স্পোর্টস ডেস্ক: ৩৮ বছর আগে কলকাতায় পেলের আধ ঘণ্টার বিশেষ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন ভারতের বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার শিবাজী দাশগুপ্ত। সে সময় পেলে বলেছিলেন, ভারতীয় টিম আমেরিকায় ট্রেনিং করতে গেলে তিনি উদ্যোগ নেবেন সেখানে খেলানোর৷ সেই চেষ্টাই হয়নি৷ সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে বিশিষ্ট ধারাভাষ্যকার শিবাজী দাশগুপ্ত লিখেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ায়।
আমাদের অবস্থা দেখে উনি সে দিন হাসবেন, না কাঁদবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না৷ রেগে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে ফেললেন, 'তোমরা পাগল নাকি? এ ভাবে কারও ইন্টারভিউ নেওয়া যায়?'
আমি নিশ্চিত এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে কোনও আন্তর্জাতিক তারকাই সে দিন আমাকে টিভি ইন্টারভিউ দিতেন না৷ কিন্ত্ত পেলে সত্যিকারের বড় মনের মানুষ৷ তাই ১৯৭৭ সালে আমাদের কলকাতা দূরদর্শনের জন্য সে দিন আমাকে আধ ঘণ্টার ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন৷ কেন উনি আমাদের পাগল বলেছিলেন, রেগে গিয়েও সামলে নিয়েছিলেন, তা আজ ৩৮ বছর পর ভাবতে গেলে নিজেরই হাসি পায়৷
তখন টিভি ক্যামেরায় ইন্টারভিউ নেওয়ার পরিকাঠামো একদমই অপেশাদার জায়গায় ছিল৷ এক-দু'মিনিটের বেশি একটা ফিল্মে ছবি তোলা যেত না৷ 'কাট' করে সেই জায়গা থেকে নতুন ফিল্ম লাগিয়ে দুটো দৃশ্যকে জুড়তে হত৷ ব্যাপারটা আমাদের কাছে যেমন কঠিন ও কষ্টকর ছিল, তেমনই যিনি ইন্টারভিউ দেবেন তাঁর কাছেও বিরক্তিকর ছিল৷ কারণ তাঁকে একই কথা একাধিকবার একইভাবে বলতে হত৷ সিকোয়েন্স বজায় রাখতে৷ এ ভাবেই আধ ঘণ্টা চলল৷ ওই ইন্টারভিউ শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল৷ মনে আছে, আটের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দূরদর্শনের পর্দায় প্রায়ই মন্তাজ করা 'পেলে উইথ দূরদর্শন' নামের আধ ঘণ্টার এই ইন্টারভিউ দেখানো হত মাঝেমধ্যে৷
ইডেনে মোহনবাগান বনাম পেলের কসমসের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচের টিভি কমেন্ট্রি করার ভার আমাকে দিয়েছিলেন তত্কালীন তথ্য-সম্প্রচার দফতরের অন্যতম প্রধান বিভাস বসু৷ ম্যাচটার দিন সাত সকাল থেকেই গোলপোস্টর পিছনে দূরদর্শনের বিশেষ বক্সে কেটেছিল দিনটা৷ ম্যাচ শেষ হওয়া মাত্র বিভাসবাবু আমাকে বললেন, 'এখনই গ্র্যান্ড হোটেলে চলে যাও৷ ওখানে পেলে দূরদর্শনকে এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেবেন৷' পেলের মুখোমুখি বসব৷ এটা তো স্বপ্নের ব্যাপার৷ কিন্ত্ত কোট-প্যান্ট-টাই কিছুই নেই৷ সকাল থেকে মাঠে পড়ে থাকায় জামাকাপড় নোংরা হয়েছে, ঘামে ভিজেছে৷ পেলেকে ইন্টারভিউ করার মতো প্রস্ত্ততি নেওয়াও নেই৷ এ সব কথা বলা সত্ত্বেও বিভাসবাবু আমাকে ঠেলে পাঠালেন পেলের কাছে৷
কিন্ত্ত এ কি এখনকার গুছোনো পরিকাঠামো পাব? পেলের বডিগার্ড পেদ্রো হোটেলের একটা ছোট ঘরে আমাদের ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করলেন৷ সেখানে শুধু অন্য মিডিয়ার লোকজনই নয়, ঢুকে পড়েছিলেন হোটেল কর্মী, মোহনবাগানের ফুটবলাররাও৷ আশঙ্কা ছিল, পেলে এই অবস্থায় আদৌ ইন্টারভিউ দেবেন কিনা৷ কিন্ত্ত ওই যে আগেই বলেছি, উনি বড় মনের মানুষ৷ তাই এমন অব্যবস্থার মধ্যেও ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন৷
ইন্টারভিউয়ে বসার আগে পেলে বলেছিলেন, 'আমি ইংরেজি খুব ভালো বুঝি না৷ তাই ধীরে ধীরে প্রশ্ন করবে৷' সেই কথা মেনে আমি একে একে তাঁর ছেলেবেলা, তাঁর পরিবার, তাঁর প্রথম ক্লাব, বিশ্বকাপে প্রথম খেলা নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছিলাম৷ উনি খুব খোলামেলা মেজাজেই অনেক আনটোল্ড স্টোরি সে দিন তুলে ধরেছিলেন৷ আজ হয়তো তাঁর জীবনের সে সব কথা নতুন নয়৷ কিন্ত্ত ৩৮ বছর আগে তাঁর সেই সব কথা জানার পর ফুটবলপ্রেমীদের হূদয়ে ঝড় উঠেছিল৷
মনে আছে, আমার একটা প্রশ্ন ছিল ভারতীয় ফুটবল নিয়ে৷ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইন্ডিয়াতে খেলার পর এখানকার ফুটবল নিয়ে আপনার কী ধারণা হল? আর এর উন্নয়নে আপনার পরামর্শই বা কি? পেলের জবাব ছিল, 'ইন্ডিয়ান ফুটবল ইজ ভেরি গুড৷' বলে তিনি মোহনবাগানের গোলকিপার (শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়) সহ জার্সি নম্বর বলে সুব্রত ভট্টাচার্য, গৌতম সরকার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করেছিলেন৷ বলেছিলেন, 'এদের নিয়ে ভারতীয় টিম গড়ে এখন থেকেই নিয়মিত দেশ-বিদেশে নিয়মিত খেলে বেড়াতে হবে৷ তা হলেই ভারতের ফুটবল দ্রুত আন্তর্জাতিক মানের হবে৷' উনি 'অন ক্যামেরা' কথা দিয়েছিলেন, যদি সেই ভারতীয় টিম আমেরিকায় ট্রেনিং করতে আসে, তা হলে উনি উদ্যোগ নেবেন সেখানে খেলানোর৷
৩৮ বছর পর পেলে আবার কলকাতায় পা রাখলেন৷ ইন্টারভিউ নিতে গেলে ক্যামেরায় মিনিটে মিনিটে ফিল্ম বদলাতে হয় না৷ তবে ভারতীয় ফুটবল আছে সেই ৩৮ বছর আগের মান্ধাতার জায়গায়৷ কারণ পেলের সে দিনের সেই পরামর্শ তো কানেই তোলেননি আমাদের ফুটবল কর্তারা৷ টাইমস অব ইন্ডিয়া
১১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ