; নিরাপদ-স্বাস্থ্যকর ঢাকা; ‘সচল’ ঢাকা; ‘মানবিক উন্নয়নের’ ঢাকা; ‘স্মার্ট ও ডিজিটাল’ ঢাকা এবং অংশগ্রহণমূলক ও সুশাসিত ঢাকা। তিনি তখন সিটি করপোরেশনের কাজে সমন্বয়ের ঘাটতির জন্য ‘দক্ষ’ সমন্বয়কের অনুপস্থিতিকে দায়ী করে। ‘ঢাকার নাগরিকরা আমাকে নির্বাচিত করলে সংস্থাগুলোর মধ্যে সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমে সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে পারব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’‘আমি নগরীর পিতা নই, নাগরিকদের বন্ধু হতে চাই।’
তিনি ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ-সার সম্পদ সৃষ্টি; প্রতি ওয়ার্ড, রাস্তা ও বাড়িভিত্তিক পরিকল্পিত বনায়ন; জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা এবং লেক পার্ক মাঠ পরিষ্কার ও উন্নয়ন করে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কথা বললেন। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার, নারীদের যাতায়াতের জন্য বিশেষ বাস, যথাস্থানে বাস স্টপেজ ও রেল সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে বাস্তবায়নে তৎপরতা চালানো, সড়ক সংস্কার ও ফুটপাত প্রশস্ত করে গাছ লাগানো, পথচারীদের জন্য জেব্রা ক্রসিং, পথচারী সংকেত, প্রতিটি জোনে সুনির্দিষ্ট পার্কিং কাম কমার্শিয়াল কমপ্লেক্স নির্মাণ এবং নগরের সাইকেল ব্যবহার উৎসাহিত করা ও সাইকেল লেন তৈরি করাসহ নানা স্বপ্নের কথা বললেন। ওই সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে স্বল্প-মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হবে। পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময়। দৃষ্টি যদি পরিষ্কার হয়, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে টাকা খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারবে না।
১২ এপ্রিল দুপুর ১২টা, কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনাড়ম্বরপূর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে ইশতেহার ঘোষণা করেন (বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র) সাঈদ খোকন। পরিকল্পিত উন্নয়ন, সুযোগের সমতা, নিরাপদ ও দূষণমুক্ত আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতিসহ ইশতেহারে আরো অনেক কিছু করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি অবাস্তব, কল্পনাবিলাসী এবং আকাশ-কুসুম কর্মসূচি দিইনি, অঙ্গীকার করিনি। এটা বাস্তবায়ন করা অবশ্যই সম্ভব। এই অঙ্গীকার জীবনের বিনিময়ে হলেও বাস্তবায়ন করব। আপনারা আমাকে ভোট দেওয়া এবং নির্বাচিত করা মানে, ঢাকার উন্নয়নের পথ ত্বরান্বিত করা।’ ‘আসুন, আমরা সবাই মিলে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পুরান ঢাকাকে বদলে দিই। স্বপ্নের আধুনিক ঢাকা গড়ে তুলি।’
তিনি নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিশ্রুতির মধ্যে - যানজট নিরসনে সমন্বিত গণপরিবহণ ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতাদূর ও সুষ্ঠু বর্জব্যবস্থাপনা, মেট্রোরেল ও এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ে, মোহাম্মদ হানিফ সেতুর মতো অধিকসংখ্যক দোতলা, তিনতলা উড়াল সেতুর প্রকল্প গ্রহণ, গণপরিবহণে মহিলাদের নিরাপদ চলাফেরাসহ বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করারও অঙ্গীকার করেন তিনি। অন্যদিকে, নগরবাসীর প্রাত্যহিক জীবনের চলমান সমস্যা নিরসনে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণারও অঙ্গীকার করেন তিনি। বুড়িগঙ্গাকে ঢাকার ‘মা আখ্যায়িত করে ইশতেহারে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত ও নিরাপদ রাখার অঙ্গীকার করেন। এ ছাড়া রাস্তার উন্নয়ন গণপরিবহণ বৃদ্ধি, ক্লিন ঢাকার মাস্টার প্ল্যান ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন সাঈদ খোকন।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ঢাকার দুই মেয়রের ১২৩ দিন গত হল। এ সময়ে নগরবাসীর প্রত্যাশা তারা কতোটা পূরণ করতে পেরেছেন সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলোর কতোদূর কী হলো সেটি নগরবাসী জানতে চায়। যদিও বিদ্যমান সকল সমস্যার সমাধান এই সময়ে সম্ভব নয়। তবুওেএকটা কথা আছে- মনিং শোজ দ্যা ডে, সকালের উদিত সূর্যই বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে। তাই এই ১২৩দিনে দুই মেয়রের শুরুটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে সমস্যা সমাধানে তারা কতটা সক্ষমতা দেখা পারবেন।
আমরা কি লক্ষ্য করলাম- নগরীতে উন্মুক্ত ডাস্টবিন এবং আবর্জনামুক্ত করা, ফুটপাত দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে দৃশ্যমান তেমন কোনো কিছু দেখছি না। ফলে এ গতিতে কাজ করলে দুই মেয়রের মেয়াদকালে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি গুলো কতটকু পূরণ করতে পারবেন তা নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ-সংশয়ও দেখা দিয়েছে।
কেননা, চলতি বর্ষায় নগরীতে জলাবদ্ধতা বেড়েছে বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীর এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রেও হতাশাব্যঞ্জ্যক রাজধানী দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও বিষয়টি ওঠে আসছে। সম্প্রতি এক জরিপে বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য ১০ শহরের মধ্যেআমরা ৯ নম্বর শহরে বসবাস করছি। কিন্তু এ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
মশা, যানজট, শব্দদূষণ, জলাবদ্ধতা, বিদুৎ, পানি, গ্যাসসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নগরবাসী। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ফুটপাত দখল হয়ে যাওয়া, যখন তখন খোঁড়াখুঁড়ি এসব কারণে দুর্ভোগের অন্ত নেই। পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায়ও রয়েছে সমস্যা। বর্জ্যব্যবস্থাপনা অপ্রতুল। রাস্তার ওপর ময়লার ডাস্টবিন। ময়লার গাড়ি আর যাত্রীবাসী বাস চলে একই সাথে। যানজটে পড়ে থাকলে কী অবস্থায় হয় সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক রাস্তায় স্ট্রিট লাইন জ্বলে না। বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন করায় রাস্তার ওপরই গাড়ি পার্কিং করা হচ্ছে। ফলে অর্ধেক রাস্তা বন্ধ থাকছে। এ কারণে যানজট আরও বেড়ে যাচ্ছে। যানজটের কারণে গোটা রাজধানী থমকে গেছে। অচল হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা। এ ব্যাপারে সবাই নির্বিকার।
তবে ঢাকাকে সজুজায়ন করা, বুড়িগঙ্গাসহ অন্যান্য নদী দখল রোধ, ফুটপাতগুলো দখলমুক্ত করা, বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন এবং সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে ঢাকার দুই মেয়র আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এসবের কোনো প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি না আমরা।সময় অনেক গড়িয়েছে কিন্তু কথা কাজের বাস্তবতার মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে দুই মেয়র এখন যা বলছেন তা শোনে আমরা হতবাক। তারা সেই পুরানো কথা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। গেল ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মিট দ্য প্রেসে অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘আমার কাছে জলাবদ্ধতা ও যানজটসহ সকল সমস্যা সমাধানে আলাদিনের চেরাগের মতো কোনো সমাধান নেই। ‘নগর সমস্যা সমাধানে আমি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি সেসব সমাধানের কাজে হাত দিয়েছি। কিন্তু তা রাতারাতি করা সম্ভব নয়।’
রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তিনি বলেন, ‘সারা শহরে বর্জ্য, যেখানে যাই সেখানেই বর্জ্য। এত বড় একটা শহর, এ বর্জ্য কোথাও তো ফেলতে হবে। কোনো ট্রান্সফার স্টেশন তৈরি করা হয়নি। একটা লোক আপনার বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করবে, তারপর কোথায় ফেলবে? ফেলার তো জায়গা লাগবে একটা। এজন্য আপনার বাড়ির সামনে ফেলে, আমার বাড়ির সামনে ফেলে।’ ‘আমি একটি প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। পাঁচ থেকে ছয় কাঠা করে জায়গা লাগবে। আমি ৭০টি জায়গা সিলেক্ট করেছি। এর মধ্যে ১৪টি জায়গা আমার, আর বাকিগুলো এক একটি মিনিস্ট্রির।’
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও একই ধরনের কথা বলছেন। সম্প্রতি তিনি লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি রাজধানীর জলাবদ্ধতার জন্য বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতাকে দায়ি করেছেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এ সমস্যা সমাধান করতে হবে বলে তিনি জানান। এজন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি ডায়ালগও করেছেন। তিনি ঢাকার জলাবদ্ধতার সঙ্কট নিরসনে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
অর্থাৎ আগের মতোই ‘করবো, করছি, করতে হবে’ এমন আশ্বাসের বাণীই শোনাচ্ছেন ঢাকার দুই মেয়র। জানিনা, আর কতকাল এমন বাণী শুনতে হবে আমাদের । তাই আজ মনে পড়ে গেল সেই বহুল পুরানো প্রবাদ বাক্য- ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই-ই হয় রাবণ’। এরপরও আমাদের প্রত্যাশা থাকবে- ঢাকার এই দুই মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন লঙ্কায় গেছেন ঠিক কিন্তু তারা অন্যদের মতো ‘রাবণ’ হবেন না। তারা এই নগরীর সমস্যাগুলো কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক। ই-মেইল: [email protected]
(লেখকের একান্তই নিজস্ব, এমটিনিউজ২৪ এর সম্পাদকীয় নীতির আওতাভুক্ত নয়)
৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ