শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬, ০২:২২:০৩

জঙ্গিদের ৯ 'বড় ভাই'

জঙ্গিদের ৯ 'বড় ভাই'

সাহাদাত হোসেন পরশ ও আতাউর রহমান: কল্যাণপুরের জাহাজ বিল্ডিংয়ের পঞ্চমতলা ছিল 'নব্য জেএমবি' সদস্যদের মূল আস্তানা। প্রাথমিকভাবে সংগঠনে যোগ দেওয়া সদস্যদের সেখানে গোপনে রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। পাশাপাশি বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহার করত জঙ্গিরা।

মঙ্গলবার ভোরে ওই বাড়িতে 'অপারেশন স্টর্ম-২৬' নামে বিশেষ অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হয়। এর পর ধীরে ধীরে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। গোয়েন্দারা বলছেন, জঙ্গিদের অর্থ, অস্ত্র-গোলাবারুদ, বিস্ফোরক সরবরাহ করত তাদের নয় 'বড় ভাই'।

তারাই জঙ্গিদের বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিত। এই নয়জন হলো- ইকবাল, তামিম চৌধুরী, রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জুনায়েদ খান, বাদল ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ। তাদের মধ্যে তামিম, জুনায়েদ ও বাদল র‌্যাবের নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছে। এখন নয় 'বড় ভাই'কে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।


এদিকে, কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানা থেকে পুলিশের ওপর হামলা ও অভিযানে নয় জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনায় বুধবার মধ্যরাতে মিরপুর থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। ওই মামলায় অভিযানে আটক রাকিবুল হাসান ছাড়াও নয় বড় ভাইকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকজন অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়। মামলায় ৫৪ ধরনের আলামত জব্দের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পুলিশের দাবি, অভিযানে নিহত মোতালেব ওরফে আবদুল্লাহ জেএমবির 'আধ্যাত্মিক শিক্ষক' ও রায়হান কবির ওরফে তারেক অস্ত্রের প্রশিক্ষক। তারা গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলাকারীদেরও প্রশিক্ষক ছিল। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেপথ্যে অবস্থান করে উগ্রপন্থিরা জাহাজ বিল্ডিংয়ে অবস্থানরতদের ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সংগঠনে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করত।

নিহত নয়জনের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার আরও এক জঙ্গির পরিচয় জানতে পেরেছে পুলিশ। তার নাম রায়হান কবির ওরফে তারেক। তার বাবা মো. শাহজাহান। রংপুর জেলার পীরগঞ্জের পশুয়া টাঙ্গাইলে তাদের বাড়ি। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা রায়হান এক বছর ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

এর আগে বুধবার সাত জঙ্গির পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ। নিহত একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সে চট্টগ্রামের সাব্বিরুল হক কনিক।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, কল্যাণপুরে নিহতদের কয়েকজন নব্য জেএমবির সদস্য। তারা এর উগ্র অংশের সদস্য। গুলশানের রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ার হামলায়ও নব্য জেএমবির অন্য সদস্যরা অংশ নিয়েছিল। কল্যাণপুরের অভিযানের সময় ইকবাল নামের একজন পালিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, কল্যাণপুরের আস্তানায় তাদের রেখে হামলার জন্য উপযোগী করা হচ্ছিল। এ জন্য সেখানে কয়েকজন প্রশিক্ষক নিয়মিত যাতায়াত করত। আটক হওয়া রাকিবুল হাসান তাদের ব্যাপারে অনেক তথ্য দিয়েছে।

নব্য জেএমবির নেতৃত্বে পলাতক তামিম চৌধুরী ও জুনায়েদ খান: গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পরই আলোচনায় আসে তামিম চৌধুরী ও জুনায়েদ খানের নাম। ওই সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রথম যে ১০ নিখোঁজের তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাতে ছিল এ দু'জনের নাম।

কল্যাণপুরের ঘটনায়ও তাদের আসামি করা হয়েছে। তারা নিয়মিতই কল্যাণপুরের আস্তানায় যেত বলে পুলিশ জানিয়েছে। জঙ্গি দমনের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে জেএমবির যে অংশটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে, ওই অংশটির অন্যতম শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরী।

তার বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে। বাবার নাম শফি উদ্দিন চৌধুরী। বছর দু-এক আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরী দেশে ফিরে জঙ্গি কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে দেশি জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের একজন জুনায়েদ খান। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার 'ই' ব্লকের ৬ নম্বর রোডে তার বাসা। জুনায়েদের ভাই ইব্রাহীম হাসান খানও দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ।

বসুন্ধরায় জুনায়েদের প্রতিবেশীরা জানান, তাদের পুরো পরিবার দেড় বছর ধরে নিখোঁজ। সৌদি আরব গেছেন বলে তারা শুনেছেন। একাধিক বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা তামিমকে খুঁজছে বলে জানা গেছে।

অন্য সাতজন 'প্রশিক্ষক ও অর্থদাতা': আটক রাকিবুল হাসান ওরফে রিগেনের কাছ থেকে তামিম চৌধুরী ও জুনায়েদ খানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেলেও অপর সাত 'বড় ভাই'য়ের নাম গোয়েন্দাদের কাছে অপরিচিত। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, রাকিবুলের কাছ থেকে ওই সাতজনের শারীরিক বিবরণ নেওয়া হয়েছে। সে সুস্থ হলে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

তিনজনই নর্থ সাউথের : ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার পর জঙ্গি-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রথম আলোচনায় আসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ওই হত্যাকাণ্ডে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কয়েক শিক্ষার্থীর দণ্ড হয়েছে। এরপর গুলশানের রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় হামলার পর আবারও আলোচনায় আসে বেসরকারি এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম।

ওই দুটি ঘটনার মধ্যে গুলশানে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিবরাস ইসলাম। এর পর শোলাকিয়ায় হামলা চালাতে গিয়ে নিহত হয় আরেক ছাত্র আবীর রহমান। এবার কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নিহত নয়জনের মধ্যে তিনজনই নর্থ সাউথের ছাত্র। তারা হলো_ সাজ্জাদ রউফ ওরফে অর্ক ওরফে মরক্কো, তাজ-উল-হক রাশিক ও আকিফুজ্জামান খান।

আকিফুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খাঁনের নাতি। তার গুলশানের বাসায় যাওয়া হলেও এ নিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। এ ছাড়া সাজ্জাদের দাদা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আবদুর রউফ। তার জন্ম বাংলাদেশেই। তবে ১৯৯৯ সালে তাদের পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়।

সাজ্জাদের কৈশোরের অনেকটা সময় কাটে ইলিনয় ও ক্যালিফোর্নিয়ায়। পরে তার মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে তাদের পরিবার ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর ২০১০ সালে ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ালেখা শেষে সাজ্জাদ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। গুলশানে হামলাকারী নিবরাস ইসলাম ও সাজ্জাদের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা রয়েছে।

আটক চারজন রিমান্ডে: জাহাজ বিল্ডিং থেকে আটক চারজনকে দু'দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। ওই চারজনকে গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার ও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন মিরপুর থানার উপপরিদর্শক বজলার রহমান। ঢাকার মহানগর হাকিম নূর নাহার ইয়াসমিন তাদের দুই দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন। তারা হলেন_ মাজহারুল ইসলাম, মাহফুজুল আলম, মোমিন উদ্দিন ও জাকির হোসেন।

এর আগে বুধবার বাড়ির মালিক মমতাজ পারভীনকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এদিকে, কল্যাণপুরের ঘটনায় দায়ের মামলায় ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুলিশকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত। গতকাল মামলার এজাহার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে পেঁৗছানোর পর মহানগর হাকিম মো. সাজ্জাদুর রহমান এ নির্দেশ দেন।-সমকাল

২৯ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে