শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬, ১০:২২:৫১

‘জুপিটার’ শব্দটি বাঁচিয়ে দিলো ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার

‘জুপিটার’ শব্দটি বাঁচিয়ে দিলো ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার

নিউজ ডেস্ক  : জুপিটার। সাইবার অপরাধীদের হাতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাচার হওয়া রুখতে নিউ ইয়র্ক ফেডকে এই একটি শব্দই সাহায্য করেছিল। এটা ছিল নিতান্তই ভাগ্যের জোর। এ বছরের শুরুতে দুর্ধর্ষ ব্যাংক চুরির ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এমনটাই বলছেন। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে, নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কিভাবে হ্যাকারদের লেনদেনগুলোর অসঙ্গতি শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। বিশ্লেষণধর্মী দীর্ঘ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কম্পিউটারের নিরাপত্তা ভেঙে নিয়ন্ত্রণ নেয় হ্যাকাররা। অর্থ লেনদেনের ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার পাঠায়। নিউ ইয়র্ক ফেডের চোখে ধুলো দিয়ে তারা ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার লেনদেনের ছাড়পত্র নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ফিলিপাইনের যে ব্যাংকে হ্যাকাররা আরো অর্থ পাঠাতে চেয়েছিল সে ব্যাংকের নামে যদি জুপিটার শব্দটা না থাকতো তাহলে পাচার হতে পারতো প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ঘটনাক্রমে জুপিটার একটি অয়েল ট্যাঙ্কার ও শিপিং প্রতিষ্ঠানের নাম।

প্রতিষ্ঠানটি ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে তালিকাভুক্ত। নিষেধাজ্ঞা তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির নাম থাকার কারণেই নিউ ইয়র্ক ফেডে উদ্বেগ তৈরি হয়। এরপরই তারা ভুয়া পেমেন্ট অর্ডারগুলো আরো নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখতে নিবৃত্ত হয়।

রয়টার্সের এক নিরীক্ষায় এমনটাই উঠে এসেছে। নিউ ইয়র্ক ফেডে ঘটনাটি যেভাবে সামাল দিয়েছিল তার সঙ্গে পরিচিত এক ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, ফেড ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার পেমেন্টের ছাড়পত্র না দেয়াটা ছিল ‘পুরোটাই ভাগ্যের জোর’ (টোটাল ফ্লুক)।

রয়টার্স তাদের তদন্তে আরো জানতে পেরেছে যে, হ্যাকারদের পাঠানো পেমেন্ট অর্ডারগুলো অনেক দিক থেকে ব্যতিক্রম ছিল। এগুলোর ফরম্যাট ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ট্রান্সফার অর্ডারগুলো ছিল ব্যক্তিবিশেষের নামে।

এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে সাধারণত পেমেন্ট রিকুয়েন্ট পাঠিয়ে থাকে, এগুলো ছিল তা থেকে আলাদা। এতোগুলো অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও নিউ ইয়র্ক ফেডের কাছে সব থেকে জোরালো সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়েছে জুপিটার শব্দটি। এরপরও তারা ধীরগতিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

যতক্ষণে জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, ততক্ষণে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিউ ইয়র্ক শাখা ৫টি লেনদেন অনুমোদন করে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চলে গেছে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার। তা পাঠানো হয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে। এর মধ্যে ৮ কোটি ১০ লাখ ব্যক্তিবিশেষের নামে ৪টি একাউন্টে যায়। এর সিংহভাগ অর্থই এখনও গায়েব।
ইতিহাসের অন্যতম দুঃসাহসিক সাইবার হামলার ঘটনা এটি। এতে করে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা এবং ইউএস ফেডারেল রিজার্ভের একটি ইউনিটের উদ্বেগজনক দুর্বলতার ওপর মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছে। ইউনিটটি হলো সেন্ট্রাল ব্যাংক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল একাউন্ট সার্ভিসেস ইউনিট (সিবিআইএএস)। এ সম্পর্কে মানুষের জানাশোনা কমই।

সাবেক এক কর্মকর্তা এ ইউনিটকে ‘ব্যাংকের মধ্যে আরেক ব্যাংক’ বলে আখ্যা দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরির ঘটনায়- তদন্তকারী, আইনজীবী এবং বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সঙ্গে রয়টার্সের আলোচনা এবং পেমেন্ট মেসেজ, ই-মেইল ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে: সংশ্লিষ্ট সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই বিশৃঙ্খলা ও ভুল ছিল। কিন্তু সব থেকে নাড়া দেয়ার মতো হলো- নিউ ইয়র্ক ফেডের জড়তা ও আনাড়ি আচরণ যেটা কিনা মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২টি আঞ্চলিক ইউনিটের মধ্যে সব থেকে ক্ষমতাধর এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ।

বাংলাদেশের রাজকোষ চুরির ঘটনায় উঠে এসেছে যে, নিউ ইয়র্ক ফেডে সম্ভাব্য জালিয়াতি সরাসরি (রিয়েল টাইম) শনাক্ত করার ব্যবস্থা ছিল না। অথচ, এ ধরনের ব্যবস্থা অন্যত্র ব্যবহার করা হয়। এর পরিবর্তে পেমেন্ট হওয়ার পর তা যাচাই বাছাই করার ওপর নির্ভর করা হয়েছে। সাধারণত যেটা করা হয় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে।

মাসের পর মাস, কারো ওপর দায় চাপানো যায় তা নিয়ে একে অন্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করার ফলে করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকিংয়ের সংবেদনশীল কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির সম্পদ সুরক্ষিত রাখার জন্য আস্থা রাখা হয় বড় পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকটি এখন ফেডের ব্যর্থতার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক সুইফটের কিছু ভুলের কারণে ব্যাংক হ্যাকারদের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছিল বলে দাবি করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ উদ্ধারে একসঙ্গে কাজ করছে। এর বেশি মন্তব্য করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এদিকে, নিউ ইয়র্ক ফেড কোনো ভুল পদক্ষেপ নেয়ার কথা অস্বীকার করেছে। তারা বারবার বলছে, তাদের সিস্টেমে অনুপ্রবেশ ঘটেনি। হ্যাকিংয়ের সময় এবং এর পরবর্তী দিনগুলোতে তাদের পদক্ষেপগুলো নিয়ে রয়টার্সের করা প্রশ্নের জবাব দেয় নি ফেড। মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় এবং এফবিআইয়ের চলমান তদন্তের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।

সুইফট তাদের তরফে কোনো দুর্বলতা থাকার কথা অস্বীকার করেছে। ঘটনার তদন্ত এখনও চলছে। তবে, রয়টার্সের অনুসন্ধানে, নিউ ইয়র্ক ফেড কিভাবে ধীরগতিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগে কিভাবে বিঘ্ন ঘটেছে সেসব বিষয়ে নতুন কিছু তথ্য সামনে এসেছে।

এ ঘটনায় ফেড বলতে গেলে পুরোটাই সুইফট মেসেজিং ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেছিল। জরুরি পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা ছিল সামান্যই। মিস কমিউনিকেশন এবং সেকেলে পেমেন্ট প্রক্রিয়ার অর্থ দাঁড়িয়েছে, চুরি যাওয়া অর্থের বেশির ভাগ উদ্ধার করার আগেই বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে।

এ ঘটনায় জনসমক্ষে প্রশ্ন তোলা প্রথম মার্কিন আইনপ্রণেতা কংগ্রেসওম্যান ক্যারোলিন ম্যালোনি রয়টার্সকে বলেন, ‘এতো বড় অঙ্কের অর্থ সুইফট সিস্টেমে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ফেডারেল সিস্টেমে হারিয়ে যাবে এটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা জেগে ওঠার বার্তা আর এটাকে সংশোধন করতে হবে। আমার দৃষ্টিতে আমি এটাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মানুষের আস্থার ওপর হুমকি হিসেবে দেখি।’

গত মাসে ফেড বলেছে, সম্ভাব্য ঝুঁকির আলোকে বৈশ্বিক লেনদেন নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে তারা পদক্ষেপ নিয়েছে। পদক্ষেপ নিয়ে তারা খোলাসা করে কিছু বলেনি। তবে, ফেড সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, তারা এখন ২৪ ঘণ্টা জরুরি ফোন যোগাযোগের হটলাইন স্থাপন করেছে। বিশ্বজুড়ে ফেডের আনুমানিক ২৫০ জন একাউন্ট হোল্ডারদের জন্য এই ব্যবস্থা, যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, হ্যাকাররা সুইফটের মাধ্যমে বানোয়াট পেমেন্ট অর্ডার পাঠানো শুরু করে। সময়টা ছিল বাংলাদেশের রাত। ব্যাংকের বেশির ভাগ কর্মচারী তখন বাড়িতে। হ্যাকাররা সময়টা চিন্তাভাবনা করেই বেছে নিয়েছিল বলে মনে হয়। কেননা, পরদিন ছিল বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ছুটি।

নিউ ইয়র্ক ফেডে প্রথম সুটফট বার্তা আসে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে। ওই অর্ডারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২ কোটি ডলার ট্রান্সফারের অর্ডার পাঠানো হয় শ্রীলঙ্কার একটি একাউন্টের। এর পরের চার ঘণ্টায় আরো ৩৪টি ট্রান্সফার অর্ডার পাঠানো হয় যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাউন্ট থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার ট্রান্সফারের রিকুয়েস্ট করা হয়। বৈশ্বিক লেনদেনের আলোকে এ অঙ্ক নজরে পড়ার মতো কিছু নয়। নিউ ইয়র্ক ফেড দৈনিক ৮০ হাজার কোটি ডলার লেনদেন করে থাকে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকারদের পাঠানো অর্ডার ছিল বিস্ময়করভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ।

প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, ৩৫টি বার্তার কোনোটিতেই ‘করেসপন্ডেন্ট ব্যাংক’-এর নাম ছিল না। পেমেন্ট সম্পন্ন করতে এটা প্রয়োজনীয় একটা ধাপ। এ ভুলের অর্থ হচ্ছে ওই অর্ডারগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, ঢাকার তদন্তকারীরা বলছেন, বেশিরভাগ পেমেন্টই ছিল ব্যক্তিবিশেষকে পাঠানো। কোনো প্রতিষ্ঠানকে নয়। আর তৃতীয়ত, ওদিনের পেমেন্ট অর্ডারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো বার্তার ধরন থেকে ছিল আলাদা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র মতে, জানুয়ারি ২০১৬ থেকে শুরু করে পরবর্তী ৮ মাসে ফেডের কাছে মোট ২৮৫টি পেমেন্ট রিকুয়েস্ট ইস্যু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ, গড়ে প্রতিদিন দুটিরও কম। এসব পেমেন্টের কোনটাই ব্যক্তিবিশেষের উদ্দেশ্যে নয়। ফেডের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যক্তিবিশেষের উদ্দেশ্যে পাঠানো লেনদেন অনুমোদন দেয় না তা নয়। তবে এটা সচরাচর হয় না। এতে নিরুৎসাহিতও করা হয়ে থাকে।

তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাধারণত কত সংখ্যক পেমেন্ট আসে আর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আসা অসংখ্য বার্তা সন্দেহজনক মনে হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ফেড।

নিউ ইয়র্ক ফেডে, এমন পেমেন্ট অর্ডারগুলো নিয়ে কাজ করে সিবিআইএস-এর কয়েকজন কর্মীর একটি গ্রুপ। ওই ইউনিটে কাজ করা ৫ জন সাবেক কর্মকর্তা এ তথ্য দিয়েছেন। ইউনিটটি বিদেশি একাউন্টগুলোর লেনদেন দেখভাল করে বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো।

এক সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ইউনিটটি অনেকটা ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’র মতো কাজ করে থাকে। অতি গোপনীয় পেমেন্টগুলো নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সূত্র মতে আনুমানিক ১০ জনের একটি দল পেমেন্ট রিকোয়েস্টগুলো নিয়ে কাজ করে। সকালে যখন তারা কাজ করতে শুরু করে তখন সর্বোচ্চ ১০০টির মতো ট্রান্সফার রিকুয়েস্ট অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলে তারা দেখতে পায়।

সারা দিন ধরে তারা ম্যানুয়ালি প্রতিটি পেমেন্ট যাচাই বাছাই করে দেখেন। বেশিরভাগ লেনদেন সম্পন্ন হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কিন্তু কোনো সমস্যা দেখা দিলে কর্মীরা প্রধানত সুইফট ফরম্যাটিং এবং অথেনটিকেশন যাচাই করেন। এছাড়া যাচাই করেন ইউএস-এর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন বা অর্থ পাচার রেগুলেশন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো। তারা চাইলে ক্লায়েন্টের কাছে আরো তথ্য চেয়ে পাঠাতে পারেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাকারদের পাঠানো প্রথম ৩৫টি বার্তা ত্রুটিপূর্ণ ফরম্যাটিংয়ের কারণে বাতিল হয়ে গেলে হ্যাকাররা তা ঠিক করে ফের ৩৫টি রিকুয়েস্ট পাঠায়। দুটো ক্ষেত্রেই অর্থের প্রাপক ছিল একই। এ দফায় নিউ ইয়র্ক ৫টি লেনদেন অর্ডারের অনুমোদন দেয়, অসঙ্গতি সত্ত্বেও। সুইফট যাচাই-বাছাই হয়ে যাওয়ায় তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।

নিউ ইয়র্ক ফেডের জেনারেল কাউন্সেল থমাস ব্যাক্সটার কংগ্রেসওম্যান ম্যালেনিকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ৫টি পেমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর কর্মীরা বাকি পেমেন্ট রিকোয়েস্টগুলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা যাচাই করার জন্য আটকে দেয়। ব্যাক্সটার আরো লেখেন, ম্যানুয়ালি পর্যালোচনা করতে গিয়ে ধরা পড়ে পেমেন্টগুলো সন্দেহজনক (পটেনশিয়ালি সাসপিশাস)।

রয়টার্সের তদন্তে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ফেডের কর্মীদের কাছে ১২টি পেমেন্ট রিকুয়েস্ট নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছিল যে কারণে তারা দিন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি বার্তা পাঠায়। ওই বার্তায় বলা হয়, ‘পেমেন্টে প্রাপক হিসেবে ব্যক্তিবিশেষের নাম রয়েছে এবং তাদের বিস্তারিত তথ্যে অসঙ্গতি রয়েছে।’ কিন্তু তখন বাংলাদেশে ছুটির দিন এবং সময় প্রায় ভোর ৪টা। ওই বার্তার জবাব দেয়ার মতো উপস্থিত কেউ ছিল না। ব্যাক্সটারের লেখা চিঠি অনুযায়ী, পরদিন ৫ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ফেড পুরো লেনদেন ম্যানুয়ালি পর্যালোচনা করা শুরু করে।

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সূত্র মতে, এই পর্যায়ে এসে পেমেন্ট অর্ডারে থাকা জুপিটার নামটা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফেডের দায়িত্বের মধ্যে একটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের আইন যেন লঙ্ঘিত না হয় এবং নিষেধাজ্ঞা আছে এমন প্রতিষ্ঠানে লেনদেন যেন না হয় সেটা নিশ্চিত করা। এটা নিতান্তই ছিল ভাগ্য যে, নিষেধাজ্ঞার তালিকায় জুপিটার শব্দটি ছিল, যে কারণে তাদের টনক নড়ে।

৫ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ ছিল। ওইদিন ফেড কর্মকর্তারা আরো দুটি সুইফট বার্তা পাঠায়। একটিতে অনুমোদন হওয়া ৫টি লেনদেনের ৪টি নিয়ে একই প্রশ্ন করা হয়। আর ওই চারটি লেনদেনেই জুপিটার নামটা ছিল। ২য় বার্তা বাকি ৩০টি পেমেন্ট নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। ওই বার্তাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে আসেনি। আর ফেড ঢাকার সঙ্গে অন্য কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।

ফেডের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের মতো ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রায়ই সুইফট বার্তার জবাব পেতে তিন দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তিনি আরো বলেন, নিউ ইয়র্ক ফেডের উপলব্ধি হওয়া উচিত ছিল কেউ একজন কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে আর কিছু বিষয় ছিল অস্বাভাবিক। হ্যাকারদের হাতে বিকল হওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্টার ৬ই ফেব্রুয়ারি ঠিক হওয়ার পর সুইফট বার্তা পায় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তখনই প্রথম তারা জাল লেনদেন এবং ফেডের পাঠানো বার্তা দেখতে পায়। বুঝতে পারে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে। কর্মকর্তারা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করে। পরদিনের আগ পর্যন্ত সেটা তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে জানানো হয়নি।

আতিউর রহমান রয়টার্সকে বলেন, তিনি প্রথমে পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা বুঝতে পারেননি। তার ভাষ্য মতে, ডেপুটি গভর্নর আবদুল কাশেম তাকে বলেছিলেন, ‘অর্থ তখনও সিস্টেমের মধ্যেই আছে এবং তা উদ্ধার হবে শিগগিরই।’ এর জবাবে আতিউর বলেন, ‘যেটা প্রয়োজন সেটা করেন, এটা আপনার বিভাগ। কাজেই এটার সমাধা করেন।’ পরে গিয়ে স্পষ্ট হয় যে হ্যাক হওয়া অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। মার্চ মাসে পদত্যাগ করেন আতিউর রহমান। মি. কাশেমও একই মাসে ব্যাংক ছাড়েন। চলমান তদন্তের কথা বলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

হ্যাকিংয়ের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম পুরোপুরি কাজ না করায় ফেডের সঙ্গে ভিন্ন উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো বিকল্প যোগাযোগের ব্যবস্থা খুঁজে না পেয়ে ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া ইমেইলে যোগাযোগ করে যে ইমেইল শুধু কর্মদিবসগুলোতে কর্মঘণ্টা চলাকালে দেখা হয়। শনিবারে বাংলাদেশ ব্যাংক ৩টি মেইল পাঠায়।

প্রথম মেইলে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের সিস্টেম হ্যাক হয়েছে। অনুরোধপূর্বক সব লেনদেন অবিলম্বে বন্ধ করুন।’ শনিবার ছিল যুক্তরাষ্ট্রে ছুটির দিন। ফেড কর্মীরা এর কোনো জবাব দেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ পরিচালক জুবায়ের বিন হুদা ফেড ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কয়েকটি নম্বরে ফোন ও ফ্যাক্স করেন। তবে সাপ্তাহিক ছুটি হওয়ায় কোনো জবাব মেলেনি। সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেম ঠিক হলে তারা ‘টপ আর্জেন্ট’ শীর্ষক বার্তা পাঠান ফেডকে।

এতে বলা হয়, ‘৩৫টি পেমেন্ট অর্ডার ভুয়া ছিল। আপনাদের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ লেনদেন হয়ে থাকলে অনুরোধ করে তা ফেরত আনুন।’

নিই ইয়র্ক সময় রাত ১টায় বার্তাটি পৌঁছায়। সিবিআইএএস এর সাবেক এক কর্মীর মতে, সকাল সাড়ে সাতটায় সিবিআইএএস কর্মীরা এলে পরে বার্তাটি তাদের চোখে পড়ার কথা।

ফেড চলমান তদন্তের কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। সোমবার তারা অর্থ ফেরত আনার প্রচেষ্টা হিসেবে কি পদক্ষেপ নিয়েছিল সেটাও বলতে রাজি হননি ফেড। সোমবার সন্ধ্যায় এসে (ঢাকার মঙ্গলবার সকালে) হ্যাকিং শুরুর ৪ দিন পর নিউ ইয়র্ক ফেড বাংলাদেশকে জানায় যে, তারা করেসপন্ডেন্ট ব্যাংকগুলোকে জালিয়াতির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কায় পাঠানো ২ কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে লেনদেন অনুরোধে বানান ভুলের বদৌলতে। কিন্তু বাকি ৪টি পেমেন্টের জন্য অনেক দেরি হয়ে গেছে। ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনের ব্যাংক থেকে উত্তোলিত হয়ে দেশটির ক্যাসিনোতে মিশে গেছে। এরপরই শুরু হয় দোষারোপের খেলা। সুইফট তাদের সিস্টেমে ত্রুটি কথা উড়িয়ে দেয়।

১১ই ও ১৪ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন গভর্নরকে লেখা দুই চিঠিতে সুইফটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এডি হাদ্দাদ এবং অ্যালেইন রায়েস বলেন, ওই ঘটনায় অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে। এ নিয়ে সুইফট, হাদ্দাদ ও রায়েস কারো তরফেই মন্তব্য মেলেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সার্বিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও নিউ ইয়র্ক ফেডের মধ্যকার সম্পর্ক কিছুটা হলেও তিক্ত হয়েছে। ২৪শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ফেডকে লেখা এক চিঠিতে জানতে চায়, ওই পেমেন্টগুলো নিয়ে কি পদক্ষেপ তারা নিয়েছেন। এবং কেন তারা লেনদেন রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন। মে মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের দায়িত্ব নেয়া ফজলে কবির নিউ ইয়র্ক ফেডের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ডাডলিকে একই ধরনের প্রশ্ন করে চিঠি লেখেন। ডাডলি কবিরকে ফোন করে ১০ই মে সুইজারল্যান্ডের বাসেলে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন।

ওই বৈঠকে নিউ ইয়র্ক ফেড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ প্রতিনিধিরা ছাড়াও ছিলেন সুইফটের শীর্ষ নির্বাহী। তিন পক্ষ পারস্পরিক সহযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত হয়। কিন্তু ওই আলোচনা নিয়ে অবগত সূত্র মতে, বৈঠক শেষে দুই ব্যাংকই অসন্তোষ নিয়ে ফেরে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নিজস্ব সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে করা পর্যালোচনা শেয়ার করতে অস্বীকৃতি জানানোয় নিউ ইয়র্ক ফেড হতাশ। ওদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ওই লেনদেনগুলোর অস্বাভাবিক ধরন শনাক্ত করা উচিত ছিল নিউ ইয়র্ক ফেডের। পরবর্তী বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে ফেডের ওয়াল স্ট্রিট সদরদপ্তরে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে ইতিমধ্যে তথ্য চেয়ে পাঠিয়েছে মার্কিন কংগ্রেস।

গত মাসে ফেড চেয়ার জ্যানেট ইয়েলেম শুনানিতে প্রশ্নের মুখোমুখি হন। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরাসরি তত্ত্বাবধান করা হাউস ফাইনান্সিয়াল কমিটিতে রয়েছে কংগ্রেসওমেন ম্যালোনি। তিনি বলেন, এ নিয়ে একটি শুনানির দিন ঠিক করার জন্য আহ্বান জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার। রয়টার্সকে তিনি  বলেন, তিনি নিউ ইয়র্ক ফেডের কাছে আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা জানতে চাইবেন যে, কেন ওই ৫টি বানোয়াট পেমেন্টের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল আর বাকিগুলোকে নয়? -পার্থক্যটা কি ছিল? -এমজমিন
২২ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে