বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:১১:৩৮

হঠাৎ রাজধানীতে ডেঙ্গুর রোগীর রেকর্ড

হঠাৎ রাজধানীতে ডেঙ্গুর রোগীর রেকর্ড

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : হঠাৎ করে রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে গেছে। আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু রোগে ২৯শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৮৩৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর আগে ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ ১৪৭৮ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। গবেষকরা বলছেন, অনেকে ডেঙ্গুর নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এবার নতুন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের অস্তিত্ব দেখছেন তারা। যেটি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তপাত, এমনকি জীবনহানির জন্যও দায়ী হতে পারে। চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত চারজন মারা গেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৪৬ জন ভর্তি হয়েছেন। এ মাসেই ৮৫৩ রোগী ভর্তি হন। গড়ে প্রতিদিন ২৯ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। গত প্রায় চার মাসে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮১৭ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন।

এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে ১৭২৩ জন বাসায় ফিরেছেন। বাকি ১০৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় পাঁচগুণ বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সর্বশেষ ১৫ই সেপ্টেম্বর রাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ছেলে আমান মওদুদ মারা যান। রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আমানের অবস্থার অবনতি হলে সিঙ্গাপুরে নেয়ার পথে এয়ার এম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু এবার যেহেতু সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হচ্ছে তাই মশার উপদ্রবও আছে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। জমে থাকা বৃষ্টির পানি থাকলে মশার প্রজনন বাড়ে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর এ সময়টাতে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। তাই বাড়ি বা বাড়ির আঙিনার কোথাও যেন পরিষ্কার পানি জমে না থাকে সে ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি রাখার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, একবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে আর ডেঙ্গু হয় না- ধারণাটা ঠিক নয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ভিন্ন প্রজাতি আছে। এর একটি দিয়ে সংক্রমিত হলে সেই প্রজাতির বিপরীতে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে অন্যটির মাধ্যমে সংক্রমণ হতে পারে। পরবর্তী সংক্রমণ সাধারণত আগের তুলনায় তীব্র হয়। শুরু থেকে সতর্ক থাকলে শক সিনড্রোমও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সম্পূর্ণ ভাল না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। এছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে পানি, শরবত ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তবে অ্যাসপিরিন বা ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ খাওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত: অনেকে ডেঙ্গুর নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে গবেষকরা বলছেন। এবার নতুন ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের অস্তিত্ব দেখছেন তারা। যেটি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তপাত, এমনকি জীবনহানির জন্যও দায়ী হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু গবেষণা বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. আবু নাঈম মোহাম্মদ সোহেল গত সপ্তাহে বিবিসিকে বলেন, এবার রক্তপাত সহ ডেঙ্গু হচ্ছে। এটাই হলো ভয়ের ব্যাপার। মানুষ মারা যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, চার ধরনের ভাইরাস রয়েছে ডেঙ্গুতে। কিন্তু এবার এর মধ্যে নতুন সেরোটাইপ পাওয়া যাচ্ছে আর সেটা হলো ‘‘ডেঙ্গু-১”।

চিকিৎসা সেবার বিষয়ে তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট কোন ওষুধ নেই। এটা একটা বড় সমস্যা। জ্বর হলে জ্বরের ওষুধ দিতে হবে। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন কোন পার্থক্য নেই। তিনি বলেন- এটা মূলত ম্যানেজমেন্টের বিষয়। তবে, আক্রান্ত ব্যক্তির কোন স্থান থেকে রক্তপাত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ  প্রতিবেদককে বলেন, জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। শীতের সময়ে কমে আসবে। নভেম্বর থেকে কমবে বলে তিনি আশা করেন।

তিনি বলেন, এই সময়ে জ্বর বা গায়ে ব্যথা হলে ডেঙ্গুর কথা মাথায় রাখতে হবে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর তেমন মারাত্মক রোগ নয়। তবে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম প্রাণঘাতী হতে পারে বলে জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অধ্যাপক আবদুল্লাহ বলেন, সাধারণ ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর যখন বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ রক্তপাতের প্রমাণ মেলে (যেমন মাড়ি বা নাক থেকে রক্তক্ষরণ, মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ ইত্যাদি) তখন একে  ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। অধিক রক্তক্ষরণের ফলে শরীরের জলীয় উপাদান কমে যায়। এতে রক্তচাপ কমে। এটাই ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে সুপরিচিত রমনা ও ইস্কাটন, ধানমন্ডি, কলাবাগান, গুলশান, বনানী এলাকার বাসিন্দারাই ডেঙ্গু জ্বরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত দুই/ তিন মাস থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় হঠাৎ করেই মশার প্রকোপ মারাত্মক আকারে বেড়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, ১লা জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ডেঙ্গুর উপস্থিতি তেমন থাকে না। এতে দেখা যায়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে শূন্য, মার্চে ২ জন, এপ্রিলে ৬ জন এবং মে মাসে ১০ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু মশার উপদ্রব বাড়ে জুন থেকে। সেই হিসাবে চলতি বছরের গত ১লা জুন থেকে ২৯শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই সময়ে রাজধানীসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ১৮১৭ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন।

তাদের মধ্যে জুন মাসে ২৮ জন, জুলাই মাসে ১৭১ জন, আগস্ট মাসে ৭৬৫ জন এবং চলতি মাসে ৮৫৩ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ১৭২৩ জন সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। চারজন মারা গেছেন। সেন্ট্রাল হাসপাতালে জুন মাসে একজন, এ্যাপোলো হাসপাতালে জুলাই মাসে একজন, ইউনাইটেড হাসপাতালে জুলাই  মাসে একজন ও ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে একজন রোগী মারা যান। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি আছেন ১০৮ জন।

এর মধ্যে বেসরকারি বিভিন্ন ক্লিনিকে ৫৬ জন, এ্যাপোলো হাসপাতালে নয় জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে সাত জন, মুগদা জেনারেল হাসপাতালে দুইজন, হলি ফ্যামিলিতে ১১ জন, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একজন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৬ জন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১২ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ৩ জন, ইবনে সিনা হাসপাতালে ১০ জন, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ৮ জন, বিজিবি’র পিলখানা হাসপাতালে ২ জন, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ৩ জন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১০ জন এবং শিশু হাসপাতালে ৫ জন রোগী ভর্তি আছেন।

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ন্যাশনাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. আয়েশা আক্তার মঙ্গলবার এই প্রতিবেদককে বলেন,  নতুন নতুন অনেক হাসপাতাল হওয়ায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এই সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া মানুষ সচেতন হওয়ায় এখন দ্রুতই হাসপাতালে যান। ফলে সংখ্যা বাড়ছে। তবে, উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো নয় বলে তিনি মনে করেন। সাধারণত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গু মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তবে, জুলাই ও আগস্ট মাসে বেশি থাকে। কারণ এই সময়ে বর্ষার পানি জমে। কিন্তু এবার সেপ্টেম্বরেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। পানি তিন থেকে ৫ দিন একই স্থানে স্থির থাকলে সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এ বছর বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় মশার উপদ্রব বেশি বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, এ বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চারজন রোগী মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ভর্তি হয়েছেন ৩৭৩ জন। কেউ মারা যাননি। ২০১৩ সালে ১৪৭৮ জন, ২০১২ সালে ১২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। ২০১১ সালে ১৩৬২ জন, ২০১০ সালে ৪০৯ জন। এই সালে ছয়জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে আসেন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি:  এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, আগামী ৪ঠা অক্টোবর জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে র‌্যালি করা হবে। তা নগর ভবন থেকে শুরু হবে। এরপর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছে।

তিনি জানান, আগস্ট মাসে তারা জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। এর মধ্যে রোড শো, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে ডেঙ্গুর বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেছে দক্ষিণ সিটি। সেপ্টেম্বর মাসেও দ্বিতীয় দফায় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, সদরঘাটে পোস্টার লাগানো এবং বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করা হয়েছে। একই সঙ্গে মশা নিধনে ওষুধ দেয়ার তৎপরতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।-এমজমিন
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে