রবিবার, ০৭ আগস্ট, ২০১৬, ০২:৩৫:১৩

নতুন নামে ভয়ংকর রূপে জঙ্গি দল

নতুন নামে ভয়ংকর রূপে জঙ্গি দল

রেজোয়ান বিশ্বাস: নৃশংস হামলা ও হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন নামে দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে দেশে ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। মূল দল থেকে বেরিয়ে নতুন নামে সংগঠিত হওয়া এসব জঙ্গিগোষ্ঠী গত কয়েক বছরে অর্ধশতাধিক হামলা চালিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

এসব নতুন জঙ্গি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত জিয়াউল হক ও কানাডাপ্রবাসী তামিম আহমেদ চৌধুরীসহ অন্তত ১২ জন নেতা। জিয়া ও তামিমকে ধরিয়ে দিতে সম্প্রতি ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।

তাঁদের মাধ্যমেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলো নতুন নামে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। পুলিশ ও র‍্যাবের গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র মতে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোর মাঠপর্যায়ের অনেক সদস্য মূল দল থেকে বেরিয়ে নতুন দল গঠন করতে তত্পর রয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজিবি) একদল সদস্য এরই মধ্যে ‘আল আনসার’ নামে নতুন একটি জঙ্গি দল গঠন করেছে।

এ ছাড়া জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) একদল সদস্য ‘নিউ জেএমবি’ নামে তত্পর। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমও (এবিটি) ‘আনসার আল ইসলাম’ নামে তত্পরতা চালাচ্ছে। এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর বেশির ভাগ সদস্যই সচ্ছল পরিবারের সন্তান এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পড়ুয়া।

এদের পাশাপাশি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করা দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাও রয়েছে। এ ছাড়া খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশে হামলা হত্যাকাণ্ডে জড়িত রয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর। যুক্তরাজ্য থেকে এই সংগঠনকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে সে দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেওয়া কিছু তরুণ-যুবক। হিযবুত তাহ্রীরের সংস্পর্শে থেকে অনেকটা একই আদর্শে ‘জামায়াতুল মুসলেমিন’ নামে আরেকটি জঙ্গি দল গোপনে তত্পর রয়েছে দেশে।

জিয়া-তামিম সম্পর্কে সম্প্রতি পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, গুলশান ও শোলাকিয়ায় দুই জঙ্গি হামলারই মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়া। কল্যাণপুরের জঙ্গিদের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ ছিল।

এই দুজনকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করে গতকাল শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে এক অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা এবং তামিম চৌধুরী নিউ জেএমবির নেতা।

তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক ঘটনার তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি এ দুজন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের হোতা ও মাস্টারমাইন্ড। তাদের সম্পর্কে আরো তথ্য বের করা হচ্ছে। এরা এ সমাজেই বসবাস করে, বাংলাদেশেই থাকে। কোনো না কোনো বাসায় বা বাড়িতে থাকে।

প্রত্যেকটি লোক যদি সচেতন হয়, তারা যদি জানায়, যে এরা আমাদের বাড়িতে বা এলাকায় আছে তাহলে জাতি উপকৃত হবে। আমরা তথ্যদাতার পরিচয় গোপন রাখব।’

র‍্যাবের তথ্য অনুযায়ী, দুই বছর আগে চট্টগ্রামের একটি কওমি মাদ্রাসা থেকে ‘আল আনসার’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠন কার্যক্রম শুরু করে। ওই মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থী প্রথমে নতুন জঙ্গি দলের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে।

নতুন জঙ্গি দলের প্রধান সমন্বয়কারী হাফেজ মাওলানা মোহা. রাশিদুল আলমসহ পাঁচজনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায় গত মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার জঙ্গিরা র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছে, চট্টগ্রাম ও ঢাকার বেশ কয়েকটি কওমি মাদ্রাসায় আল আনসারের দাওয়াতি কার্যক্রম চলছে।

নেপথ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রামের দুটি কওমি মাদ্রাসার দুই শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষকদেরও যোগাযোগ রয়েছে। বিভিন্ন মাদ্রাসায় আল আনসারের সদস্য করা হচ্ছে। অনেক মাদ্রাসা ছাত্রকে এরই মধ্যে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহারে অস্ত্র ও বোমার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার পাঁচ জঙ্গির মধ্যে রাসেল গাড়ি চালানোর পাশাপাশি সংগঠনের বিস্ফোরক বহন করত।

তার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মনির ও মালেক রিকশা চালানোর পাশাপাশি নিজের রিকশায় করে সংগঠনের অস্ত্র সরবরাহ করত। গ্রেপ্তার অন্য সদস্য মামুন জিহাদি বই ও কম্পিউটার টাইপ করত। এরা নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে সংগঠনের দাওয়াত পৌঁছাত।

র‍্যাব-২-এর পরিচালক লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, এরা হুজি থেকে বেরিয়ে আল আনসার নামের একটি নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আটক সবাই পূর্ববর্তী হুজির সক্রিয় সদস্য। হুজির সদস্যরা ক্রমাগত অভিযানের ফলে গ্রেপ্তার হওয়ায় তারা নতুন জঙ্গি সংগঠন আল আনসার নামে দুই বছর আগে কার্যক্রম শুরু করে।

নতুন জঙ্গি দলের প্রধান সমন্বয়কারী রাশেদুল আলম ওরফে রাশেদ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাবকে জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই তাঁরা হুজি থেকে বেরিয়ে নতুন নামে আরেকটি সংগঠন দাঁড় করান। 

র‍্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, হুজি একসময় ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন ছিল। তারা দেশে অনেক হামলা চালিয়েছে। তবে এখন তাদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে সব জেলে রয়েছেন।

হুজি জঙ্গিদের এখন আর সারা দেশে একযোগে নাশকতা সৃষ্টির সক্ষমতা নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়াতে মূল দলের সদস্যরা নতুন নামে নতুন দল গঠন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে এদের সব নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) সূত্রে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর ও পুরান ঢাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার হুজির এক নেতা ও তাঁর দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের কাছ থেকে একটি ‘হিটলিস্ট’ জব্দ করা হয়। তাতে দেশে বিভিন্ন ধর্মের ১২ জনকে হত্যা পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া যায়।

আটক হুজি নেতা নাজিম উদ্দিন মিরপুরে একটি মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, ওই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন ৫১টি পরিবারের সন্ধান মিলেছে, যেসব পরিবারের কেউ না কেউ হুজির সদস্য। এই তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

ডিবি সূত্রমতে, হুজির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা দুবাইয়ে রয়েছেন। প্রতি মাসে তাঁর মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আসছে। এরই মধ্যে সেই ব্যক্তি দুবাই থেকে হুণ্ডির মাধ্যমে দুই চালানে কয়েক লাখ টাকা পাঠিয়েছেন। টাকা আসত গ্রেপ্তার নাজিম উদ্দিনের কাছে।

জিজ্ঞাসাবাদে নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, হুন্ডির মাধ্যমে পাওয়া টাকার একটি অংশ ৫১ পরিবারের পেছনে খরচ করা হতো। হুজির যেসব নেতাকর্মী জেলে রয়েছে তাদের জামিনের পেছনেও এ টাকা ব্যবহার করা হতো।

ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে হুজি। তাদের মাঠপর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার কার্যক্রম চলছে। এখন তাদের সাংগঠনিক পরিকল্পনার মধ্যে গুরুত্ব পাচ্ছে ‘দাওয়াতি’ ও ‘জিহাদি’ কার্যক্রম। এ বিষয়ে দুটি গ্রুপ কাজ করছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, হুজির পলাতক নেতারা এর আগে আরো বেশ কয়েকটি নতুন দল গঠন করেন। হুজির সামরিক শাখার সাবেক প্রধান মাওলানা আব্দুর রউফের নির্দেশনায় তামীরুত-আত-দ্বীন নামেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চলে।

এবিটি ও জেএমবিও নতুন নামে সংগঠিত হয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছে। নিউ জেএমবিকে সংগঠিত করছেন তামিম চৌধুরী। নিউ জেএমবি পুরনো জেএমবির ভগ্নাংশ। উত্তরবঙ্গেও নিউ জেএমবির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা রয়েছেন, যিনি সদস্যদের কাছে ‘বড় হুজুর’। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলাগুলোর মূল হোতা নতুন ধারার এই জেএমবি সদস্যরা।

সর্বশেষ কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে যে ৯ জঙ্গি নিহত হয়, তারা নিউ জেএমবির সদস্য। এই গ্রুপের সদস্যরাই গুলশানে ও শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছিল। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় তামিম চৌধুরী এই গোষ্ঠীর অপারেশনাল কমান্ডার বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। 

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের অক্টোবর থেকে নিউ জেএমবি মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করে। তামিম চৌধুরী ছাড়াও নিউ জেএমবির উল্লেখযোগ্য নেতারা হলেন রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জুনায়েদ খান, বাদল, আজাদুল ওরফে কবিরাজ, রাজিব গান্ধী। এ ছাড়া এবিটিও আনসার আল ইসলাম নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ সংগঠনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মেজর (চাকরিচ্যুত) জিয়া।-কালের কন্ঠ

৭ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে