রবিবার, ০৭ আগস্ট, ২০১৬, ০৩:৫৬:৫১

ছক এঁকে দেয় 'স্যার' মূল দুই পরিকল্পনাকারী অধরা

ছক এঁকে দেয় 'স্যার' মূল দুই পরিকল্পনাকারী অধরা

সাহাদাত হোসেন পরশ ও সাইফুল হক মোল্লা দুলু: মাঠ পর্যায়ের দুর্ধর্ষ সব জঙ্গির কাছে সে পরিচিত 'স্যার' নামে। হামলার লক্ষ্য নির্ধারণ, অর্থ সরবরাহ ও কৌশল ঠিক করাই তার মূল দায়িত্ব। এ ছাড়া অনেক হামলার আগে জঙ্গিদের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনাও দিয়ে থাকে সে। জঙ্গিদের এই 'স্যার' পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ জঙ্গি নেতা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে মোস্ট ওয়ানন্টেড এই জঙ্গির নাম।

এই হামলার মূল ছক এঁকেছিল সে। তার সঙ্গে ছিল আরও একজন জঙ্গি। তামিম শুধু ছক আঁকেনি, সে হামলার চূড়ান্ত প্রস্তুতির খোঁজখবর নিতে সশরীরে কিশোরগঞ্জে যায় এবং সেখানে মাঠ পর্যায়ের মূল কমান্ডার শরিফুল ইসলাম ওরফে সফিউল এবং আবির রহমানকে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দেয়।

তাদের 'ব্রিফিং' করে হামলার দিনও সিএনজি অটোরিকশায় শরিফুল ও আবিরকে ঘটনাস্থলের খুব কাছে নামিয়ে দিয়েছিল তামিম। আর হামলার পরপরই সে কিশোরগঞ্জ ছাড়ে। কিশোরগঞ্জের পর আরও কয়েকটি জায়গায় হামলা করতে শরিফুল ও আবিরকে বিশেষ 'অ্যাসাইনমেন্ট' দিয়েছিল তামিম।

তাদের পরবর্তী লক্ষ্য ছিল রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় বেশ কয়েকজন প্রগতিশীল ব্যক্তিকে হত্যা করা। মাঠ পর্যায়ের জঙ্গিদের কাছে তামিমের একাধিক ছদ্মনাম রয়েছে। মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একটি দায়িত্বশীল সূত্র এসব তথ্য জানায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, শোলাকিয়া হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তামিম। এই চক্র শোলাকিয়ার পর আরও কয়েকটি জায়গায় প্রগতিশীল ব্যক্তিদের ওপর হামলার টার্গেট করছিল।

গত ৭ জুলাই ঈদের নামাজ শুরুর আগে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদগাহ সংলগ্ন একটি পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালায় দুই তরুণ। এতে দুই পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল হক তপু ও আনসারুল ইসলাম নিহত হন। হামলার পর দুই জঙ্গি সবুজবাগ এলাকায় চারতলা একটি বাড়ির নিচে আশ্রয় নেয়।

এ সময় র‌্যাব-পুলিশের সঙ্গে তাদের দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে শরিফুল নামে এক জঙ্গিকে আহতাবস্থায় আটক করা হয়। আবির নামে তার আরেক সহযোগী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়।

জঙ্গি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলির সময় সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ঝর্ণা রানী ভৌমিক নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিজ বাসায় মারা যান। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কিশোরগঞ্জ শহরের তারাপাশা এলাকার আবদুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক তানিম ও শহরের বয়লা এলাকার আবদুল হাইয়ের ছেলে আহসান উল্লাহকে আটক করা হয়।

এদিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন শরিফুল র‌্যাবের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে শোলাকিয়ার হামলা ছাড়াও জঙ্গিদের পরবর্তী হামলার লক্ষ্য নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তবে গত বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কের ডাংরিবন্দ এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যায় শরিফুল ও অজ্ঞাতনামা আরেক জঙ্গি। আর শোলাকিয়ার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় তানিমকে রিমান্ডে নিয়ে এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, শোলাকিয়া ও গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় হামলার পরিকল্পনা একই সূত্রে গাঁথা। দুই হামলার পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ একই জায়গায় হয়েছে। ২৭ রমজান আকাশ নামে এক জঙ্গি শরিফুল ও আবিরের জন্য কিশোরগঞ্জে বাসা ভাড়া নেয়।

গুলশানে হামলার পরপরই তামিম চৌধুরী কিশোরগঞ্জে যায়। সেখানে তার সঙ্গে ছিল আরেক দুর্ধর্ষ জঙ্গি। তাকে মাঠ পর্যায়ের জঙ্গিরা 'মাস্টার' হিসেবে সম্বোধন করে।

'বন্দুকযুদ্ধে' মারা যাওয়ার আগে র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুল জানায়, ঘটনার দিন বাসার কাছাকাছি থেকে শরিফুল ও আবিরকে শোলাকিয়ার ঈদগাহের কাছে সিএনজি অটোরিকশায় নামিয়ে দেয় তামিম চৌধুরী। এরপর তামিম ও 'মাস্টার' শোলাকিয়ার মাঠের কাছে অবস্থান করে পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল।

হামলার পর কীভাবে তারা পালিয়ে যাবে- এ ব্যাপারে তামিম চৌধুরী তাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্র্দেশনা দিয়েছিল। তাদের হাতে দুটি ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়। ওই ব্যাগে লুঙ্গিসহ অন্যান্য পোশাক ছিল। হামলার পরপরই তারা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে লুঙ্গিসহ সাধারণ পোশাক করে মুসলি্ল সেজে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

পুলিশ চেকপোস্ট বা ঈদের জামায়াতে নয়, জঙ্গিদের প্রথম লক্ষ্য ছিল মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদের ওপর হামলা করা। তবে ফরিদের ওপর হামলা করতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা পুলিশ চেকপোস্টে হামলা করে।

তদন্তের এই পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শোলাকিয়ায় হামলার মূল পরিকল্পনাকারী তামিম ও 'মাস্টার'কে খুঁজছে। এরই মধ্যে পুলিশও জঙ্গি নেতা তামিম ও মেজর (বরখাস্ত) জিয়াকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করে।

শোলাকিয়া ঘটনায় শরিফুল র‌্যাবের হাতে আটক হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ২৮ দিন চিকিৎসাধীন ছিল। ওই সময় র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে সে জঙ্গি কার্যক্রমের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। কীভাবে বগুড়া, গাইবান্ধাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে জানিয়েছে শরিফুল।

এ ছাড়া গুলশানে হামলায় জড়িত বেশ কয়েকজন শরিফুলের চেনাজানা ছিল। একসঙ্গে তারা অস্ত্র চালানোসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। শরিফুল দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত চারটি হামলায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।

তবে মাঠ পর্যায়ের দুর্ধর্ষ জঙ্গি হওয়ায় তামিমসহ সব মূল পরিকল্পনাকারীর সঙ্গে শরিফুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোলাকিয়ার ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারীরা ধরা না পড়ায় আরও হামলার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

কিশোরগঞ্জ মডেল থানার পরিদর্শক মুর্শেদ জামান বলেন, এই মামলার তদন্তে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। তানিমও জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য দিয়েছে।-সমকাল

৭ আগস্ট, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে