রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০১৬, ০৩:১৪:৪৯

চার দিনে ১২৫ ‘নিখোঁজের’ সন্ধান

চার দিনে ১২৫ ‘নিখোঁজের’ সন্ধান

নিউজ ডেস্ক: ঢাকার একটি পত্রিকার শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক ওমর ফারুক পরিবারকে না জানিয়ে গত বছরের মার্চে বিয়ে করেন। এরপর কিছুদিন যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিলেন তিনি। পরিবারের সদস্যরা পত্রিকা অফিসে খোঁজ করতে এলে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বনানী থানায় নিখোঁজের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করায়। এর কদিন পর ওমর ফারুক ফিরে এসে আবার কাজে যোগ দেন। তিনি এখন এক সন্তানের জনক।


এই ওমর ফারুকের নামও স্থান পেয়েছে র‍্যাবের প্রকাশিত ২৬২ জনের নিখোঁজ তালিকার ৩ নম্বরে। ওই পত্রিকার সম্পাদক জাহিদ ইকবাল বলেন, ‘কদিন পর ওমর ফিরে আসে। চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সে আমার এখানেই কাজ করেছে। সে জঙ্গি-ফঙ্গি কিছু না।’


গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর দেশবাসী এখনো উদ্বিগ্ন। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার রাতে তালিকাটি প্রকাশ করে র‍্যাব। এ তালিকায় ওমর ফারুকের মতো এমন অনেকের নাম রয়েছে, যাঁরা আর নিখোঁজ নন। ফলে এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।


অনুসন্ধান চালিয়ে র‍্যাবের ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের মধ্যে গত শুক্রবার ঢাকাসহ পাঁচ জেলায় আরও ২৯ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর আগের তিন দিনে ৯৬ জনের সন্ধান পাওয়া যায়। এ নিয়ে মোট ১২৫ জনের খোঁজ পাওয়া যায়।

এর বাইরে যশোরের মনিরামপুরের ১৪ জন দুই থেকে তিন বছর আগে দালালের খপ্পরে পড়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন বলে জানিয়েছেন মনিরামপুর থানার ওসি বিপ্লব কুমার নাথ। তাঁদের একজন থাইল্যান্ডে জেল খেটে দেশে ফিরেছেন। তিনি বলেন, আরও কয়েকজন থাইল্যান্ডের কারাগারে আছেন।


ঢাকা: র‍্যাবের তালিকায় ঢাকা থেকে নিখোঁজ ৭৮ জনের নাম রয়েছে। তাঁদের মধ্যে গতকাল ১৭টি ঠিকানায় খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাতে সাতজনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গতকাল পর্যন্ত ঢাকার ২৩ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আটজনের ঠিকানায় গিয়ে ওই নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। দুজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন।


তালিকার ২০ নম্বরে আছেন উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের রিহাব। গতকাল ঠিকানা ধরে ওই বাড়িতে গেলে মালিক আবদুস সামাদ বলেন, তাঁর ছেলে রিসাতের নাম সম্ভবত ভুল করে রিহাব লেখা হয়েছে। রিসাত মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র থেকে গত নভেম্বরে পালিয়ে গেলে থানায় জিডি করা হয়। পরদিন সন্ধান পাওয়ার পর তা থানাকে জানানো হয়। রিসাত এখন চিকিৎসাধীন আছেন।


আরেক ‘নিখোঁজ’ সাগরের বিষয়ে খোঁজ নিতে উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরের ঠিকানায় গেলে নিরাপত্তাকর্মী সগির মাস্তান বলেন, ‘আমার নামই তালিকায় সাগর লেখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, একটি খুনের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে র‍্যাবের সদস্যরা গত ২২ জুন তাঁকে তুলে নিয়ে যান। তখন তাঁর স্ত্রী জিডি করেছিলেন। পরে র‍্যাব তাঁকে ছেড়ে দেয়।

উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ‘নিখোঁজ’ রোমিওর বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তার ছেলে অভিমান করে এক আত্মীয়ের বাসায় চলে গিয়েছিল। পরে ফিরে এসেছে।

উত্তর শাহজাহানপুরের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ওরফে শাকিলের মানসিক সমস্যা আছে বলে দাবি করেন তাঁর ভাই বাবুল রহমান। তিনি বলেন, ‘শাকিল দুবাই থেকে আসার পর টাকাপয়সা নষ্ট করে ফেলে। পরে নেশায় ডুবে যায়। সে ১৯ দিন নিখোঁজ থেকে পরে বাসায় ফিরে। এখন আর বাসার বাইরে যায় না।’

‘নিখোঁজ’ আনিস হাওলাদার বনশ্রীর এইচ ব্লকে বেস্ট মার্ক প্রপার্টিজের একটি প্লটের দারোয়ান ছিলেন। ওই প্লটের পাশের একটি ভবনের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মান্নান হাওলাদার বলেন, তাঁর ও আনিসের বাড়ি পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থানার ধাওয়া গ্রামে।

আনিসের বউয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলে জেনেছেন যে আনিস এখন রাজধানীর কোনো একটি মসজিদে থাকেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে ফোন করেন। কিন্তু কোথায় আছেন, সেটা বলেন না।

‘নিখোঁজ’ ওয়াকি চৌধুরীর সেগুনবাগিচার বাসায় গেলে তাঁর বাবা জাহিদ আহমেদ চৌধুরী প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি ইন্টারকমে বলেন, ‘আমার ছেলে নিখোঁজ না। কেউ দুশমনি করে তালিকায় নাম ঢুকিয়েছে। ওয়াকি শরিয়া ল পড়তে এ বছরের মার্চে তুরস্কে গেছে। আমার সঙ্গে তার প্রতিদিন কথা হচ্ছে।’

সরাসরি কথা বলতে চাইছেন না কেন জানতে চাইলে জাহিদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, তাঁর বাসায় র‍্যাবের লোকজন এসেছিল। একের পর এক সাংবাদিকেরা আসছেন। তিনি কথা বলতে বলতে হয়রান। তিনি বলেন, ওয়াকি কলাবাগানে লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ থেকে এলএলবি পাস করে তুরস্কে গেছেন।

তালিকায় নিখোঁজ সোহাগ মিয়ার পরিবারের যে যোগাযোগ নম্বর দেওয়া হয়েছে, তাতে ফোন করলে এক নারী বলেন, ‘আমি বা আমার বাসার কেউ নিখোঁজ নন, কখনো নিখোঁজ হননি।’

‘নিখোঁজ’ রেজত রানা ফারুক সজলের (২২) ঠিকানায় গিয়ে এ নামের কারও সন্ধান পাওয়া যায়নি। মো. মামুন হোসেন রায়হান হোসেনের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া আছে মহাখালীর আমতলীর বীর উত্তম জিয়াউর রহমান মোড়ে। কিন্তু আমতলী এলাকায় এ নামের মোড় খুঁজে পাওয়া যায়নি।

‘নিখোঁজ’ শামীম রেজার ঠিকানা হলো উত্তরার রাজলক্ষ্মীর কুসুম সেন্টার। কিন্তু ওই এলাকায় কুসুম সেন্টার বলে কিছু নেই। মো. রিয়াদের ঠিকানায় উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে গিয়ে এ নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী রফিকুল ইসলাম বলেন, সেখানে রিয়াদ নামের কেউ থাকেন না।

বেলাল মোল্লার খোঁজে মুগদার পূর্ব মানিকনগরের ঠিকানায় গিয়ে এই নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। আর মো. রাসেলের খোঁজে খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ঠিকানায় গেলে ওই বাসার মালিক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, এই নামের কেউ এখানে থাকেন না।

‘নিখোঁজ’ ইব্রাহিম হাসান খানের যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, নিউ ইস্কাটন এলাকা ঘুরে সেটা খুঁজে পাওয়া যায়নি। রমনা থানার পুলিশও ইব্রাহিম সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে র‍্যাব বলেছে, ইব্রাহিম গত বছর ফেসবুকে আরবিতে পোস্ট দিয়ে বাড়ি ছাড়েন।

ওমর হাসান শাহজালাল চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেন। গত ২৮ জুন অল্প কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে সে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। শাহজালালের বাবা দুবাই থাকেন। তাঁর নানা জয়নাল আবেদিন মোল্লা বলেন, শাহজালাল চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন। নানা বলেন, ‘ডাক্তারি কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল। মনে হয় পড়াশোনার চাপে সে বাড়ি ছেড়েছে।’

ঢাকা কলেজের ছাত্র মো. ফিরোজ মিয়া গত বছরের ২২ আগস্ট নিখোঁজ হন। তাঁর বাবা উলফত কবীর বলেন, ‘একদিন একটু বকাঝকা করেছিলাম। এরপর যে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল, এখনো ফিরে আসেনি।’

কিশোরগঞ্জ: র‍্যাবের নিখোঁজ তালিকায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাতজনের নাম আছে। গতকাল পর্যন্ত তাঁদের ছয়জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। তাঁদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের মধ্যে একজন কালিপুর দক্ষিণপাড়ার মামুন মিয়া (২৪)। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ আল মাসুদ। তিনি বলেন, পরিবারের অমতে বিয়ে করে ২০ জানুয়ারি বাড়ি থেকে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান। ১৫ দিন পর বউ বাড়ি আসেন।

বাড়িতে ঝগড়া করে ১৭ জুন বেরিয়ে যান কমলপুর মহল্লার রহমত উল্লাহ। ৬ জুলাই ফিরে আসেন। ‘নিখোঁজ’ আজিজুল হক বলেন, পারিবারিক কলহের জেরে ১১ এপ্রিল বাড়ি কদিন বাইরে ছিলেন।

তালিকায় পঞ্চবটীর মো. ছোবহান মিয়ার বয়স ১৯ বছর লেখা হলেও পরিবারের সদস্যরা বলেন, তার বয়স ১২। ভৈরব থানার ওসি বদরুল আলম তালুকদার বলেন, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করে ছোবহান পালিয়ে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠে। কিছুদিন আগে সে ফিরে আসে।

চণ্ডীবের মধ্যপাড়ার কাউসার আহমেদ সৌরভ (১৫) বলে, পরিবারের সদস্যরা কেউ তাকে গুরুত্ব দিত না। এ কারণে সে বাড়ি ছেড়েছিল, কদিন পর আবার ফিরে আসে। শম্ভুপুরের মো. মান্নান (১৫) নিখোঁজ হওয়ার কদিন পর বাড়ি ফিরে আসে।

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম থেকে ‘নিখোঁজ’ আরও দুই ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর আগে অনুসন্ধান করে চট্টগ্রাম জেলায় ২৩ জনের খোঁজ পেয়েছিলেন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের ৩৪ জন নিখোঁজের মধ্যে ২৫ জনের সন্ধান পাওয়া গেল।

গতকাল খোঁজ পাওয়া একজন নুরুল হুদা (৪০) মিরসরাই উপজেলার বারইয়ারহাট বাজারের মাছ ব্যবসায়ী। তাঁর বাবা আবদুল মোতালেব বলেন, ১৯ এপ্রিল ৫০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় সাগরিকা সড়ক এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন নুরুল হুদা। ২২ এপ্রিল হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নুরুল হুদাকে উদ্ধার করা হয়।

একই উপজেলার রহমতাবাদ গ্রামের জরুল ইসলামের নাম আছে র‍্যাবের তালিকায়। কিন্তু ওই গ্রামে এ নামের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ফেনী: ফেনীর ১৩ নিখোঁজের মধ্যে পাঁচজনই বাড়িতে আছে। একজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়া হয়েছে এবং আরেকজন পারিবারিক বিরোধে পলাতক বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। র‍্যাবের তালিকায় দুজনের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা নেই।

কুমিল্লা: এখানে নিখোঁজ ২২ জনের মধ্যে গতকাল আরও নয়জনের খোঁজ পাওয়া গেছে। এর আগে একজনের খোঁজ মিলেছিল। এ নিয়ে ১০ জনের খোঁজ মিলল।

সদর দক্ষিণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, র‍্যাবের তালিকার সাতজন ফিরে এসেছেন। তাঁরা হলেন ঢাকার ফকিরাপুলের ইয়াসিনের ছেলে তন্ময় (২০), উলুরচরের ফতেপুরের সাদ্দাম হোসেন (২২), নন্দনপুরের এহসানুল হক কাউসার (২২), কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উত্তর আশ্রাফপুরের রাজন (২২), তালতলীর কাজী মো. জহির (৩০), উত্তর জয়কামতার মাসুদ পারভেজ (২৩) ও হালুয়াপাড়ার আবদুস সালাম (২৪)।

আর ‘নিখোঁজ’ জুনন শিকদারের (২৯) বাবা মেঘনা উপজেলার কান্দেরগাঁও গ্রামের ওয়াহিদুর রহমান বলেন, তাঁর ছেলে মালয়েশিয়ায় কর্মরত আছেন। আর শশীদল গ্রামের এস এম তাহসানের (৩২) খোঁজ পাওয়া গেছে বলে জানান ব্রাহ্মণপাড়া থানার ওসি এস এম বদিউজ্জামান।

কুষ্টিয়া: নিখোঁজের তালিকায় কুষ্টিয়ায় তিনজনের মধ্যে ভেড়ামারা উপজেলার মধ্যবাজার স্বর্ণপট্টির মোহাম্মদ মারজুক হায়দার জাহিন (১৬) গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ। তার মা লাইলা আনজুম বলেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক ছিন্ন করতে তাকে মারধর করা হলে সে বাড়ি থেকে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি।

মিরপুর উপজেলার সাহেব নগরের মহিদুল ইসলাম (১৭) গত বছরের এপ্রিলে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেনি বলে জানান তার বড় ভাই তরিকুল ইসলাম। ভেড়ামারা উপজেলার গোলাপনগরের মিন্টু শেখ ওরফে মিন্টু বৈরাগী (২৭) গত বছরের অক্টোবর থেকে নিখোঁজ।

বরগুনা: শহরের গগন আলী সড়কের বেল্লাল হোসেন (৩০) দুই বছর তিন মাস ধরে নিখোঁজ। তাঁর বাবা জাকারিয়া মোল্লা বলেন, ছেলে তাঁর সঙ্গে ব্যবসা করতেন। ২০১৪ সালের ৩ এপ্রিল বেল্লাল বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। তিনি বলেন, বেল্লাল নিখোঁজ হওয়ার বছর খানেক আগে তাবলিগ জামাতের দিকে ঝুঁকেছিলেন। তিনটি চিল্লা সম্পন্ন করেন।-প্রথম আলো

২৪ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে