স্পোর্টস ডেস্ক : মাত্র ছয় দিনের মধ্যে সব কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। প্রায় এক বছর ধরে আসা একের পর এক সাফল্য যখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশটাকে আরও বড় করে তুলছিল, তখনই প্রচণ্ড ধাক্কা! নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিতের সিদ্ধান্ত সেই আকাশেই জমিয়েছে কালো মেঘ।
কাল বিকেলে যেন বিষ মাখানো ছুরির ফলা হয়ে ছুটে আসে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) ই-মেইলটি। সেখানে ভাষা খুবই স্পষ্ট, খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার কারণে এ মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফর অসম্ভব। হয়তো সৌজন্যবশতই যোগ করা হয়েছে, বিসিবির সঙ্গে আলোচনা করে সফরের নতুন সূচি ঠিক করার চেষ্টা করা হবে।
যদিও বাস্তবতা ভিন্ন। সামনে অস্ট্রেলিয়া দলের যে ব্যস্ততা তাতে অন্তত আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরের জন্য সময় বের করাটা তাদের জন্য অসম্ভবের কাছাকাছি।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কবার্তা জারির পর গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহেই বোঝা যাচ্ছিল, স্টিভ স্মিথের দল হয়তো বাংলাদেশে আসছে না।
তারপরও আইসিসি ও সিএর চেয়ারম্যান এবং দু-একটি ঘনিষ্ঠ বোর্ডের সাহায্য নিয়ে বিসিবি তাদের আনার চেষ্টা করে গেছে শেষ পর্যন্ত। কাল সব চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাওয়ার পর বোর্ড কর্মকর্তাদের মানসিক অবস্থাটা ফুটে উঠছিল তাদের চেহারাতেই।
সন্ধ্যায় গুলশানে নিজের বাসায় ডাকা সংবাদ সম্মেলনে সভাপতি নাজমুল হাসানের বলা কথায় সে শরীরী ভাষারই অনুবাদ, ‘সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ার পরও অস্ট্রেলিয়া সফরটি স্থগিত করেছে। সে জন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, ব্যথিত। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে ভালো সময় যাচ্ছিল এখন। এই সময়ে আমাদের ক্রিকেটে এ রকম একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটল!’
বিসিবি সভাপতি অবশ্য জানালেন, সিদ্ধান্তটা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নয়। অস্ট্রেলিয়া সরকারের। তবে সিদ্ধান্ত যারই হোক, সফর স্থগিতের কারণ হিসেবে নিরাপত্তার প্রশ্নটা মানতে রাজি নন তিনি, ‘আমি নিজেও নিশ্চিত নই ঠিক কী কারণে তারা সফর স্থগিত করল। শুধু তো বাংলাদেশ না, যে কয়টা দেশের তালিকা তারা করেছে সেখানে বাংলাদেশের পরই আছে ইংল্যান্ড। এরপর যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশে কি খেলা হচ্ছে না? বাংলাদেশে কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও আসল না!’ উদাহরণ টেনেছেন প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতিরও, ‘টেরর ইনডেক্সে আমরা ২৩ নম্বরে, ভারত তো ৬ নম্বরে! তাই বলে ভারতে কি খেলা হবে না? অস্ট্রেলিয়া প্রথম যে সতর্কবার্তা দিয়েছে তাতে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা একই পর্যায়ে ছিল। তাহলে ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ কোথাও খেলা হবে না? পাকিস্তানে তো হচ্ছেই না।’
সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্ব-মিছিলে বাংলাদেশের স্লোগান বরাবরই জোরালো। বোর্ড সভাপতির ভাষায়, ‘সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য বাংলাদেশ সব জায়গায় প্রশংসিত হচ্ছে।’ কিন্তু সে প্রশংসায় আপাতত কোনো লাভ হচ্ছে না। ‘অপবাদ’ মাথায় নিয়ে পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করা ছাড়া আর যে কোনো উপায় নেই! অস্ট্রেলিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বড় পরাশক্তি। স্থগিত কেন, সফর বাতিল করে দিলেও তাদের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়ানোর ক্ষমতা নেই বাংলাদেশের মতো খুদে ক্রিকেটজাতির। আশাই তাই একমাত্র ভরসা। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সফরের যে ‘আশা’র বাণী শুনিয়ে রাখছে অস্ট্রেলিয়া, আপাতত সেটাকেই বুকে আঁকড়ে ধরে সান্ত্বনার স্বপ্ন দেখছে বিসিবি।
তবে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও অস্ট্রেলয়ার এমন সিদ্ধান্ত তুলে দিয়েছে নতুন প্রশ্ন—তাহলে কোন পর্যায়ের নিরাপত্তা দিলে ক্রিকেটাররা বিদেশ সফরে নিরাপদ বোধ করবেন? তাঁদের কি রাষ্ট্রপ্রধানদের চেয়েও বেশি নিরাপত্তা দিতে হবে? নাকি এভাবেই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর হাতে চলে যাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র!
দুবাইয়ে ৮ অক্টোবর থেকে শুরু আইসিসির সভায় এ নিয়ে জোরালো প্রশ্ন তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নাজমুল হাসান, ‘সন্ত্রাসী হুমকি বা ওই সংগঠনগুলো তো আমাদের ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না! আইসিসিকে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে, ঠিক কী ধরনের নিরাপত্তা পরিকল্পনা হলে ক্রিকেট খেলোয়াড়েরা সব দেশে স্বচ্ছন্দে যেতে পারবেন এবং ক্রিকেট খেলতে পারবেন।’
তার আগে অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে বিসিবিকে। অস্ট্রেলিয়ার সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাবটা যে নেতিবাচকই হওয়ার কথা! আগামী বছরের ২২ জানুয়ারি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শুরু হবে বাংলাদেশে।
বড় দেশগুলো অস্ট্রেলিয়ার দেখিয়ে দেওয়া পথে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে তখনো। তবে বিসিবি অন্তত প্রকাশ্যে এখনই অত দূর পর্যন্ত ভাবতে রাজি নয়। ‘অস্ট্রেলিয়ার এই সতর্কতা অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত, অনন্তকালের জন্য নয়’—বলে শঙ্কাটাকে হালকা করে দিতে চাইলেন সভাপতি।
কিন্তু তাতে কি তিনি নিজেও আশ্বস্ত হতে পারছেন? মাশরাফি-সাকিব-মুশফিকদের হয়তো সামনের দিনগুলোতে অনেক চড়াই-উতরাই-ই পেরোতে হবে। গতকাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া খেলোয়াড়েরা আগামীকাল থেকে নেমে পড়ছেন জাতীয় লিগে। তাতে জাতীয় লিগের ঔজ্জ্বল্য হয়তো বাড়বে, কিন্তু কতটা উজ্জ্বল থাকবে ক্রিকেটারদের মুখগুলো? বাংলাদেশের ক্রিকেটের আকাশে জড়ো হওয়া কালো মেঘটা যে এখন অন্ধকার করে দিচ্ছে সবই!-প্রথম আলো
০২ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন