শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬, ০৩:২৬:৪৫

‘দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি, দেশের মানুষকেও’

‘দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি, দেশের মানুষকেও’

কামরুল হাসান, দুবাই থেকে: গার্ড ভ্যান ডে ভালদেঝুঁটি করে বাঁধা চুল, চোখে সানগ্লাস। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম দেখেছিলাম ভদ্রলোককে।

বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের সঙ্গে এসেছেন। গেট দিয়ে ঢুকেই খুব ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কোনো খেলোয়াড়ের লাগেজ টানতে সাহায্য করছেন, কাউকে বোর্ডিং পাশের লাইনে দাঁড়াতে। তখনো আলাপ হয়নি। ভাবলাম দলের সঙ্গেই যেহেতু যাচ্ছেন, পরে নিশ্চয়ই পরিচয় হবে। কিন্তু বিমানে উঠে আর ভদ্রলোককে দেখলাম না।

বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলের পৃষ্ঠপোষক আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) শারীরিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন প্রকল্পের সহকারী ব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান দলের সঙ্গেই ছিলেন। দুবাইয়ে নেমে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঝুঁটি বাঁধা চুলে এক ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁকে দেখছি না যে?’

‘গার্ড ভ্যান ডে ভালদের কথা বলছেন? ও তো দুদিন পরে আসবে।’

‘তাহলে ঢাকা বিমানবন্দরে দেখলাম যে!’

‘খেলোয়াড়দের বিদায় দিতে এসেছিল। ও এই খেলোয়াড়দের খুব ভালোবাসে। ওরা ঠিকঠাক মতো যেতে পারল কি না, সেটা দেখতে এসেছিল।’

মুগ্ধ হলাম অচেনা সেই ভদ্রলোকের আন্তরিকতায়। ওই মুগ্ধতাই পরিচয়ের আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না অবশ্য। দুদিন পরেই হোটেলের ডিনার টেবিলে দেখা। যথারীতি সব খেলোয়াড়দের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সবাই খেতে পারছে কি না, কারও রুমে কোনো সমস্যা আছে কি না—এই সব।

পরিচয় হলো। বেলজিয়ামের নাগরিক গার্ড ভ্যান ডে ভালদে বাংলাদেশে আইসিআরসির শারীরিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন প্রকল্পের ব্যবস্থাপক। ভিজিটিং কার্ডের এই পরিচয়টা অবশ্য তিনিই বাতিল করে দিয়ে বললেন, তাঁর পরিচয়—‘বাংলাদেশের শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বন্ধু’। বছর তিনেক হলো বাংলাদেশে কাজ করছেন। বাংলাদেশ শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলটা গড়ে তোলার পেছনে তাঁর বড় ভূমিকা।

আইসিআরসির পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মূল ভাবনাটা হচ্ছে, এ দেশের প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও ‘আমরাও পারি’ মানসিকতা তৈরি করা। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শারীরিক প্রতিবন্ধীরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। নিজেদের প্রকাশ করতেও সংকোচ যেন তাঁদের। গার্ড ভ্যান ডে ভালদে ভাবলেন এদের কীভাবে সেই প্রকাশের সুযোগ দেওয়া যায়। শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল করার ধারণাটা তখনই এল।

ক্রিকেট এখন এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। সবারই আগ্রহ আছে। প্রতিবন্ধীদের সেই আগ্রহটা যদি জাগিয়ে তোলা যায়, তাহলে হয়তো অনেকেই বেরিয়ে আসবে। সাড়াও পেলেন যথেষ্ট। গত বছর শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দল গঠনের জন্য প্রথম প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে প্রায় দেড় শ শারীরিক প্রতিবন্ধী এলেন। ওদের মধ্যে থেকেই দল গঠন করা হলো।

এরপর মূলত আইসিআরসির উদ্যোগেই গত বছর প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হয়ে গেল। যেখানে বাংলাদেশ ছাড়া অংশ নিয়েছে ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তান দল। এবার দুবাইতে হচ্ছে সেটারই দ্বিতীয় আসর। এবার আইসিসিও বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত।

কাজ করতে গিয়েই বাংলাদেশ দলটার সঙ্গে আরও বেশি জড়িয়ে গেছেন গার্ড। নিজেই বললেন, ‘আমি ওদের বন্ধু হয়ে গেছি। সত্যি বলতে ওরাই আমার মধ্যে ক্রিকেট প্রেম জাগিয়ে তুলেছে। জানোই তো বেলজিয়ানরা ক্রিকেটের সঙ্গে মোটেও পরিচিত নয়। কিন্তু এখন আমিও ক্রিকেট বুঝতে শুরু করেছি।’

ইংল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচটা হেরে যাওয়ার পর খেলোয়াড়দের মন খারাপ। গার্ড সবাইকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন একটু পর পর, ‘কিছু হয়নি এক হারে। আরও ম্যাচ বাকি। তোমরা পারবে। মন খারাপ কোরো না।’

বললেন বাংলাদেশের এই প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলটা নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথাও, ‘তোমাদের ক্রিকেট বোর্ড যদি কিছুটা সাহায্য করে, এরা কিন্তু অনেক দূর যাবে। বিশ্বের অন্য দলগুলোকে নিয়মিত হারানোর সামর্থ্য আছে এদের।’

২৫ বছর ধরে আইসিআরসিতে কাজ করছেন। ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ আরও অনেকে দেশে কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রকল্পে। কিন্তু এ দেশের মানুষের আন্তরিকতা আর সরলতায় মুগ্ধ এ বেলজিয়ান। সেই মুগ্ধতা জানিয়েই বললেন, ‘এখানকার মানুষ এত সহজে সবাইকে আপন করে নেয়! ভিনদেশে এমন আন্তরিকতা খুব কম মেলে।’

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার কারণে এখন অনেক বিদেশিরাই বাংলাদেশে কিছুটা অনিরাপদ বোধ করেন। গার্ডের পরিচিত অনেকেই চলে গেছেন।

‘তোমার অনিরাপদ লাগে?’ প্রশ্ন করতেই গার্ড হেসে দিল, ‘এখন পৃথিবীর কোনো জায়গাটা পুরো নিরাপদ বলো? আর তোমাকে বললাম না, আমি এর চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক জায়গাতেও কাজ করেছি।’

আগামী বছর এ দেশে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে গার্ডের। তারপর অন্য কোথাও। প্রশ্ন করলাম, ‘তোমাকে যদি আবার বলা হয় এ দেশে ফিরে এসে কাজ করতে, করবে?’

এতক্ষণ কথা বলার পর উত্তরটা অনুমিতই হয়ে গিয়েছে। তবু গার্ডের মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হলো। ৪৯ বছর বয়সী বেলজিয়ান মুখে হাসি এঁকে বললেন, ‘সানন্দে। আমি এ দেশটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এ দেশের মানুষকেও।’-প্রথম আলো
২১ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে