রাহুল রায় : জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ হকি দলের সাবেক অধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ জয় করে অনূর্ধ্ব-২১ চ্যালেঞ্জ কাপ। জাতীয় দলে খেলেছেন প্রায় ১০ বছর। দেশের এক সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টি এখন কী করছেন আর কীভাবেই বা কাটছে তার বর্তমান দিনগুলো। সেসব নিয়েই এ লেখা।
২০০৪ সালের শুরুর দিকেই ছিলো অনূর্ধ্ব-২১ হকি এশিয়া কাপ। ৩ মাসের ক্যাম্পের প্রায় পুরোটা সময়ই সিরিয়াসলি অনুশীলন করলাম। বিকেএসপি থেকে ঢাকায় ক্যাম্প শুরুর পর থেকেই যখন পাকিস্তানে উড়াল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার জন্য আমি ক্যাম্প প্রত্যাহার করলাম। হকি খেলোয়াড়দের ভবিষ্যত পরিণতি খুব ভালই জানা ছিল, তাই পড়াশুনায় কোন ছাড় দেওয়ার সাহস পেতাম না।
কাকতলীয়ভাবে সেই দল যেদিন ঢাকা ছাড়ছিলো বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে আমার সঙ্গে দেখা, আমি পাশের বাসেই ছিলাম। অধিনায়ক শিশু জানালার কাছে মুখ এনে আমাকে বলছিল “এখনো যাবি কি না ক”। আমি জানালা দিয়ে ই শুভকামনা জানালাম। সেদিন কষ্টই লেগেছিলো ওদের সঙ্গেতো আমার থাকার কথা ছিল।
‘যাই হোক সেই এশিয়া কাপে পাকিস্তানেই দায়িত্ব নিলেন পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় হকি তারকা কামার ইব্রাহিম। দল দেশে ফেরার কিছুদিন পরই অনূর্ধ্ব-২১ চ্যালেঞ্জ কাপ টুর্নামেন্টের ক্যাম্প। পরীক্ষার কারণে টানা ২ মাস মাঠের বাইরে থাকায় আমার ফিটনেসের অবস্থা খুবই খারাপ। প্রথম দিনের অনুশীলনেই ফিটনেসের কারণে লাল কালি পড়ে গেলো।
আমি তখনই জাতীয় দলে খেলতাম। এই দলেতো জায়গা প্রায় নিশ্চিতই ছিলো। কিন্তু কামার ইব্রাহিম এসব পাত্তাই দিতেন না। অনুশীলন ম্যাচে ২২ জনেও জায়গা হতো না। অবশেষে একদিন জায়গা হলো তবে মিডফিল্ডার নয় ফরোয়ার্ড হিসেবে। সেদিনই দুই গোল করলাম।
শেষমেশ ক্যাম্পের সর্বোচ্চ স্কোরার হলাম আমি। অবশেষে মূল স্ট্রাইকার হিসেবেই দলে জায়গা হলো। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বিকেএসপি থেকে আমরা হোটেলে উঠলাম। আমার রুমমেট দলের গোলকিপার জাহিদ।
সবসময় হাসিখুশি, ক্যাম্পেও আমাকে সবসময় বলতো “আপনি আপনার খেলা খেলেন দেখি কে বাদ দেয়”। নতুন ট্রেইনারের ফিটনেস ট্রেইনিংয়ে আমরা সুপার ফিট। আমাদের আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে। এবার একটা কিছু করবোই।
জাহিদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে মজা হতো, কলা নিয়েও সিরিয়াস কথা হতো। টুর্নামেন্ট শুরুর পর থেকেই দুর্দান্ত আমরা। তুহিন, রাজন, হাবুলরা ছিলো, আর জিমি, চয়নরা এই টুর্নামেন্টেই জানান দিয়েছিল তারা আসছে।
আফগানিস্তান, আর শ্রীলংকাকে উড়িয়ে দিলাম। গ্রুপ ম্যাচে ভারতের সঙ্গে দারুণ খেলেও ২-১ গোলে হেরে গেলাম। ভারতের সঙ্গে আমাদের বড় ব্যবধানে হারই বেশি। ফাইনালের আগে ৫ গোল দেওয়ার ঘোষণা দিলো ভারত। কিন্তু ফাইনালের আগে তো আমরাও একদম অন্যরকম। কাউকে নিয়ে ভাবছি না, আমাদের শুধু ইতিহাস গড়ার ভাবনা।
বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত দিনের পরদিন সকালে ফাইনাল। পাকিস্তানি কোচ কামার ইব্রাহিম আমাদের নিয়ে আগের দিনই খেলার ছক কষে রেখেছিলেন। মনে আছে সকালে মাঠে যাওয়ার আগে থেকেই আমরা নির্ভার আর নিশ্চুপ। চোয়ালবদ্ধ একেকজন বলে দিচ্ছিল কথা হবে মাঠে। খেলা শুরু হওয়ার পরই ভারতের সামনে নতুন বাংলাদেশ।
তাদের আক্রমণের জবাবে আমাদেরও পাল্টা আক্রমণ। ভারতও অবাক এ কোন বাংলাদেশ! জান প্রাণ দিয়ে একেকজন খেলছিলাম। পুরো টুর্নামেন্টে স্ট্রাইকার খেললেও ফাইনালের দিন একদম সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে। উপরে আর নিচে কোথাও বাদ নেই। নির্ধারিত সময়ে গোল না হওয়ায় অতিরিক্ত সময়। খেলা শেষ হওয়ার ২ মিনিট আগে মাঝমাঠে আমার ছোট একটা ভুলে ভারতের আক্রমণ আর পেনাল্টি।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, পেনাল্টি শট নিতে যখন ভারতীয় খেলোয়াড় এগোচ্ছে আমি তখন মাঝ মাঠেই হাটু গেড়ে বসে পড়েছি, আমার ল্যান্স পরা চোখ ভিজে উঠেছে, গ্যালারি থেকে যারা এতক্ষণ গলা ফাটিয়ে সমর্থন করছিল আমার নামে তাদের দুয়োধ্বনি কানে আসছিল।
বুঝলাম এত কষ্টের পরও সারা জীবন ভিলেন হয়েই থাকতে হবে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম...তাদের চিৎকারেই আবার চোখ খুললাম। দেখলাম পেনাল্টি সেভ করে দিয়েছে আমাদের গোলকিপার জাহিদ।
যেন নতুন জীবন ফিরে পেলাম। জাহিদকে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললাম “আমাকে নতুন জীবন দিলি”। টাইব্রেকারে আমারা ডাগ-আউট থেকে দেখলাম একে একে ৩টা শট ঠেকিয়ে দিলো জাহিদ। অবিশ্বাস্য! ভারতকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন।
পুরান ঢাকার ছেলে জাহিদ তার কথায়ও পুরান ঢাকার টান রয়েছে। খেলার পর সাংবাদিকরা ঘিরে ও বললো আমি কিছু করিনাই সব আল্লাহ করাইছে। সেই থেকে হকি অঙ্গনে বেশ জনপ্রিয় একটা উক্তি।
সাংবাদিকতা শুরুর পর মাঝে মাঝে জাহিদ ফোন দিয়ে বলে দাদা রিপোর্টটা ফাইন হইছে। আমিও মজা করে বলি আমি কিছু করি নাই আল্লায় করাইছে।
২০০৭ এশিয়া কাপে ভারতের সঙ্গে ৫-১ এ হারার পর ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছিল জাহিদ। জাতীয় দলের অধিনায়কও ছিলো। হকিতে ঘরোয়া লীগের দাবিতে প্রতিবারই আন্দোলন করতে হয়। একবারতো আমরা ১১ জন এক সঙ্গে জাতীয় দল থেকে পদত্যাগও করলাম।
গত বছর লীগের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে সাসপেন্ড হতে হয়েছিল জাহিদকে। ঢাকার ব্যবসা গুটিয়ে অভিমানী জাহিদ এখন সাভারের বাইপাইলে জুতার দোকান করছে। কেউ তার খোঁজও নেয় না। অনেকদিন পর ফোনে কথা হলো জাহিদের সঙ্গে।
হতাশ কণ্ঠে বললো, দাদা কি করলাম জীবনে আইলাও হইলাম না জাইলাও হইলাম না হইলাম দোকানদার। তাও ভালো আছি কারো ধারতো ধারতে হয় না।
বেশি কিছু বলতে পারলাম না শুধু বললাম ‘তুই কার কাছে কি জানি না, তবে আমার কাছে তুই সত্যিকারের একজন বীর।-চ্যানেল আই অনলাইন
৬ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে