মঙ্গলবার, ০৮ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:১১:০২

দুই ‘ম’: বাংলাদেশের জ্বলে ওঠার আসল রহস্য

দুই ‘ম’: বাংলাদেশের জ্বলে ওঠার আসল রহস্য

সাম্য দাশগুপ্ত: যখন অন্য কেউ আপনার উপর বিশ্বাস রাখে না, তখন আপনার নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। সেটা করতে পারলে আপনি ওই মুহূর্তেই  জয়ী হয়ে  যাবেন। - ভেনাস উইলিয়ামস।

আত্মবিশ্বাস। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস তো জরুরীই, তবে দলগত খেলায় শুধু নিজের উপর বিশ্বাসই না, সতীর্থদের উপরেও আপনার বিশ্বাস রাখতে হবে।

আমি মনে করি এই একটা জিনিস প্রায় সমশক্তির দুটো দলের মধ্যে ব্যবধান গড়ে দেয়। কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে উৎপল চ্যাটার্জী বলেছিলেন,  ‘বোম্বে বিশ্বাস করত তারাই সেরা, আর বাংলা সর্বদা তাদের কাছে মাথা নিচু করে রেখেছে।’ ৮২ বারের মধ্যে ৪১ বারই রঞ্জি ট্রফি জয়, বোম্বের আত্মবিশ্বাস টলাতে পারে এমন সাধ্য কার আছে!

আত্মবিশ্বাস- কদিন আগে পর্যন্তও এই জিনিসটা বাংলাদেশ দলের মধ্যে ছিল না। এখন তারা সেটা অর্জন করতে শুরু করেছে।

কিন্তু ঠিক কিভাবে হঠাৎ করে একটা দল আত্মবিশ্বাস পেতে শুরু করে?

আমি এখানে কয়েকটা ফ্যাক্টরের কথা বলব।

১) ফলাফল: আপনি যখন জিততে শুরু করবেন, তখন এমনিতেই  আপনার মাঝে বিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করবে। ২) দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি: মাঠে তো সকলের দায়িত্ব থাকেই, তবে মাঠের বাইরেও দায়িত্ব পালনের মত কাউকে থাকতে হয়।

৩) সমর্থন: যখন অধিক মানুষ আপনাকে সমর্থন দিবে, তখন ভাল কিছু হতেই  পারে।

 আর ৪) ব্যক্তিত্ব: খেলোয়াড়েরা যখন অতীত ইতিহাস দেখে বিচলিত হয়না, প্রতিপক্ষের নামের ভার না দেখে ভয়ডরহীনভাবে খেলে, তখন ভাল কিছু হতে বাধ্য।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে '১' নম্বরটা গত দুই মৌসুম ধরে হয়ে আসছে। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে এই  সময়ে  তারা অনেক সাফল্য পেয়েছে। যদিও বেশিরভাগটাই  মিরপুরে, কিন্তু তারপরেও সাফল্য তো এসেছে। '২' নম্বরটার জন্য চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে কৃতিত্ব দিতেই  হবে (যদিও আমার অনেক বাংলাদেশি সাংবাদিক বন্ধু তাকে অতটা কৃতিত্ব দিতে রাজি না)। ২০১৪ সালের মে তে তিনি বাংলাদেশ দলের সাথে যোগদান করেন। আর ১ বছরের মধ্যেই  বাংলাদেশ সাফল্য পেতে শুরু করে। এরকম সাফল্যের পেছনে কোচের কতটা অবদান সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ, কিন্তু নতুন কারোর আগমনের সাথে যদি সাফল্যের টাইমিং এমনভাবে মিলে যায়, তখন কিছুটা কৃতিত্ব তো তাকে দিতেই  হয়!

৩ নম্বরটারও অভাব নেই  বাংলাদেশে। বাংলাদেশের প্রধান খেলায় পরিণত হয়েছে এখন ক্রিকেট। সে কারণে সমর্থনেরও অভাব হয়না বাংলাদেশের। আর ৪ নম্বরটার কথা বললেই আমার মাথায় আসে মুস্তাফিজুর রহমান আর মেহেদি হাসান মিরাজের নাম।

এই ৪ নম্বর পয়েন্টটাই এখানে 'কী ফ্যাক্টর'। তামিম ইকবাল তাঁর ড্যাশিং ব্যাটসম্যানের তকমা থেকে বেরিয়ে এসে খুব সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসেরই সেরা ব্যাটসম্যানে পরিণত হয়েছে। সাকিব আল হাসান বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অলরাউন্ড সত্ত্বা দেখিয়ে চলেছেন। মাশরাফি মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, সাব্বির রহমান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদরাও সাম্প্রতিক সময়ে দারুণ পারফর্ম করে চলেছেন।

কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের আলোকবর্তিকা বহন করে চলেছেন দুজন। প্রথমে মুস্তাফিজুর রহমান, আর পরে মেহেদি হাসান। মুস্তাফিজুর রহমানের  হুট করে উঠে এসে আন্তর্জাতিক তারকায় পরিণত হয়ে যাওয়ার কাহিনী আজ সবাই জানে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের ৫০ ওভারের ক্রিকেটের সাফল্যের অন্যতম রূপকার মুস্তাফিজ। কাঁধের ইনজুরি না থারকলে এই টেস্ট সিরিজেও নিশ্চিতভাবেই  ভূমিকা রাখতেন তিনি।

সবসময় যে  মুস্তাফিজ নিজেই  সব করেছেন, সেটা না। কিন্তু তিনি পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে, প্রতিপক্ষের যোগ্যতা ও সুনামের প্রতি নজর না দিয়ে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নিজের খেলাটা না বদলে মুস্তাফিজ একটা বিপ্লবই  ঘটিয়ে দিয়েছেন।

মুস্তাফিজের পর এবার এসেছেন মেহেদি, মিরাজ নামেই যিনি বেশি পরিচিত।  অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ চলাকালে আমার কলিগ সিদ্ধান্ত পট্টনায়েক লিখেছিলেন, ‘ব্যাটে, বলে, অধিনায়কত্বে মিরাজ ঠান্ডা মাথায় যেভাবে পারফর্ম করেছে, সেটাই প্রমাণ করে যে তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া।’ মিরাজ তাঁর টিমকে সেমিফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তারা চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে গেছিল।

তখন মিরাজের বয়স ছিল ১৮, ইংল্যান্ড সিরিজ চলাকালেই ১৯ এ পা দিল। দুই টেস্টেই সে অচিন্ত্যনীয় পারফর্ম করেছে। ৮০ রানে ৬ উইকেট, ৫৮ রানে ১ উইকেট, ৮২ রানে ৬ উইকেট, ৭৭ রানে ৬ উইকেট এই বোলিং দিয়ে  ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের বেঁধে ফেলেছিল সে। মুস্তাফিজের মতই সে ভয় ছাড়া খেলেছে, ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের সামর্থ্যের কথা চিন্তা না করেই  খেলেছে।

এবং মুস্তাফিজুরের মতই  মিরাজ তার শক্তির জায়গাতেই অটল থেকেছে। মিরাজ নিজেই  বলেছে, ' আমি সবসময় এভারেজ পারফর্ম করার চেষ্টা করি, যেটা আমি ২য় টেস্টেও করার চেষ্টা করেছি।' ঢাকা টেস্ট শেষে মুশফিকুর বলেছেন, 'বাংলাদেশ এমন পিচ তৈরি করেছে যাতে আমাদের স্পিনারদের সুবিধা হয় ও ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের অসুবিধা হয়।' অ্যালিস্টার কুক আবার এর পেছনে এই  ধরণের কন্ডিশনে নিজেদের অনভিজ্ঞতাকেই  দায়ী করেছেন।

সবকয়টাই সত্য। মিরাজ বিশ্বের সব জায়গায় সমান সফল হবে না, এমনকি সামনের বছর বাংলাদেশ যখন বর্ডার পেরিয়ে ভারতে খেলতে আসবে, তখনও সে সমান সফল নাও হতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, জেমস অ্যান্ডারসন ও স্টুয়ার্ট ব্রডও ইংল্যান্ডের বাইরে অতটা ভয়ংকর নন। দুই টেস্ট থেকে যখন ২০ টেস্ট খেলে ফেলবে, মিরাজের ১৫.৬৩ গড়ও তখন আসতে আসতে বেড়ে মধ্য ২০ এর ঘরে চলে যাবে। ক্রিকেটে এভাবেই  চলে।

কিন্তু, এখনকার জন্য হলেও মিরাজ বাংলাদেশকে সঠিক পথটা দেখিয়ে দিয়েছে, যেমনটা ওয়ানডেতে দেখিয়েছে মুস্তাফিজ। আমার মনে হয়না বাংলাদেশ ২০১৬ এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলতে পারত যদি না তারা ৫০ ওভারের ক্রিকেটে এত ভাল পারফর্ম না করত।

বাংলাদেশের টেস্ট ক্যারিয়ার এখন ১৬ বছর বয়স্ক। এখন শুধু মিরপুরে হলেও আসতে আসতে তারা ভাল খেলতে শুরু করেছে। আসতে আসতে তারা সব জায়গাতেই ভাল খেলতে  শুরু করবে। এবং যদি আমি ভুল না হই, এই  দুই  তরুণ খেলোয়াড় তাদের সিনিয়রদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, যেমনটা আমরা দেখতে শুরু করেছি।-খেলাধুলা
৮ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে