শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:৫৪:৪৭

‘নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস’

‘নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস’

ইশতিয়াক পারভেজ : পিতার চাকরি সূত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পশ্চিম পাকিস্তানে খেলতেন দিপু রায় চৌধুরী। জাভেদ মিয়ানদাদের সঙ্গে খেলা এই ক্রিকেটার স্বাধীনতার পর চলে আসেন বাংলাদেশে। তবে স্বাধীন হওয়ার আনন্দ থাকলেও ক্রিকেট খেলতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছিলেন ভেতরে ভেতরে।

এরপরই সুযোগ আসে দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার। ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলা শুরু করে দেশের প্রথম জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান বাঁ হাতি এই পেসার। ১৯৭৬ সালে প্রথম জাতীয় দল মাঠে নেমেছিল এমসিসির বিপক্ষে। এরপর ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে খেলার সুযোগই নয় বাকিংহাম প্যালেসে রাণীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও পান। তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রিকেট খেলা ছিল ভীষণ কঠিন।

ছিল না টাকা, ছিল না ক্রিকেট খেলার অধুনিক সরঞ্জামও। এরপরও নিজের দেশের হয়ে খেলার গর্ব নিয়ে খেলে গেছেন। যাদের সংগ্রামে গড়ে দেয়া সোনালি পথে আজ মাশরাফি বিন মুর্তজা ও মুশফিকুর রহীমদের গর্বিত পথচলা। তবে স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর না-পাওয়ার আক্ষেপও আছে সাবেক এই ক্রিকেটারের। তার কথোপকথনের মূল অংশ তুলে ধরা হলো-

প্রশ্ন: স্বাধীন দেশে কীভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করলেন?

দিপু রায়: আমার বাবা চাকরি করতেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই সূত্রে সেখানেই ক্রিকেট খেলতাম। আমি জাভেদ মিয়ানদাদদের সঙ্গে খেলেছি। আমার ভালো একটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারও ছিল। যখন দেশ স্বাধীন হলো, চলে এলাম বাংলাদেশে। নিজের দেশে আসার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ক্রিকেট খেলতে না-পারার আক্ষেপে পুড়ছিলাম। হঠাৎ করেই ’৭৩ সালে এক বন্ধুর মাধ্যমে ওয়ান্ডারার্সে খেলার সুযোগ হয়। এরপর আবাহনীতে খেলার সুযোগ করে দেন শেখ কামাল।

সেখানে খেলার পর আমরা প্রথম জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাই ইংল্যান্ডের এমসিসির (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) বিপক্ষে ১৯৭৬ সালে। এরপর আমরা ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে খেলতে গিয়েছিলাম। সেখানে বাকিংহাম প্যালেসে আমাদের রাণীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়। সেটি ছিল আমাদের ক্রিকেটের গর্বিত একটা দিন। সত্যি কথা বলতে কী, সেই সময় টাকা আর সুযোগ না থাকলেও নিজের দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার যে আনন্দ সেটা ছিল অসাধারণ।

প্রশ্ন: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ক্রিকেট খেলা কতটা কঠিন ছিল?

দিপু রায়: আমরা যখন এমসিসির বিপক্ষে খেলতে নামি তখন আমাদের ক্রিকেট বুটও ছিল না। তখন আমি ও দৌলত দুজন মিলে নেভির সাদা রঙয়ের বুট কিনি। কিন্তু বুটের নিচে স্পাইক না থাকায় পিছলে পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। তাই ফুটবল বুট তৈরি করে যারা তাদের কাছে গিয়ে লেদ মেশিনে স্পাইক বানিয়ে বুটের নিচে লাগাই। এমসিসির ক্রিকেটাররা এই বুট দেখে ওরা নিজেদের বুটগুলো আমাদের দিয়ে দিয়েছিল। এমনকি সেই সময় সাইড প্যাডও ছিল না। রকিবুল ভাই, আশরাফুল হক ভাইদের দুই একজনের ছিল। এখন তো প্রতিপক্ষকে জানতে চিনতে অনেক ভিডিও ক্লিপ আছে। সফটওয়্যার আছে, কিন্তু আমরা বই পড়ে, আর রেডিও কমেনট্রি শুনে ক্রিকেট শিখতাম।

প্রশ্ন: স্বাধীন দেশে ক্রিকেটের বড় প্রাপ্তিগুলো কী?

দিপু রায়: আমরা ক্রিকেট খেলছিলাম ঠিকই কিন্তু কতদূর যাব জানা ছিল না। প্রথম যখন এমসিসির বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয় তখন আমরা যে খেলতে পারি সেই বিশ্বাসটা পেলাম। এরপর যখন ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেলাম সেটি ছিল আমাদের ক্রিকেটের স্বীকৃতি। এরপর ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়া। এখান থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে আমাদের যাত্রা আরও গতিশীল হয়। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা আসে যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেলাম। এরপর আমাদের প্রথম ওয়ানডে জয়, প্রথম টেস্ট জয় অনেক কিছুই আছে কিন্তু।
 
প্রশ্ন: নিজের দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলার আনন্দ কতটা?

দিপু রায়: নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার আনন্দটা সম্পূর্ণই আলাদা। পাকিস্তানে খেলেছি সেখানে খেলার আনন্দ থাকলেও মনের সুখটা হলো দেশের হয়ে খেলার। এই দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ক্রিকেট ছেড়ে আমি কোচ হয়েছি। আমি মনে করি আমার দেশকে অনেক কিছু দেয়ার আছে। তাই আমি সবচেয়ে বেশি বাচ্চাদের কোচিং করাই। যেন এই দেশের ক্রিকেটাররা সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। তারা জানে এই দেশের ক্রিকেট কীভাবে কত কষ্টের মধ্য দিয়ে এসেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এখনকার প্রজন্ম জানে না কীভাবে কত কষ্ট আর কত মানুষের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে এখন সাকিব-তামিমদের গর্বিত ক্রিকেট দেখতে পাচ্ছে।

প্রশ্ন: বাংলাদেশে ক্রিকেট আর্কাইভ না থাকার আক্ষেপ কতটা?

দিপু রায়: আক্ষেপের তো শেষ নেই। আমরা যারা প্রথম জাতীয় দলে খেলেছি তারা তো টাকা চাই না। কী চাই! শুধু একটু সম্মান, আমরা চাই এই প্রজন্ম জানুক আমাদের প্রথম জাতীয় দলে কে কে খেলেছে। অনেকেই বলতে পারবে না, প্রথম জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদের নাম। সেই সময় কীভাবে ক্রিকেট খেলেছি, কীভাবে এই দেশের ক্রিকেট এত দূর এলো, কাদের আত্মত্যাগে এলো? এগুলো না জানলে নতুন প্রজন্মের মনে কীভাবে দেশের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা জন্ম নেবে? এক সময় ক্রিকেট বোর্ড ছিল একরুমে। এখন অনেক বড় হয়েছে। তাই আমরা তো আশা করতেই পারি একটা পরিপূর্ণ ক্রিকেট আর্কাইভের। সেখানে প্রথম জাতীয় দলের একটা ছবি অন্তত থাকবে। এটা নিয়েই তো আমরা গর্ব করতে পারবো। মানবজমিন
১৬ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে