বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:৩৪:২৬

সাদিয়া কি হারিয়েই যাবেন?

সাদিয়া কি হারিয়েই যাবেন?

মাসুদ আলম, চট্টগ্রাম থেকে: নতুন দুয়ার খুলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর আগমন। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলেছেন অল্পদিনেই। সাড়ে তিন বছর ধরে আর প্রতিযোগিতামূলক শুটিং করছেন না। অনুশীলনেও নেই। সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা বন্দী বাসার চারদেয়ালে। মাঝেমধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শুটিং ক্লাবে যান। কিন্তু সেই যাওয়ায় স্বতঃস্ফূর্ততার বড়ই অভাব।

অথচ এই মেয়েটিই ২০১০ দিল্লিতে কমনওয়েলথ শুটিংয়ে উড়িয়েছেন বাংলাদেশের পতাকা। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে শারমিন আক্তার রত্নার সঙ্গে জুটি গড়ে দেশকে এনে দিয়েছেন দলগত সোনা। ব্যক্তিগত সোনা জিতে ওই মঞ্চে প্রথম দেশের পতাকা ওড়ান সাবরিনা সুলতানা। সাদিয়া ওই ২০১০ সালেই এসএ গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দলগত সোনার গর্বিত অংশীদার, ব্যক্তিগত রুপার পদক তুলেছেন গলায়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ গেমসে সোনা জেতেন ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে। ওটাই তাঁর শেষ প্রতিযোগিতা!

এই নির্বাসন কেন? বলা হচ্ছে, সাদিয়া অসুস্থ। তারুণ্যের চপলতা নেই তাঁর মধ্যে। তবে নির্দিষ্ট কোনো রোগ নেই। নানা কারণে বিষণ্নতায় ভোগেন, হতাশাও আছে। তবে পরশু এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে ঢিল ছোড়া দূরত্বে সাদিয়াদের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, সাদিয়া স্বাভাবিক কথাবার্তাই বলছেন। বসার ঘরের আলমারিতে সারি সারি পদক দেখিয়ে ডুব দেন কয়েক বছর আগের স্মৃতিতে। কমনওয়েলথে সোনা জয়ের ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে আছে দেয়ালে। সাদিয়াকে প্রশ্ন করতেই হয়, শুটিংয়ে আর ফিরবেন না?

ছোট্ট উত্তর আসে, ‘মনে হয় না। আমি আর আগ্রহ পাই না খেলায়।’ আগ্রহে এই ভাটা কেন? কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তাগিদ দিলে বলেন, ‘আসলে খেলা আর ভালো লাগে না, আমি আর খেলব না।’ শেষ বাক্যটা শুনে পাশেই বসা বাবা সৈয়দ সরওয়ার আলম বলে ওঠেন, ‘খেলবে খেলবে। অচিরেই সে ফিরে আসবে। অসুস্থ ছিল তো, তাই একটু দূরে আছে। এখন সে অনেকটা সুস্থ।’

তবে সময় দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর জীবন থেকে। এসএ গেমসের কারণে ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন পরের বছর। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার টেবিলে বসেন গত বছর। খেলার কারণে পড়াশোনার বেশ ক্ষতিই হয়েছে। সম্প্রতি বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন বাবা, ‘বিয়ের ব্যাপারে পাত্র দেখাসহ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলাম। তবে এখন ভাবছি, ওটা থাক। ওর হাতে রাইফেল দেখতে চাই আমি। লাইন থেকে ট্রেন পড়ে গেছে, তবে উঠে দাঁড়াবে ইনশা আল্লাহ।’

একই আশা সাদিয়ার সাফল্যের অংশীদার শারমিন আক্তার রত্নারও, ‘ওর মতো শুটার হারিয়ে যাবে এ হতে পারে না। কোনো সমস্যা থাকলে সমাধান করে ওকে খেলায় ফিরিয়ে আনা উচিত।’ কিন্তু সাদিয়া শুটিং করবেন কীভাবে, রাইফেল থাকলেও এখন পোশাক নেই!

সরওয়ার সাহেবের কণ্ঠে তাই দুঃখ ঝরে। কমনওয়েলথে সোনা জয়ের পর চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থা (সিজেকেএস) বলেছিল সাদিয়াকে সংবর্ধনা দেবে, দেয়নি। কর্তাদের মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতি ছিল, অন্তত পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে স্বর্ণকন্যাকে। কিন্তু সাদিয়া কানাকড়িও পাননি। বাবার কণ্ঠে তাই আক্ষেপ, ‘আমি সিজেকেএসের কর্মচারী, আমার মেয়েকে সংবর্ধনা বা আর্থিক সহায়তা কেন দেবে বলেন!’
৩৩ বছর ধরে এই ভদ্রলোক সিজেকেএসে চাকরি করছেন। এখন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ের জন্মই এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের কোয়ার্টারে। হাটহাজারীর এই মানুষটি এখানেই পরিবার নিয়ে কাটিয়েছেন প্রায় ৩০ বছর। এমএ আজিজের গ্যালারির ধূলিকণা গায়ে মেখে সাদিয়ারা বড় হয়েছেন। তাঁর তিন ভাই ঘুম থেকে উঠেই শুনেছেন ব্যাডমিন্টনের শাটল কর্কের আওয়াজ। ওঁরা তিনজনই ব্যাডমিন্টন খেলেন।

বড়জন সৈয়দ সাজ্জাদ উল্লাহ সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে ব্যাডমিন্টনে মিশ্র দ্বৈতে সোনা জিতেছেন, এখন কোচও। মেজোজন সৈয়দ সিবগাত উল্লাহ জাতীয় স্কুল ক্রীড়ায় ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টানা দুবার। এখন অনূর্ধ্ব-১৫ বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া ছোটজন সৈয়দ সাফাই উল্লাহও ব্যাডমিন্টন খেলে। সাদিয়ার ছোট বোন সৈয়দা সায়েমা সুলতানা ২০১২ জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে জুনিয়র বিভাগে ব্রোঞ্জজয়ী।

সরওয়ার আলমের অনেক গর্ব। গড়ে তুলেছেন একটা নিখাদ ক্রীড়াপরিবার। কিন্তু সাফল্য এনে দেওয়া সাদিয়ার খোঁজ কেউ রাখেনি। সিজেকেএস, শুটিং ফেডারেশন—কেউ না। সত্যিই বাংলাদেশের আশ্চর্য এক ক্রীড়াঙ্গন। সোনার মেয়েকে ভুলে যেতে সময় লাগল না এতটুকু!-প্রথম আলো

০১ ডিসেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে