রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬, ০২:০৫:১২

সাকিবকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন ‘ক্রিকেট ভক্ত’ হুমায়ূন আহমেদ

সাকিবকে একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন ‘ক্রিকেট ভক্ত’  হুমায়ূন আহমেদ

নিউজ ডেস্ক: বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ কেবল জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না; খুব ভক্ত ছিলেন খেলার। মূলত ফুটবলভক্ত মানুষ। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে উত্থান তাকে মোহিত করেছিলো। এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, সাকিব আল হাসানকে একটি বইও উৎসর্গ করেছিলেন।

 খেলাধুলা নিয়ে অনেক লিখেছেন কিংবদন্তী এই সাহিত্যিক। তার জন্মদিনে তারই লেখা বাংলাদেশে ২০১১ বিশ্বকাপ উপলক্ষে একটি অসামান্য রচনা তুলে দেওয়া হলো। লেখাটি নেওয়া হয়েছে তার ‘আত্মজৈবনিক রচনাসমগ্র’ থেকে

অদ্ভুত এক বসন্ত এসেছে বাংলাদেশে। বসন্তের এই রূপ রবীন্দ্রনাথ জানতেন না।

‘বিশ্বকাপ ক্রিকেট বসন্ত’ তাঁর সময়ে ছিল না। আচ্ছা, ধরা যাক তিনি এই সময়ে বাস করছেন, তাহলে কী করতেন? নিশ্চয়ই ক্রিকেট বোর্ড বিশেষ ভিআইপি এসি বক্সে তাঁকে মাঠে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা করত। তিনি আধশোয়া হয়ে বসতেন আরাম কেদারায়।

কবি নজরুল এসবের ধার ধারেন না। তিনি বসতেন গ্যালারিতে। বল আকাশপথে বাউন্ডারির বাইরে গেলে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতেন, ছক্কা! ছক্কা! বিশ্বকাপের থিম সং লেখার এবং তাতে সুর দেওয়ার দায়িত্ব কবি নজরুল আগ্রহ নিয়ে নিতেন বলে আমার ধারণা। ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ জাতীয় লাইন সেই থিম সং-এ থাকত।

জয়ধ্বনি করার জন্য আমরা প্রস্তুত। প্রথম খেলায় ভারতীয়রা যখন চার মারবে বা ছক্কা মারবে, আমরা জয়ধ্বনি করব। আমরা যখন চার বা ছক্কা মারব, তখন যা করার তার নাম ‘হুংকার’। জয়ধ্বনিতে আমাদের পোষাবে না।

প্রাচীন রোমের কলোসিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ হতো। মরণপণ সেই যুদ্ধ দেখে আনন্দে আধপাগল হতো রোমের জনগণ এবং রোমসম্রাট। এখন আমাদের সময় আমরা গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ দেখব। বিজয়ী গ্ল্যাডিয়েটরদের উল্লাস এবং পরাজিতদের মানসিক মৃত্যু দেখে রোমের মানুষদের মতোই আনন্দে আত্মহারা হব।

কত না নাটক হবে খেলায়! নিশ্চিত ক্যাচ শেষ মুহূর্তে হাত থেকে ফসকে পড়ে যাবে। আম্পায়ার ভুল এলবিডব্লিউ দেবেন; হতাশ ও দুঃখী চোখে ব্যাটসম্যান তাকিয়ে থাকবেন আম্পায়ারের দিকে। বোঝাপড়ার অভাবে দুই ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন এবং...।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জন্য ক্রিকেটাররা নানান ধরনের প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে যান। আমরা যারা খেলব না, দেখব, তাদেরও নানান প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনার ভেতর দিয়ে প্রস্তুতির শুরু। ভাগ্যবতী যেসব তরুণী টিকিট পেয়ে গেছে, তাদের দ্বিতীয় দফার প্রস্তুতি—পোশাক কোনটা পরা হবে, কী রং হবে সেই পোশাকের; গালে বাংলাদেশের পতাকার ছবি থাকবে নাকি শহীদ মিনারের ছবি থাকবে।

যাঁরা টিকিট পাননি, ঘরে বসে খেলা দেখবেন, তাঁদেরও কিন্তু প্রস্তুতি আছে। আমার নিজের কথা বলি। শোবার ঘর থেকে বড় টিভি নিয়ে আসা হয়েছে ড্রয়িংরুমে। বন্ধুবান্ধব সবাই একসঙ্গে বসে খেলা দেখবে। অনেক জায়গা দরকার। সোফা সরিয়ে ড্রয়িংরুম খালি করা হয়েছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলেও যেন খেলা দেখতে পারি, তার জন্য জেনারেটর থেকে আলাদা লাইন নেওয়া হয়েছে। স্ন্যাকস ও খাবারদাবারের দায়িত্ব এক বন্ধু নিয়েছেন। বাঘের ছবি আঁকা কেকের অর্ডার দিয়ে রাখা হয়েছে। কেকের লেখাটা ইন্টারেস্টিং, ‘সাবাস বাংলাদেশ’-এর জায়গায় লেখা থাকবে ‘সাবাশ বাংলাদেশ’। যদি গত বিশ্বকাপের মতো প্রথম খেলাতে জিতে যাই! এত রাতে কোথায় কেক পাব?

কেমন খেলবে আমাদের ছেলেরা? প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে যতটা ভালো খেলা যায়, ততটাই খেলবে। আমরা যারা খেলছি না, শুধুই দর্শক, তারাই প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছি। ওরা থাকবে না? তবে আমাদের ছেলেরা ভালো খেলুক বা খারাপ খেলুক, আমরা আছি তাদের সঙ্গে; ভবিষ্যতেও থাকব।

ক্রিকেট খেলা নিয়ে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা দিয়ে লেখা শেষ করি। আমি দলবল নিয়ে গেছি সুইজারল্যান্ড। টেলিফিল্মের শুটিং। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের ওয়ানডে ম্যাচ পড়ে গেল। আগে একবার অস্ট্রেলিয়া আমাদের কাছে হেরেছে। এবারও হয়তো হারবে। এই খেলাটা দেখতেই হবে। সমস্যা হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে কেউ ক্রিকেট দেখে না, সবাই দেখে ফুটবল। চ্যানেল আইয়ের হাসানকে বললাম, তুমি তো অসাধ্য সাধন করতে পারো। আমাকে খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দাও।

হাসান বিশাল বাস ভাড়া করল। আমরা বাসে চড়ে রওনা হলাম জুরিখে। এখানে অনেক বাংলাদেশি পরিবার আছে। তাদের বাসায় নিশ্চয়ই ক্রিকেট দেখার ব্যবস্থা থাকবে। কোথাও সে রকম পাওয়া গেল না। একজন সন্ধান দিল অস্ট্রেলিয়ান একটা পাব আছে, সেখানে হয়তো ক্রিকেটের চ্যানেল আছে। আমরা দল বেঁধে সেখানে উপস্থিত হলাম। এখানেও চলছে ফুটবল। পাবের মালিককে হাসান বলল, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমরা ক্রিকেটে ওয়ানডেতে তোমাদের হারিয়েছি। আজ আবার হারাব। আমাদের খেলা দেখার ব্যবস্থা করে দাও।

পাবের মালিক ব্যবস্থা করল এবং আমাদের সঙ্গে নিজেও খেলা দেখতে বসল। প্রথম ব্যাটিং বাংলাদেশের। একের পর এক ব্যাটসম্যান আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছে। এই খেলা দেখা মানে হূদয়ে রক্তক্ষরণ। আমরা উঠে দাঁড়ালাম। পাবের মালিক বক্র হাসি হেসে বলল, তোমরা কি জিতেছ?

আমি বললাম, ইয়েস।

দলের সবাই আমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলল, ইয়েস।

আমরা বীরদর্পে পাব ছেড়ে বের হলাম। পাব মালিক তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে।

বিশ্বক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞে আজ আমাদের সবার নিমন্ত্রণ। নগরী সেজেছে নতুন সাজে। তার পালে লেগেছে ক্রিকেট বসন্তের হাওয়া। চারদিকে কত না আনন্দ! বিশ্বক্রিকেটের আনন্দযজ্ঞে আজ আমাদের সবার নিমন্ত্রণ।

‘এত ফুল ফোটে

এত বাঁশি বাজে

এত পাখি গায়

আহা, আজি এ বসন্তে।’
১৩ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে