বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬, ০৮:০২:৪৬

ব্যাট হাতে টানা ১৬ ঘন্টা ক্রিজে!

ব্যাট হাতে টানা ১৬ ঘন্টা ক্রিজে!

রাকিব হাসান : সেই টেস্টটির একটি ক্রিকেটীয় গল্প বিখ্যাত হয়ে আছে। একটি ছেলে ম্যাচের ৪ দিন ধরে গাছের ওপরে বসে খেলা দেখছিল। প্রচণ্ড গরমে হানিফের অবিশ্বাস্য ধৈর্যশীল ব্যাটিং দেখতে দেখতে ছেলেটি হঠাৎ​ গাছ থেকে ৪০ ফুট নিচে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফেরার পর ছেলেটির প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘হানিফ কি এখনো ব্যাট করছেন?’

ক্রিকেটে এখন চলছে মারকাটারি যুগ। কিন্তু কেবল ধৈর্যের গুণেই যে দলকে ম্যাচ পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, নায়কোচিত ইনিংস খেলে জাতীয় বীর হওয়া যায়, সেটাই দেখিয়েছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। ১৯৫৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে গড়েন এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। বারবাডোজে ৯৭০ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন হানিফ! যা ছিল ১৬ ঘণ্টা এবং ১১টি ফুটবল ম্যাচের দৈর্ঘ্যের চেয়েও বেশি!

১৭ জানুয়ারি শুরু হওয়া পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কনরাড হান্ট, রোহান কানহাই, এভারটন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকটের সঙ্গে ব্রিজটাউনের সেই টেস্টে ২১ বছর বয়সী গ্যারিফিল্ড সোবার্সের সমন্বয়ে গড়া ব্যাটিং লাইন আপ যেকোনো দলের জন্যই ছিল ঈর্ষণীয়। প্রথম ইনিংসে ৯ উইকেট ৫৭৯ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

তৃতীয় দিনের শুরুতে ১০৬ রানে অলআউট হয়ে যায় পাকিস্তান। ফলোঅনে পড়ে একই দিনে দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাট হাতে মাঠে নামেন প্রথম ইনিংসে ১৭ রান করা হানিফ। সঙ্গী ইমতিয়াজ আহম্মেদকে নিয়ে এবার লড়াই করেন বুক চিতিয়ে। ৪৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে যাত্রা শুরু করা এ জুটি বিচ্ছিন্ন হয় দলীয় ১৫২ রানে। ইমতিয়াজ করেন ৯১ রান।

হানিফ সেদিন শেষ করেন ৬১ রানে অপরাজিত থেকে। পাকিস্তানের সংগ্রহ ১৬২ রানে ১ উইকেটে। চতুর্থ দিন হানিফ যখন আলিমুদ্দিনকে নিয়ে মাঠে নামেন, তখনো পাকিস্তান পিছিয়ে ৩১১ রানে। চতুর্থ দিনের খেলা শেষে পাকিস্তান ম্যাচে ফিরে আসে।

২ উইকেটে ৩৩৯ রানে দিন শেষ করা পাকিস্তান তখন পিছিয়ে মাত্র ১৩৪ রানে। ১৬১ রানে অপরাজিত থেকে হানিফ সতীর্থদের লড়াইয়ে প্রেরণা জোগান। সেই প্রেরণাতেই পঞ্চম দিন শেষে পাকিস্তান পৌঁছে যায় নিরাপদ অবস্থানে। ৩ উইকেটে ৫২৫ রানে দিন শেষে করা পাকিস্তান তখন উল্টো এগিয়ে ৫২ রানে।

২৭০ রানে অপরাজিত হানিফ মোহাম্মদ যোগ্য সাহচর্য পেয়েছেন সতীর্থ ব্যাটসম্যানদের থেকেও। ইমতিয়াজের সঙ্গে ১৫২ রানের পর আলিমুদ্দিনের সঙ্গে ১১২ রান, সাঈদ আহমেদের সঙ্গে ১৫৪ রান ও বড় ভাই ওয়াজিরের সঙ্গে ১২১ রানের চারটি শতক জুটি গড়ে পাকিস্তানকে লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে থাকেন হানিফ।

ষষ্ঠ দিনের শুরুতে ম্যাচ বাঁচানোর পাশাপাশি হানিফের সামনে ছিল অনেকগুলো মাইলফলক পেরোনোর হাতছানি। ৩০০ রান করে কেবল নিজের নয় তুলে নেন এশিয়ার প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরির গৌরব। সুযোগ ছিল ১৯৩৮ সালে করা লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ড ভাঙার। কিন্তু প্রথম ইনিংসের হন্তারক অ্যাটকিনসনের বলে আলেক্সান্ডারের হাতে ক্যাচ দিয়ে হানিফ যখন প্যাভিলিয়নে ফেরেন, তখনো সেই লক্ষ্য ২৮ রান দূরে। যদিও আলোচিত এই সিরিজেরই তৃতীয় টেস্টে ৩৬৫ করে সোবার্স ভাঙেন সেই রেকর্ড।

২৩ জানুয়ারি শেষ হয় দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টার এক ম্যারাথন ইনিংস। ৯৭০ মিনিট ক্রিজে থেকে হানিফ ৩৩৭ রান করেন ৬০৩ বল খেলে। চার মেরেছেন ২৪টি। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী হানিফ ইনিংসে রানের তুলনায় সময়ের মাহাত্ম্য এতটাই বেড়ে দাঁড়ায় যে স্কোরার হানিফের ইনিংসটার সময় নির্ভুল দেখালেও বলের সংখ্যায় তারতম্য হতে পারে বলে জানান। নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে থাকা পাকিস্তান ৩১৯ ওভারে ৮ উইকেটে ৬৫৭ রান করে ইনিংস ঘোষণার গৌরবও দেখায়।

ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের করা ৩১৯ ওভারের ১১৩টি মেডেন ওভারই বুঝিয়ে দেয় হানিফের সঙ্গে সেই টেস্টে পুরো পাকিস্তানই যেন ধৈর্যের একাগ্রতায় মনোনিবেশ করেছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১১ ওভারে ২৮ রানে দিন শেষ করলে টেস্টটি ড্র হয়। জয়ের সমান এই ড্রয়ে পাকিস্তান অবশ্য উজ্জীবিত হতে পারেনি পরের টেস্টগুলোয়। যার ফল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ জেতে ৩-১ ব্যবধানে।

পাকিস্তান না পারলেও হানিফ ৩৩৭ রানের এই ইনিংস দিয়ে জয় করে নেন সবার হৃদয়। ৯৭০ মিনিটের এ ইনিংসটি এখনো টিকে আছে টেস্টের দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে, ৫৮ বছর পরও। দেশের বাইরে করা ট্রিপল সেঞ্চুরির মধ্যে এটি এখনো সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। আর এটিই এখনো একমাত্র ট্রিপল সেঞ্চুরি, যেটি খেলা হয়েছিল দলের দ্বিতীয় ইনিংসে।

হানিফ আজ চলে গেলেন। তবু রেকর্ড বইয়ের পাতায় তিনি থেকে যাবেন অমর। সুনীল গাভাস্কার এসেছেন, এর পর শচীন টেন্ডুলকারও। তবু ক্রিকেটের আদি ও আসল লিটল মাস্টার তিনিই।-প্রথম আলো
১১ আগস্ট ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এমকেএইচ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে