নিউজ ডেস্ক : ‘... প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের নাম, ঠিকানা, পরিচয় এখনো পুলিশ জানে না, তাদের জঙ্গি পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুলশান হামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত হলো পুলিশ? নিহতরা আসলে কারা? এই চার পিস্তল দিয়ে হাজারখানেক পুলিশের সঙ্গে কতক্ষণ লড়াই সম্ভব?...’
জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের ব্লগে এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে ‘কল্যাণপুরে অভিযান : আমরা যা এখনো জানি না’ শিরোনামে এক লেখায়।
বাংলাদেশের ঢাকার কল্যাণপুরে পুলিশের যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন স্টর্ম টুয়েন্টি সিক্স’ নামে পুলিশের গভীর রাতের অভিযানে নয়জন নিহত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে এমন প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
এমন প্রেক্ষাপটে পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার পক্ষ থেকে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার জবাব সহকারে পোস্টিং দেয়া হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস লিখেছেন।
যেসব প্রশ্ন আলোচিত হচ্ছে তার থেকে কয়েকটি উল্লেখ করে পুলিশের কর্মকর্তা মি ইসলাম পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘নাম-ঠিকানা না জেনে জঙ্গি বলছেন কীভাবে?’ ‘জঙ্গিরা এ রকম পাঞ্জাবি, কেডস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল কেন?’
‘৪টি পিস্তল দিয়ে কীভাবে সারারাত মুহুর্মুহু গুলি চালানো সম্ভব?’ ‘কেন তাদের জীবিত ধরা গেল না?’ এ রকম অনেক যৌক্তিক প্রশ্ন কারো মনে আসতেই পারে। আমি যদি বলি আপনি বুঝে ও না বোঝার ভান করছেন আপনি খণ্ডাবেন কি করে?’
আবার পুলিশের এই অভিযানকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে প্রশংসামূলক অনেক পোস্টিংও এসেছে।
মোস্তাফা বাবুল নামে একজন লিখেছেন, ‘জার্মানিতে হামলা চেষ্টাকালে পুলিশ এক জঙ্গীকে গুলি করে হত্যা করেছে। একই ঘটনা ঘটেছে আমেরিকাতেও। ফ্রান্সেও দুষ্কৃতকারীকে হত্যা করতে পুলিশ দ্বিধা করেনি।
...এসব দেশে কোনো দুষ্কৃতকারীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলে কেউ প্রশ্ন তুলে না। ...এসব প্রশ্ন করা যায় কেবল বাংলাদেশে। বাংলাদেশে জঙ্গীরা নির্দয়ভাবে মানুষ হত্যা করবে আর তাদেরকে হত্যা করতে পারবে না নিরাপত্তা বাহিনী।
দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নিরাপত্তা বাহিনী কি করবে না করবে সেটা তাদের এখতিয়ার। এ নিয়ে পৃথিবীর কোথায়ও প্রশ্ন তোলা হয় না’।
তবে একটা বড় অংশই এই অভিযানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংশয় এবং সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
বিরোধী দল বিএনপির নেতা আসম হান্নান শাহ ‘এ অভিযানে নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে’ বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তার বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর আসে।
তবে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের স্ট্যাটাসে লেখেন- ‘গোটা সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে আলোচনা হচ্ছে যে প্রতিবেশীরা বলছে, ওই বাসার লোকেরা সারারাতই কথিত জিহাদের স্বপক্ষে স্লোগান দিয়েছে, তাদের রুমে কথিত আইএসের পতাকা পাওয়া গিয়েছে, প্রচুর সংখ্যক উগ্রবাদী বই-পুস্তক পাওয়া গেছে। তারপরও এরা জঙ্গি কি-না তা বোঝার জন্য কি রিসার্চের প্রয়োজন আছে?’
অভিযানটির পর পুলিশের সাফল্য নিয়ে অনেকেই লিখলেও এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন বিবিসি বাংলার সামাজিক ফোরামেও তুলেছেন অনেক পাঠক-শ্রোতা।
মোহাম্মদ কামাল আজমী এ সংক্রান্ত খবরের নিচে লিখেছেন, ‘করলো গোলাগুলি, ছুড়লও গ্রেনেড, কিন্তু মরার পরে হাতে আপেল কাটার ছুরি কেন?? পুলিশের গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হলেও, হাতের আপেল কাটা ছুরি ফেলে দেননি জঙ্গিরা..!!?’
সাইফুল্লাহ বাবু নামে আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘...পাশের ঘরেই লোকজন ছিল। তাদেরকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখে পুলিশ। তার মানে ওপর থেকে গোলাগুলির খবর পুরাটাই বানোয়াট। আগেই ওখানে গিয়ে পুলিশ পজিশন নিয়ে ঘটনা ঘটায়। পুলিশের সাথে গোলাগুলি সত্যি হলে পাশের রুমের লোকও গুলিবিদ্ধ হতো। সেটা হয়নি’।
মানুষের এই সন্দেহ প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে আবার সামাজিক মাধ্যেমে প্রশ্ন তুলেছেন লেখক ও সাংবাদিক আনিসুল হক।
ফেসবুকে তার স্ট্যাটাস, ‘এই দেশের মানুষের হইলটা কী। তারা খালি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দেখে কেন? সকাল থেকে টেলিভিশনে আশেপাশের বাড়ির লোকেরা বলল, রাতে প্রথম পুলিশ তল্লাশি করতে যাওয়ার পর থেকেই ওরা স্লোগান দিছে, গাজি বা শহীদ হইতে চাইছে, তারপর সকালে পুলিশ অভিযান চালাইছে। সাধারণ লোকদের সাক্ষাৎকার বিভিন্ন চ্যানেলে দেখলাম। এগুলা সব বানানো?
এখন বলেন, হাসান ওরফে রিগ্যানও বানানো। তার মা, বগুড়ার বাড়ি, এক বছর আগে নিখোঁজ হওয়া–– সেসবও বানানো। যেই দেশের মানুষ এত অবিশ্বাসী, তাদের সঙ্গে থাকা মানে যেই দেশে তেল–ঘির দর সমান সেই দেশে থাকা’।
অভিযানকে ঘিরে সন্দেহ কেন?
কিন্তু এ ধরনের একটি অভিযানের পরও তা বিশ্বাস করতে পারছে না কেন অনেক মানুষ?
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশিদ বলেন, ‘এই সন্দেহের কারণ গুলশান হামলার পর অনেকে জঙ্গিদের অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ভাবতে শুরু করেছেন। সে কারণে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের এই অভিযানকে তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না’।
মি রশিদ বলেন, ‘সাধারণ মানুষ জীবিত কাউকে ধরতে পারলে হয়তো এসব প্রশ্ন তুলতেন না। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কৌশলই হচ্ছে কারও হাতে মারণাস্ত্র থাকলে নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের গুলি করা হবে’।
তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক হিসেবে তিনি নিজে এই অভিযানকে ‘সাজানো’ বলে মনে করেন না। স্থানীয় লোকজনের সাক্ষাতকার বা টেলিভিশন ফুটেজ দেখে সেটাই মনে হয়েছে বলে জানান।
কল্যাণপুরে নিহত ৯ জনের গায়ে ‘মধ্যরাতে কালো পোশাক কেন’ এমন সন্দেহ প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, গুলশানের হত্যাকাণ্ডের পর হামলাকারীদের আইএসএর পতাকা নিয়ে কালো পোশাক পরা ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল।
এখানেও নিহতরা এ ধরনের কোনো ছবি তোলার আয়োজন করছিল বলে তিনি ‘সম্ভাব্য অনুমান’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি এও বলেন, ‘হয়তো তারা সামনেই কোনো হামলার পর সেগুলো ব্যবহার করতো’। -বিবিসি
২৭ জুলাই, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম