স্পোর্টস ডেস্ক : তৃতীয় দিন সকালের দ্বিতীয় বলে ওই রকম ‘হারিকিরি’র পর চন্দিকা হাতুরাসিংহের সংসারে প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার কথা সাকিব আল হাসানের। নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান হলে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে আউট হওয়ার দায়ে চড়া মাসুল গুনতে হতো তাঁকে। কিন্তু বল হাতে ৫ উইকেট নিয়ে সেই রাতে অনেকটা নির্ভার হয়ে নিদ্রায় গেছেন তিনি। ক্যারিয়ারজুড়ে এমন বহুবার ব্যাটিংয়ের ঘাটতি বোলিংয়ে নয়তো বোলিংয়ের কমতি ব্যাটে পুষিয়ে দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের দীর্ঘকালীন পোস্টার বয় সাকিব।
দৃশ্যকল্পটা অবিকল রেখে শুধু চরিত্রটা পাল্টে দিলে কেমন হয়? মিড অন আর মিড অফ ওপরে তুলে মঈন আলী ওভারের দ্বিতীয় বলটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তামিম ইকবাল, ইমরুল কায়েস, মমিনুল হক কিংবা অন্য কোনো স্বীকৃত ব্যাটসম্যান তেড়েফুঁড়ে গেলেন সাকিবের মতো এবং স্টাম্পড! না, তামিম-ইমরুল কিংবা অন্য কেউই ওই অবস্থায় ভুল করেও এমন শট খেলার দুঃসাহস দেখাতেন না। দলে মিডিয়া কারফিউ জারি হওয়ায় প্রকাশ্যে কেউ মন্তব্য দিতে নারাজ। তবে অনানুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ওই রকম পরিস্থিতিতে ব্যাটসম্যানদের ‘ডাউন দ্য উইকেট’ খেলার আপাত অনীহা আসলে আশঙ্কা থেকে। আশঙ্কাটা হলো, ব্যাটিংয়ের ব্যর্থতা আড়াল করার বিকল্প উপায় নেই, বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যানদের ‘জীবন’তো একটাই, সাকিবের মতো তিনটা নয়!
তিনটা কিভাবে? অলরাউন্ডারের সংজ্ঞাতেই রয়েছে এর উত্তর। ব্যাটে ৩০-৪০ না হলে বোলিংয়ে ২-৩ উইকেট মিলে যায় সাকিবের। একেবারে অনন্যোপায় দিনে দুটা ক্যাচ, একটা রান আউট দিয়ে পার পাওয়া ম্যাচও আছে তাঁর ক্যারিয়ারে। একমাত্র ব্যতিক্রম আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডের পর নাকি ভারাক্রান্ত ছিলেন তিনি, তিন বিভাগেই যে সেদিন ব্যর্থ তিনি। তবে অলরাউন্ডারের জীবনে এমন দিন হাতে গোনা। আফগানিস্তান সিরিজের পর দেওয়া সাকিবের নিজের ভাষ্যে, ‘এমনটা জীবনে কোনো দিন হয়নি।’
তামিম-ইমরুল কিংবা মমিনুল হকের ক্যারিয়ারে এমন বিলাসিতার সুযোগ নেই। ভালো একটা বলে কিংবা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে আউট হলেও শতভাগ নিরাপদ নন তাঁদের কেউই। সে উইকেট ব্যাটসম্যানদের জন্য যতই শ্বাপদসংকুল হোক না কেন। মমিনুলের কথাই ধরুন। চট্টগ্রাম টেস্টের আগে অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম থেকে শুরু করে সবাই ১৫ মাসের বিরতি নিয়ে হা-পিত্যেশ করছিলেন। তাঁরা তবু সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটে টানা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যেই ছিলেন। সেখানে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে ব্রাত্য মমিনুলের অবস্থাটা ভাবুন। চট্টগ্রামের কঠিন উইকেটে শূন্য আর ২৭, এরপর ঢাকা টেস্টেও ব্যাটে রান না ছুটলে ‘স্ট্যাটাসবিদ্ধ’ হবেন তিনি। মমিনুলের পঞ্চাশের ওপর টেস্ট গড়ও বিস্মৃত হতে সময় লাগবে না এ দেশে।
তাই স্বপ্নভঙ্গের বেদনার সঙ্গে আতঙ্কের মেঘ নিয়েই যেন চট্টগ্রাম থেকে ফিরেছেন ব্যাটসম্যানরা। উইকেট ‘সুপার হিট’ করে যাওয়ায় সবাই ধরেই নিয়েছেন মিরপুরে অবিকল উইকেট তৈরির জোর প্রচেষ্টা চলবে। তবে মাটির ভিন্নতার কারণে চট্টগ্রামের ‘লুক অ্যালাইক’ ঢাকায় সম্ভব নয়। তবে ইংল্যান্ডকে বিপাকে ফেলতে গিয়ে যে মডেল ধরে উইকেট তৈরি হচ্ছে, সেটিতে বল একটু বেশি ‘ড্রিফট’ করবে, ঝুঁকি আরো বাড়বে ব্যাটসম্যানদের।
টিম স্ট্র্যাটেজির বাইরে অবশ্য যাওয়ার উপায় নেই কারোর। উইকেট যত অননুমেয় হবে, ততই ব্যবধান কমবে দুই দলের শক্তির। সমান শক্তির দলের বিপক্ষে হার-জিতের সম্ভাবনাও একই সমতলে, তাই সেই পন্থাই নিচ্ছে বাংলাদেশ দল। চট্টগ্রাম সাফল্যের পর তামিম ইকবালের কথা শুনে মনে হচ্ছে এ চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছেনও ব্যাটসম্যানরা, ‘এমন উইকেটে রান করার তৃপ্তিটাই অন্য রকম। কখনোই মনে হবে না যে আপনি সেট হয়ে গেছেন।’ তবে এ আত্মতৃপ্তির জন্য মনের ওপর দিয়ে বিস্তর ধকলও গেছে ব্যাটসম্যানদের। প্রতিটা বলের সামনে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়ার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন তামিম, ‘পাঁচ দিনের ক্রিকেট শরীর ও মনের ওপর চাপ ফেলে। চট্টগ্রাম টেস্টে চাপ বেশি গেছে মনের ওপর দিয়ে। বল পড়ে কী আচরণ করবে জানি না, প্রতিটা বলের ওপর সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে খেলতে হয়েছে। এতে করে মনের ওপরও অনেক স্ট্রেস গেছে।’
মৌসুম শুরুর আগে লম্বা ফিটনেস ক্যাম্প থেকে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার টনিক পেয়েছেন মুশফিকরা। ‘টিম টক’ থেকে মানসিক ক্লান্তিও ঝরিয়ে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের পর ঢাকা টেস্টেও ব্যাটসম্যানদের ‘জীবনে’র ঝুঁকি কমার কোনো লক্ষণ নেই। টেস্ট জিততে হলে প্রতিপক্ষের ২০ উইকেট নিতে হয়, চট্টগ্রামে সেটা নিয়েছেনও বোলাররা। তবে মাঝখানে দলের ব্যাটিংটাই বেশি আনন্দ দিয়েছে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। সেটা দুর্গম উইকেটে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে। ম্যাচে সাব্বির রহমানের ব্যাটিংয়ের অংশটাই সবচেয়ে ভালো লেগেছে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে অধিনায়কের।
বাংলাদেশ দলের ঘরোয়া আড্ডায় ব্যাটসম্যান বনাম বোলার টিকা-টিপ্পনী চলে খুব। ঘরের মাঠে ব্যাটসম্যানদের কথা ভেবেই উইকেট তৈরি হয়- এমন দাবি করেন বোলাররা। আবার পাল্টা আসে ব্যাটসম্যানদের পক্ষ থেকেও, বোলাররা, বিশেষ করে স্পিনাররা বাড়তি সুবিধা পান হোম সিরিজে। সেসব আড্ডায় প্রত্যাশিতভাবেই জোরালো অংশগ্রহণ থাকে মাশরাফির। সে তিনিই মুগ্ধ চট্টগ্রাম টেস্টে সাব্বির রহমানের ব্যাটিংয়ে। মেহেদী হাসান আর সাকিবের বোলিংয়ের প্রশংসাও করেছেন, তবে মাশরাফির ‘এক নম্বর’ সাব্বির। সেটা চট্টগ্রামের উইকেটে জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়ার স্বীকৃতি।
মিরপুরেও কি পারবেন ব্যাটসম্যানরা সংগ্রামী ইনিংস খেলতে? যদিও তাঁদের ‘জীবন’ একটাই, বড্ড ঝুঁকিপূর্ণও।-কালেরকন্ঠ
২৬ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর