বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:৩১:২৯

রহস্যঘেরা খুনে তিন সন্দেহ

রহস্যঘেরা খুনে তিন সন্দেহ

এস এম আজাদ : রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে ইতালির নাগরিক সিজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। এই চাঞ্চল্যকর খুনের মোটিভ এখনো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ, র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তদন্তকারীরা অনেকটাই নিশ্চিত হয়েছেন, তাভেল্লা অন্তত ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হননি। এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। ব্যস্ত সড়কের পাশের ফুটপাতে দুই যুবক পেছন দিক থেকে রিভলবার দিয়ে তিনটি গুলি করে তাঁকে। ঘটনাস্থলের ১০ গজের মধ্যে অপেক্ষমাণ মোটরসাইকেলে আরেক যুবক অস্ত্রধারী দুই যুবককে নিয়ে পালিয়ে যায়।

ঘটনার রাতে ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ নামের জঙ্গি হুমকি পর্যবেক্ষণকারী একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়, ইসলামিক স্টেট (আইএস) ঢাকায় ইতালীয়কে হত্যার দায় স্বীকার করে বার্তা দিয়েছে। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশের গোয়েন্দারা আইএসের কথিত সেই দায় স্বীকারের ভিত্তি খুঁজে পাননি। আইএসের বার্তাটি নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

রহস্যঘেরা খুনে তিন সন্দেহ
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র প্রতিবেদককে জানিয়েছে, তাভেল্লার খুনের প্রাথমিক আলামত সংগ্রহের পরই তিনটি বিষয়কে প্রধান্য দিয়ে তদন্ত করছে বিভিন্ন সংস্থা। তদন্তকারীরা প্রথমত তাভেল্লার ব্যক্তিগত জীবনে কোনো বিরোধ আছে কি না তা খতিয়ে দেখছেন।

দ্বিতীয়ত, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ‘ষড়যন্ত্রকে’। জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইছে না। একই রকম শঙ্কা প্রকাশ করে নিজেদের নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে পশ্চিমা কয়েকটি দেশের দূতাবাস। কিন্তু এসব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে জঙ্গিদের পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো সক্রিয় হওয়ার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে কোনো মহল এক বিদেশিকে হত্যা করে দেশে জঙ্গি আছে বলে প্রমাণের চেষ্টা করছে কি না তাও খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

তৃতীয়ত, আইএসসহ জঙ্গিগোষ্ঠী এই খুনের সঙ্গে জড়িত কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার সকালে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এনজিও ইন্টারচার্চ কো-অর্ডিনেশন কমিশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন করপোরেশনের (আইসিসিও) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হেলেন ভেন দার বিক গুলশান থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আইসিসিও করপোরেশনের প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি (প্রুফ) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক ছিলেন তাভেল্লা। মামলা করলেও তাভেল্লার ব্যাপারে মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো প্রকার তথ্যই দেয়নি সংস্থার কেউ। অফিস ও বাসায় গিয়েও তাভেল্লার ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।

এদিকে মঙ্গলবারই তাভেল্লা হত্যা মামলার তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) রেজাউল হায়দারকে প্রধান করে গঠন করা হয়েছে আরেকটি তদন্ত সহায়তা দল। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনায় মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তরে একটি জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুঃখজনক। তাঁর হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি (তাভেল্লা) যে এনজিওতে কাজ করতেন সেই এনজিওর কার্যক্রম, কারো সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল কি না- এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের চারটি দলসহ অন্যান্য সংস্থা এই হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইএসের দাবি কথিত দাবি বলে মনে হচ্ছে। আইএসের সাইটে এ ধরনের কোনো স্বীকারোক্তি নেই। কাউকে আইএস সদস্য সন্দেহ হলে তাকে ধরা হয়। তারা তো দেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তার করতে পারেনি। বাংলাদেশে আইএসের কোনো কার্যক্রম নেই।

আসাদুজ্জামান খান আরো বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের নিরাপত্তার বিষয়টি কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয় বলে আমি বিশ্বাস করি। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তার পরও সব দিক খতিয়ে দেখা হবে। এ ঘটনাকে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাবে না বলে আশা করছি। এটা কোনো আইনশৃঙ্খলার অবনতির বিষয় নয়।


মঙ্গলবার দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে ভারপ্রাপ্ত আইজিপি মো. মোখলেসুর রহমানের সভাপতিত্বে এক বিশেষ সভায় তাভেল্লা হত্যার তদন্তের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ভারপ্রাপ্ত আইজিপি বলেন, এ ঘটনাটির তদন্ত আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।

তদন্তে তিন সন্দেহ : সূত্র জানায়, গুলশান বিভাগের পুলিশ, ডিবি পুলিশ, র‌্যাবসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা তাভেল্লা হত্যার ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। তবে সব সংস্থাই এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তিনটি বিষয়কে প্রধান্য দিচ্ছে। ২০১২ সালের ৫ মার্চ রাতে সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খালাফ আল আলী গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কে একইভাবে হাঁটতে গিয়ে গুলিতে নিহত হন। পরে ঘটনাটি ছিনতাইকারীদের কাজ বলে তথ্য পায় পুলিশ। তাই প্রাথমিকভাবে তাভেল্লা ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তবে হত্যার পর ঘটনাস্থলে তাঁর মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। এতে তদন্তকারীদের ধারণা পাল্টে গেছে। তাভেল্লা ঢাকায় একা বসবাস করতেন এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত ছিলেন। এসব কারণে তাভেল্লার ব্যক্তিজীবনের দিকে চোখ গোয়েন্দাদের।

দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, তাভেল্লার সঙ্গে আগে তাঁর স্ত্রী বা বান্ধবী ছিলেন। পরে তিনি একা থাকতেন। বিদেশিরা সচরাচর এভাবে একাকী জীবন যাপন করে না। তাভেল্লা প্রতিদিন সন্ধ্যায় জগিং করতে বের হতেন। তবে ফিরতেন রাত ১০টার পর। কোনো কোনো দিন মধ্যরাতে। তাই তাঁর গতিবিধির ব্যাপারেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, তাভেল্লা তাঁর অফিসে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। সেখানে বিভিন্ন প্রজেক্টের ফান্ডের অনেক টাকার কারবার। এসব নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের তাভেল্লার বাসা ও অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে দেখা গেছে।

আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার সময় এবং ধরন দেখে এটিকে রাষ্ট্রবিরোধী কোনো মহলের ‘ষড়যন্ত্র’ বলেও সন্দেহ করছেন তাঁরা। নিরাপত্তাজনিত সমস্যার ‘অজুহাতে’ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল নির্ধারিত সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসেনি। অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিনিধিদল দেশে আসার পর সোমবারই প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে। বাংলাদেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বিদেশিদের ওপর জঙ্গি হামলার শঙ্কা নেই। সফরকারী দলটি দেশে অবস্থান করার সময় কূটনৈতিক পাড়ায় এক বিদেশিকে হত্যার ঘটনা ঘটল। তাই কোনো মহল এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা শক্তিশালী বলে প্রচার করতে চাইতে পারে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, গত সোমবার রাতে হত্যাকাণ্ডের পর অনলাইনে খবর ছড়ায় আইএস এই হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এরপর গোয়েন্দারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। আইএসের হুমকিতে থাকা দেশের তালিকায় ইতালির নাম নেই। তা ছাড়া নিহত তাভেল্লা কূটনৈতিকও নন। একজন বিদেশিকে হত্যা করার লক্ষ্য থাকলে আইএস জঙ্গিরা একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যসহ ভিন্ন দেশের নাগরিককে খুন করত। ওই সব দেশের সাধারণ নাগরিকরা ঢাকার রাস্তায় একইভাবে চলাফেরা করে। এসব কারণে আইএস জঙ্গিদের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আছে গোয়েন্দাদের। তবে ঘটনাটি আইএসসহ অন্য জঙ্গিদের কাজ কি না, তাও গুরুত্ব দিয়েই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেননি গোয়েন্দারা।

সূত্র জানায়, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শীসহ অন্তত ১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি ও র‌্যাব। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে খুনিদের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। শুধু জানা গেছে, খুনিরা যুবক বয়সী ছিল। খুনিরা তাভেল্লাকে অনুসরণ করেছিল আগে থেকেই। এমনকি ঘটনাস্থলটি আগে রেকি করা হয় বলেও সন্দেহ গোয়েন্দাদের। হত্যাকাণ্ডে তিন খুনি অংশ নিলেও আশপাশে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে আরো তিনজন। গোয়েন্দারা এমন আলামত পেয়েছেন।

ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাস্থলের খুব কাছে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে খুনিদের পালিয়ে যাওয়ার ছবি পাওয়া গেছে। তবে ওই ছবি স্পষ্ট নয়। ঘটনাস্থল গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কের, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ভবনের দক্ষিণ পাশে দুটি সড়কবাতি বন্ধ ছিল। হত্যাকাণ্ডের ১০ মিনিট আগে বাতিগুলো বন্ধ হয় এবং ঘটনার প্রায় ১০ মিনিট পরে জ্বলে ওঠে। এ দুটি সড়কবাতি কত দিন, কিভাবে বন্ধ ছিল, তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

সরেজমিনে জানা গেছে, ১০-১৫ গজ ফুটপাতের মধ্যেই দুই যুবক তাভেল্লাকে অনুসরণ করে কাছে আসে এবং পেছন থেকে গুলি করে। এর খুব কাছে ৮৩ নম্বর সড়কের মাথায় একটি দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায় তারা।

ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী ভিক্ষুক সেতারা বেগম সোমবার রাতে এই প্রতিবেদককে জানান, তিনি ৮৩ নম্বর সড়কের তিন মাথায় বসে ভিক্ষা করেন। তাঁর খুব কাছে ঘটনাটি ঘটে। সেতারা বলেন, তিনডা পোলা একটা মোটরসাইকেল নিয়া অনেকক্ষণ দাঁড়ায়া আছিল। তিনজনের মধ্যে দুইজন আমার সামনে দিয়েই ৯০ নম্বর রোড দিয়া বড় রাস্তায় যাইতে থাকে। হেরপরই গুলির শব্দ শুনি। দেখি ওই দুই পোলা দৌড়াইয়া মোটরসাইকেলের কাছে আইলো। তিনজন মিলা মোটরসাইকেলে চইড়া উত্তর দিকে চইলা গেল।

জানতে চাওয়া হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (জেসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি রহস্যজনক। তবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ইতালির নাগরিক তাভেল্লা হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধান করে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে জব্দকৃত আলামত, প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য এবং গুলশান এলাকার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই চলছে। সেই সঙ্গে তাভেল্লাকে হত্যার সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে।

দায়সারা মামলা : গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে এনজিও আইসিসিওর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হেলেন ভেন দার বিক বাদী হয়ে ৩০২/৩৪ ধারায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় আসামি অজ্ঞাতপরিচয় রাখা হয়েছে। এজাহারে সন্দেহভাজন কারো নাম ও আসামির সংখ্যাও উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি তাভেল্লার বিস্তারিত পরিচয়ও নেই।

দেখা গেছে, এজাহারে হেলেন ভেন দার বিক বলেছেন, তাঁরা সোমবার রাত সোয়া ৮টায় পুলিশের ফোনে জানতে পারেন তাভেল্লা খুন হয়েছেন। ইতালির নাগরিক তাভেল্লার পাসপোর্ট নম্বর ওয়াইএ-০৪৩৮২৪১। তাঁর জন্ম তারিখ ১৩ মে, ১৯৬৪। অফিসের ঠিকানা ও পদবি ছাড়া এজাহারে আর কোনো কথাই উল্লেখ নেই। তাভেল্লার মৃত্যুর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে হেলেন ভেন দার বিক গুলশান থানায় প্রতিবেদককে বলেন, এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত। কিছু বুঝতে পারছি না। এর বেশি কিছু বলার নেই।

পরে গুলশান-১ নম্বরের ৩০ নম্বর সড়কের ১৬ নম্বর ভবনে আইসিসিওর কার্যালয়ে গিয়েও তাভেল্লার ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ভবনটির নিচে গেলে অফিসে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি সাংবাদিকদের। ভবনটির নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, প্রায় দুই বছর আগে চারতলায় ৩/এ ও ৩/বি নামের দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় আইসিসিও। ভবনের তত্ত্ববধায়ক মনিরুল ইসলাম ও নিরাপত্তাকর্মী জসিম বলেন, যাওয়া-আসার পথে তাঁরা তাভেল্লাকে দেখেছেন। তিনি অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছিলেন।

ইন্টারকমে যোগাযোগ করে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আইসিসিও করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ যোগাযোগ ও বিপণন কর্মকর্তা রাইসা চৌধুরী এই প্রতিবেদককে স্বাক্ষরবিহীন একটি লিখিত বক্তব্য দেন। সেখানে এজাহারের মতোই কয়েক লাইনে তাভেল্লা খুন হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। তাঁর বিস্তারিত পরিচয়, স্বজন, সহকর্মীদের সন্দেহ এবং কোনো তথ্য জানা আছে কি না এমন অনেক প্রশ্ন করা হলেও রাইসা তার জবাব দেন ‘নো কমেন্ট’ বলে। তিনি বলেন, ‘এসব ব্যাপারে কথা বলা যাবে না। আমাদের জানা নেই। পরে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হতে পারে।

একাকী জীবন ছিল তাভেল্লার : গুলশান-২ নম্বরের ৫৪ নম্বর সড়কের ১১/বি নম্বর বাড়ির চারতলায় বি/৫ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন তাভেল্লা। মঙ্গলবার দুপুর ও বিকেলে দুই দফায় ওই বাড়িতে গেলেও নিহতের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়নি। বাড়িটির তত্ত্বাবধায়ক মো. লাকি বলেন, এখন এ ব্যাপারে কিছুই বলা যাবে না।

তবে নিরাপত্তাকর্মী আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি এক মাস আগে এই বাসায় আসছি। স্যার (তাভেল্লা) কয়েক মাস ধরে থাকেন। আগে তাঁর ফ্যামিলি ছিল। তবে গত এক মাসে তাঁর কাছে কাউকে আসতে দেখি নাই।

আনোয়ার জানান, সোমবার বিকেল ৫টার দিকে তাভেল্লা বাসায় ফেরেন। এরপর সাড়ে ৫টার দিকে জগিং করার পোশাক পরে বেরিয়ে যান। তিনি সাধারণত রাত করে বাসায় ফিরতেন। আনোয়ার আরো জানান, সাড়ে ৯টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে কোনো দিনই তিনি তাভেল্লাকে বাসায় ফিরতে দেখেননি। বেশির ভাগ সময় তাভেল্লা বাইরে খেয়ে আসতেন। মাঝেমধ্যে অর্ডার দিয়ে বাইরে থেকে খাবার আনাতেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, তাভেল্লা গত মে মাসে আইসিসিওতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এর আগে তিনি ইতালিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামে চাকরি করতেন। কয়েক বছর আগে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। ইতালিতে তাঁর ১৬ বছরের একটি মেয়ে আছে। গত জুনে তাভেল্লার এক বান্ধবী তাঁর কাছে আসেন এবং গুলশানের বাসায় বেশ কিছুদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বিয়েবিচ্ছেদের পর জার্মান ওই নারীর সঙ্গে তাভেল্লার ঘনিষ্ঠতা হয়।

পেছন থেকে তিন গুলি : মঙ্গলবার সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাভেল্লার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এরপর তাঁর মৃতদেহটি মর্গের হিমাগারে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ আবু শামা বলেন, তাঁর শরীরে রিভলবারের তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়েছে। সবগুলোই পেছন দিক থেকে করা। একটি গুলি লেগেছে বাঁ বাহুতে। সেটি বেরিয়ে গেছে। দুটি গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকেছে। এর মধ্যে একটি বুকের দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরেকটি বুকের কাছে আটকে ছিল। ময়নাতদন্তের সময় বুকের ভেতর আটকে থাকা গুলিটি বের করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর সড়কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের ভবনের দক্ষিণ পাশের দেয়াল ঘেঁষে হাঁটার সময় সিজারে তাভেল্লা দুর্বৃত্তদের গুলিতে মারা যান।

আইএসের দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন : সিজারে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’। সোমবার সন্ধ্যায় তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের কয়েক ঘণ্টা পর রাতেই তারা প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে আইএসের (ইসলামিক স্টেট) বরাত দিয়ে কথিত একটি বার্তা পোস্ট করেছে। আরবি ভাষায় লেখা বার্তাটির স্ক্রিনশটের নিচে তারা ইংরেজিতে লিখেছে, ঢাকায় সিজারে তাভেল্লা নামের এক ইতালিয়ান নাগরিকককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস।

তাভেল্লা হত্যকাণ্ডের পর সাইট ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে বার্তাটি দ্রুত বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ বার্তার সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, সাইট ইন্টেলিজেন্সের ওয়েবসাইটে ইসলামিক স্টেটের জায়গায় লেখা রয়েছে ‘ইসলামিক স্টার্ট’। অথচ আইএস কখনোই ‘ইসলামিক স্টার্ট’ নাম ব্যবহার করে না। এ নামে কখনো দায় স্বীকারেরও নজির নেই তাদের।

সাইট ইন্টেলিজেন্সের ভাষ্য মতে, আইএসের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা অনুসরণ করে তাভেল্লাকে হত্যা করেছে। শব্দ হয় না- হত্যকাণ্ডে এমন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে এই দাবির সঙ্গে বাস্তবতা মিলছে না। কারণ ঘটনার পর একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছে, তারা অন্তত তিনটি গুলির শব্দ পেয়েছে। হত্যাকারীদের মুখে কোনো মুখোশও ছিল না। ঘটনার পর মোটরসাইকেলে চড়ে তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।

আইএসের কথিত বার্তায় ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধে অংশ নেওয়া’ দেশগুলোর নাগরিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, কোনো মুসলিম দেশেই তারা নিরাপদ থাকতে পারবে না।

পুলিশ বলছে, আইএসের হিট লিস্টে পশ্চিমা যেসব দেশের উল্লেখ রয়েছে, সেখানে ইতালির নাম নেই।  
সাইট ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশিত বার্তাটির সত্যতা মঙ্গলবার পর্যন্ত কোনো মাধ্যমই নিশ্চিত করতে পারেনি। এমনকি ইতালি কর্তৃপক্ষও বলছে, তারা এর সত্যতা যাচাই করছে।-কালের কণ্ঠ
৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে