জাকিয়া আহমেদ : চার বছর ধরে মা তৃপ্তি খাতুন তার সন্তানকে নিয়ে এক যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন। জন্মের পর থেকেই তাকে নিয়ে দৌঁড়াচ্ছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। যদিও আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশিরা সবাই শুরু থেকে সহযোগিতা করেছেন। কখনও ছেলেকে নিয়ে কোনও বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি তাকে। তবুও মায়ের মন বলে কথা। সেখানে বারবার কোনও এক অজানা কারণে ‘কু’চিন্তা বাসা বাঁধে। কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারেন না।
আবার, শিশুটিকে গণমাধ্যমে ‘বৃদ্ধ-শিশু’ উপাধি দেওয়ায় কিছুটা আপত্তি জানালেন সামন্ত লাল সেনসহ তার চেম্বারে থাকা বার্নের অন্য চিকিৎসকরাও। তারা বলেন, বৃদ্ধ শিশু শুনতে কেমন যেন লাগছে,আপনারা অন্য কিছু বলেন প্লিজ, এ নামে ডাকবেন না। বিরল রোগ ‘প্রোজেরিয়া’ আক্রান্ত শিশু বায়েজিদ। তারা বলেন, বায়েজিদের জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো, দোয়া করবেন যেন আবুল বাজানদারের মতো আমরা এক্ষেত্রেও সফল হই।
মাগুড়ার লাভলু সিকদার গত ৭ আগস্ট ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি করিয়েছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। জানা গেল,বায়েজিদের চিকিৎসায় ৭ আগস্ট বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে আট সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন, বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন, ঢামেকের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ, শিশু বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা, শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার, এন্ডোক্রাইনলোজী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আব্দুল জলিল আনসারী, প্যাথলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মালিহা হোসেন এবং বার্ন ইউনিটের ক্লিনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ডা. মো. সাজ্জাদ খোন্দকার।
বায়েজিদের রোগটিকে জেনেটিক ডিজঅর্ডার হিসেবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে মেডিক্যাল বোর্ড। আর সেজন্য রক্ত, এক্স-রে, কিডনি, কার্ডিয়াক, ত্বকের বায়োপসি, টিস্যু পরীক্ষাসহ প্রায় ২১ ধরনের পরীক্ষা শুরু হয়েছে ছেলেটির।ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এ ধরনের রোগী আমরা আগে আর দেখিনি।গতকাল ছেলেটি ভর্তি হবার পরই বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ,এক সপ্তাহের বাংলাদেশ সফরে আসা ব্রিটিশ প্লাস্টিক সার্জন সামরলেডসহ আমরা তাকে দেখেছি। প্রথমে ডায়াগনোসিস করার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ, আমরা এখনও জানি না তার হরমোনাল, কার্ডিয়াক বা জেনেটিক সমস্যা রয়েছে কিনা। এটুকু বলতে পারি,ছেলেটাকে যেহেতু নিয়ে এসেছে, আমাদের ‘বেস্ট পসিবল ট্রিটমেন্ট’ সে পাবে। তাকে সব ধরনের ভালো চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যা কিছু করার আমরা করবো।
এই রোগীটা বার্ন ইউনিটে কেন প্রশ্ন করলে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, এ প্রশ্ন অনেকেই করছেন। তাদের বলি, বার্নের সঙ্গে প্লাস্টিক সার্জারি বিষয়টি জড়িত। প্লাস্টিক সার্জনরাই প্রধানত বার্নের চিকিৎসা করেন জানিয়ে তিনি বলেন, মাগুড়া থেকে তাকে প্রাথমিকভাবে এখানে পাঠানো হয়েছে তার মুখমণ্ডল বদলানো (ফেস লিফটিং) যায় কিনা চিন্তা করে। এখন বিষয়টা আমরা দেখছি। যদি মনে করা হয়,এখানে এর কিছু হবে না তাহলে তাকে প্রয়োজনীয় জায়গায় ট্রান্সফার করা হবে। হতে পারে সেটা মেডিসিন বিভাগ কিংবা অন্য কোথাও। আগে পরীক্ষাগুলো হোক,তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মেডিক্যাল বোর্ড। তবে আবুল বাজানদারের মতো এই ছেলেটির বিষয়েও আমরা আমাদের বেস্ট ট্রাই করবো।
শিশুটির বাবা রং মিস্ত্রি লাভলু সিকদার বলেন, আমাদের একটাই ছেলে। চার বছরের বায়েজিদ। জন্মের পর থেকেই বাবা-মা বুঝতে পারেন তাদের সন্তানটি আর দশটি সাধারণ শিশুর মতো স্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মায়নি। শিশুটি জন্মগ্রহণ করে শরীরে ঝুলানো চামড়া নিয়ে। মাগুড়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে চিকিৎসকরা কিছু বুঝতে পারেন না। সেখানে তিনদিন থাকলাম। পরে ফরিদপুর সদর হাসপাতালে তারা যেতে বলে। সেই হাসপাতালেও থাকলাম ১০/১২ দিন। সেখানেও ডাক্তাররা কিছু বলতে পারলো না। ডাক্তাররা বললো, কিছু করার নাই, আপনারা বাড়ি চলে যান। ফিরে গেলাম মাগুড়াতে। সেখানে দীর্ঘ একবছর চিকিৎসা চললো। কিন্তু যে ডাক্তার চিকিৎসা করছিল সে একসময় মারা গেল। তারপর আবার আরেকজনের কাছে গেলাম। সেখানে ছেলের চিকিৎসা চললো কয়েকদিন,কিন্তু একসময় তারা হাল ছেড়ে দিল। বললো, এখানে কোনও ভালো চিকিৎসা নেই,ডাক্তার নেই।
লাভলু সিকদার বলেন, এই চার বছরে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি সর্বশান্ত হয়েছি। জমি বিক্রি করেছি, প্রায় ৬ লাখ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই আমার হাতে। মাগুড়াতে তখন ডাক্তার দেবাশীষ বিশ্বাসের কাছে গিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা বলি। তাকে বলি যে, চিকিৎসা করানোর মতো টাকা আর আমার কাছে নেই, কিন্তু ছেলেটার চিকিৎসাতো করাতে হবে। তখন তিনি অভয় দিয়ে বলেন, ব্যবস্থা একটা কিছু হবেই। তার কাছে গেলাম। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে যোগাযোগ করেন, আমাকে ভাড়া বাবাদ এক হাজার টাকাও দিয়েছেন।সেই টাকা দিয়েই গতকাল এখানে এসেছি। এখন ভবিষ্যতে কী হবে সেটা বলতে পারছি না।
তবে ছেলে তার একেবারেই বাবা মায়ের অনুগত জানিয়ে লাভলু সিকদার বলেন, একবার যা বলবেন, তাই। দ্বিতীয়বার তাকে কিছু বলা লাগে না।খাওয়া-গোসল সব নিজেই করে।
অনেকেই ছেলেটিকে দেখতে আসছে, তাতে শিশুটি ভয় পাচ্ছে, কান্নাও করছে। আবুল বাজানদারের মতো এই শিশুটির নিরাপত্তাও দেখা দরকার মন্তব্য করে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমরা আপনাদের মাধ্যমে অনুরোধ করছি, তাকে বিরক্ত না করার জন্য। ছোট মনে এটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।শিশুটিকে তার মতো থাকতে দিন, সে চিড়িয়াখানার কোনও চিড়িয়া নয় যে তাকে লাইন ধরে দেখতে আসতে হবে।
বৃক্ষ মানব আবুল বাজানদারের মতো এ ছেলেটির সব ধরনের খরচও সরকার বহন করবে বলে জানান সামন্ত লাল সেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বায়েজিদের এ রোগকে বলা হয়, ‘প্রোজেরিয়া’ বা ‘হাচিনসন-গিলফোর্ড প্রোজেরিয়া সিনড্রোম’। পৃথিবীতে এ রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা শতাধিক বলেই জানা যায়। -বাংলা ট্রিবিউন
০৮ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম