আতাউর রহমান: গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলাকারীরা একই আস্তানায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার চরের আস্তানায় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের ভয়ঙ্কর দুই হামলার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এরপর গুলশান হামলার কয়েকদিন আগে ২৬ জুন পাঁচ জঙ্গিকে ঢাকার আস্তানায় আনা হয়।
গত ২ জুলাই শোলাকিয়ার হামলাকারীদের ওই এলাকায় পাঠানো হয়। পুরো কাজের সমন্বয় করে পলাতক জঙ্গি রাজীব। শোলাকিয়ার হামলায় কমান্ডারের দায়িত্বে ছিল জঙ্গি করিম। শোলাকিয়া হামলার সময় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক জঙ্গি শফিউল ইসলাম ওরফে ডন ওরফে মোকাতিল র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য জানিয়েছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহের নান্দাইলে র্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' শফিউলসহ দুই জঙ্গি নিহত হয়। এর আগে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সে ২৮ দিন র্যাবের পাহারায় চিকিৎসাধীন ছিল। র্যাব সূত্র জানায়, ওই সময়ই জিজ্ঞাসাবাদে শফিউল জঙ্গি কার্যক্রম সম্পর্কে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়।
ময়মনসিংহে র্যাব-১৪ অধিনায়ক লে. কর্নেল শরীফুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে শফিউলকে ময়মনসিংহে চিকিৎসা শেষে কিশোরগঞ্জে নেওয়া হচ্ছিল। নান্দাইলের ডাংরি এলাকায় পেঁৗছলে দুটি মোটরসাইকেলসহ আগে থেকে অবস্থান নেওয়া জঙ্গিরা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য র্যাবের গাড়িবহরে হামলা চালায়।
হামলাকারীরা ককটেল ও গুলি ছুড়ে শফিউলকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে র্যাবের মাইক্রোবাসে থাকা শফিউল ও অজ্ঞাতনামা এক হামলাকারী গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের নান্দাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক দু'জনকে মৃত ঘোষণা করেন। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিহত অপরজনের পরিচয় জানা যায়নি। আঙুলের ছাপ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে থাকা তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতী মাহমুদ খান বলেন, হাসপাতালে থাকা অবস্থায় শফিউলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সে জঙ্গি কার্যক্রমে নিজের জড়ানো থেকে শুরু করে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, শোলাকিয়া হামলাসহ বেশকিছু তথ্য দেয়। কয়েকজনের নামও জানিয়েছে সে। তার তথ্যের সূত্র ধরে রাজীব ও কমান্ডার করিম নামের দুই জঙ্গিকে চিহ্নিত করে আটকের চেষ্টা চলছে।
চাচাতো ভাইয়ের মাধ্যমে এই পথে শফিউল : র্যাব কর্মকর্তারা জানান, জঙ্গি শফিউলের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে। সে দিনাজপুরের বিরামপুরের একটি মাদ্রাসায় দাখিল পাস করে আলিম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এতদিন 'ওস্তাদের' নির্দেশে সে পড়ালেখা বাদ দিয়ে কথিত জিহাদের জন্য মাদ্রাসা ছাড়ার কথা বলা হলেও র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শফিউল জানিয়েছিল, ২০১৪ সালে তার চাচাতো ভাই শাহাবুদ্দিনই তাকে গেরিলা আক্রমণের ব্যাপারে পরামর্শ দেয়।
এরপর সে আবুল নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে আবুলের নির্দেশে সে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে যায়। শফিউল গাইবান্ধা গিয়ে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে চার মাস আবুল ও তার স্ত্রীর আশ্রয়ে থাকে। পরে আবুলের মাধ্যমেই সিরাজগঞ্জে রাজীবের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
ওই সময় রাজীব তাকে কিছু উগ্রপন্থি বই ও মোবাইল ফোন দেয়। ওই মোবাইলটির নেটওয়ার্ক আইসি খোলা ছিল; তা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদী বক্তব্য শোনানো হতো। র্যাবের একজন কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে আবুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
'লাঠি' দিয়ে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ : শফিউল র্যাবকে জানায়, রাজীব তাকে এক সময় বগুড়ার চরে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে শুরুতে শারীরিক কসরত করানো হতো। এরপর লাঠি দিয়ে নিশানা ঠিক করে বন্দুকের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
লাঠি দিয়ে বন্দুকের বিভিন্ন পজিশন দেখানো হতো। তার সঙ্গে আরও অন্তত সাতজন প্রশিক্ষণ নেয়। পরে তাদের একাধিক পিস্তল, ছুরি, একে-৪৭ এর বেয়নেট ও বিভিন্ন বিস্ফোরক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
শফিউল আরও জানায়, প্রশিক্ষণ শেষে রাজীবই তাদের মধ্য থেকে পাঁচজনকে ২৬ জুন 'চূড়ান্ত জিহাদের' জন্য অন্য আস্তানায় নিয়ে যায়। ২ জুলাই তাকেসহ ওমর নামে একজনকে শোলাকিয়ায় নিয়ে যায় রাজীব।
পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম পাঁচজন ছিল গুলশানের হামলাকারী জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, মীর সামিহ মুবাশীর, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, খায়রুল ওরফে খায়রুজ্জামান ও শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ।
তারা হামলা চালানোর পর কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়। শোলাকিয়ার হামলার ঘটনায় শফিউল ওমর নামে যার কথা বলছে, সে ওই হামলায় নিহত আবীর রহমান।
র্যাব-১৪ অধিনায়ক লে. কর্নেল শরীফুল ইসলাম জানান, শফিউলের কথায় বিভিন্ন সময়ে রাজীবের নাম এসেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ওই রাজীব জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও রিক্রুটমেন্টের কাজে জড়িত।
শোলাকিয়া হামলার কমান্ডার করিম, টার্গেটে ছিলেন মাওলানা মাসউদ : শোলাকিয়ার হামলার বিষয়েও বিস্তারিত জানিয়েছিল শফিউল। সে জানায়, ওই অপারেশনে তাদের কমান্ডার ছিল করিম নামের এক ব্যক্তি। হামলায় তাদের তিনটি গ্রুপে ৬ জন ছিল। তাদের শোলাকিয়া ঈদ জামাতের প্রধান ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে হত্যা করতে বলা হয়েছিল।
এ জন্য আগে থেকেই 'বড় ভাইয়েরা' তাদের মাওলানা মাসউদের বিভিন্ন ভিডিও দেখায়। তার স্টিল ছবিও দেওয়া হয়। তবে ঈদগাহ ময়দানে যাওয়ার পথে পুলিশের চেকপোস্ট থাকায় কমান্ডার করিম সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুলিশের ওপর হামলার সিদ্ধান্ত দেয়।
র্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, শফিউল জঙ্গি কার্যক্রমের নেপথ্যে অনেকের নাম বলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এসব নাম জঙ্গিদের সাংগঠনিক ও ছদ্মনাম। তাই তাদের চিহ্নিত করতে সময় লাগছে।
আরও চার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল শফিউল :শোলাকিয়ায় বড় হামলার আগে ছোট ছোট আরও চারটি 'অপারেশনে' অংশ নিয়েছিল জঙ্গি শফিউল। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছিল, গাইবান্ধায় থাকতে সে গোবিন্দগঞ্জের তরুণ দত্ত, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে গির্জার একজন পাদ্রি, কুড়িগ্রামে আলী হোসেন ও গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে হিন্দু ব্যবসায়ী দেবাশীষ হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এসব হত্যাকাণ্ডে তার সঙ্গে আক্তার, পারভেজ ও জাহিদসহ কয়েকজন অংশ নিয়েছিল।-সমকাল
৬ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ