প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত : হাতে বল ছয়, রান চাই এগারো। বোলার, বিশ বছরের অনভিজ্ঞ ছোকরা পেসার। স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটসম্যানের নাম, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। বছর দেড়েক আগে হলে নিয়মিত ক্রিকেট-দর্শক বাজি ধরে বলে দিতে পারতেন, এর পর ঠিক কী ঘটতে চলেছে। এমএসডির ব্যাট থেকে দুইটা বাউন্ডারি, হয়তো একটা হেলিকপ্টার শট, একটা বা দুটো সিঙ্গলস। ব্যস, খেলা শেষ।
কিন্তু সেটা বছর দেড়-দুই আগের মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। যার সঙ্গে ২০১৫ মধ্য অক্টোবরের মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মিল কম, অমিল বেশি। প্রথম জন ছিলেন সীমিত ওভারের অমিতবিক্রম ফিনিশার। দ্বিতীয় ভদ্রলোকের ঘাড়ে অন্য একটা বিশেষণ গন্ধমাদনের ভার নিয়ে চেপে বসবে-বসবে করছে। কানপুরে রবিবারের গ্রিন পার্ক বিপর্যয়ের পরে তো আরওই। ফিনিশার নয়, ফিনিশ্ড!
এই ধোনির ব্যাটিংয়ে আগের হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বিলুপ্তির দিকে। এই ধোনির ব্যাট থেকে হেলিকপ্টার দূরের কথা, খেলনা প্লেন দর্শনও এখন বিরল! ২৪ বলে ৩৫ রান চাই, অতীতে আলুসেদ্ধ-ভাত হয়ে যাওয়া পরিস্থিতিতে এই ধোনি বড় শটের রাস্তাতেই যান না। এই ধোনি বাড়ন্ত ব্যাটের অভাব পোষাতে চান ক্লান্ত একজোড়া পা দিয়ে। এই ধোনি বারবার, কোনও রকমে বলটা দূরে ঠেলে এত জোরে দু’রানের জন্য দৌড়ন যে, ক্রিজে ঢুকতে না ঢুকতে দু’হাতে কোমর জাপটে সামনে ঝুঁকে হাঁফাতে থাকেন।
এই ধোনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবে দুধের দাঁত পড়া পেসারকে স্লগ করতে যান। আগেকার ধোনি হলে যে বলটা বাউন্ডারির বাইরে গড়াগড়ি খেত, এই ধোনির অবাধ্য ব্যাটের খোঁচায় সেই বল মাঝ পিচের আকাশ পেরোয় না। ক্ষুধার্ত স্নেহে, প্রায় স্লো মোশনে সেই বল লুফে নিতে হাজির হন একাধিক ফিল্ডার। এই ধোনি শেষ ওভারে এগারো তুলতে পারেন না। ম্যাচ ফিনিশ করার কাজটা তাঁকে ছেড়ে আসতে হয় স্টুয়ার্ট বিনি, ভুবনেশ্বর কুমারদের হাতে।
হারের পর যে ধোনিকে বিনা প্রতিবাদে নিজের দোষ স্বীকারও করে নিতে হল। ব্যর্থতার নানান অজুহাত সাজাতে হল। এই ধোনিকে বলতে হল, ‘‘শেষ দিকে তাহিরের ওভারে দুটো উইকেট চলে গেল, না হলে আমরা খুব ভাল জায়গায় ছিলাম।’’ বলতে হল, ‘‘ওই যে মাঝের কয়েকটা ওভারে কম রান উঠল, শট বাছাইয়ে গণ্ডগোল হল, ওটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।’’ বলতে হল, ফিনিশারের কাজটা খুব কঠিন। বড় শটের ঝুঁকি নেওয়া নাকি অনেকটা জুয়া খেলার মতো। ব্যাখ্যা দিতে হল, অশ্বিনের জন্য বরাদ্দ ওভারগুলো অনিয়মিত স্পিনারদের দিয়ে করাতে হল বলেই টার্গেটটা বড্ড বেশি হয়ে গেল। দুঃখ করতে হল, তাঁর ডেথ বোলাররা মোটেই উইকেটের ইউএসপিগুলো কাজে লাগাতে পারেননি। অসহায় স্বীকার করতে হল, এবি এমন ব্যাটসম্যান যার বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট ছক নিয়ে বল করা প্রায় অসম্ভব।
দেশের সফলতম অধিনায়কের ক্রিকেট-বোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা মূর্খামি। কিন্তু তাঁর সব বক্তব্য, সব ব্যাখ্যা মেনে নিলেও একটা সত্যি অনস্বীকার্য। অশ্বিনের চোট, শেষ বলে ছয় মেরে এবির সেঞ্চুরি, বোলিং ব্যর্থতা, রান তাড়ার গতি একটা সময় থমকে যাওয়া— এত কিছুর পরেও জয়ের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল ধোনির টিম। সেই অবস্থা থেকে বাকি রাস্তাটুকু পার করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন। এবং তিনি মুখ থুবড়ে পড়েছেন।
অথচ এত ভাল মঞ্চ ইদানীং তিনি পেয়েছেন কি না, সন্দেহ। অসমান বাউন্সের উইকেটের নড়বড়ে ভিতে যে মঞ্চের কাঠামো তৈরির জোগাড়যন্ত্র বেশ মন দিয়ে করছিলেন রোহিত শর্মা এবং অজিঙ্ক রাহানে। কোহলির জায়গায় রাহানেকে তিন নম্বরে পাঠানো নিয়ে মৃদু প্রশ্ন উঠছিল কমেন্ট্রি বক্সে, মনে হয় না সেগুলো দিনের শেষে আর থাকল বলে। রাহানে ৮২ বলে ৬০ করে গেলেন। তার চেয়েও বড়, রোহিতকে সেই পাটাতনটা দিলেন যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি সেঞ্চুরির তটভূমির দিকে স্বচ্ছ্বন্দে এগোতে পারেন।
স্টেইন-মর্কেল-তাহিরদের পাশাপাশি কানপুরের প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি গরমকেও অসাধারণ খেললেন রোহিত। ছেচল্লিশটা ওভার টিমের হাল ধরে থাকা, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দুঁদে টিমের বিরুদ্ধে নিজের তৃতীয় সর্বোচ্চ ওয়ান ডে স্কোর করে যাওয়া— কম কথা নয়। ব্যাটিং শিল্পে, নৈপুন্যে এক-এক সময় এবি ডে’ভিলিয়ার্সের ইনিংসের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন রোহিত।
ডে’ভিলিয়ার্স হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ইংরেজিতে ‘পলিম্যাথ’ বলে একটা কথা আছে। মানে, যে একই সঙ্গে নানাবিধ কাজে সমান পারদর্শী। ডে’ভিলিয়ার্স হলেন ক্রিকেটের ‘পলিম্যাথ’। ক্রিকেটের তিনটে ফর্ম্যাটে সমান দুর্ধর্ষ, সমান সৃষ্টিশীল। কঠিন যুদ্ধকে সহজ করে তিনি জিততে জানেন। জানেন, হাফসেঞ্চুরি করতে গোটা পঞ্চান্ন বল লাগলেও অসুবিধে নেই। পরের কুড়ি বলে বাকি পঞ্চাশ অনায়াস দক্ষতায় তুলতে পারবেন তিনি। কানপুর-দর্শক ভাগ্যবান। তারা চর্মচক্ষে দেখতে পেলেন, এবি ডে’ভিলিয়ার্স কী জিনিস!
কিন্তু রোহিতও কিছু কম করেননি। শুধু বুঝতে পারেননি, তার অধিনায়ক উল্টোটা করে যাবেন। সহজ ম্যাচকে কঠিন করে যাবেন। ক্লান্তি আর গরমে নির্বিষ হয়ে পড়া বিপক্ষ বোলিং। গ্রিন পার্ক গ্যালারির জঙ্গি সমর্থন। সামান্য কয়েকটা রান, আর তা তোলার জন্য পর্যাপ্ত ডেলিভারি। সবচেয়ে বড় কথা, ধোনি তখন সদ্য নামেননি। গোটা পঁচিশেক বল খেলা হয়ে গিয়েছে। প্রত্যাবর্তনের সিংহগর্জনের জন্য ধোনির এর পরেও কিছু চাওয়ার থাকতে পারত?
পারত। যা তার সবচেয়ে বেশি দরকার, অথচ যা আজকাল তার ধারকাছ ঘেঁষছে না। যাকে অদূর অতীতে ফেলে এসেছেন ভারত অধিনায়ক।
যার নাম, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি!
লেখক : ভারতীয় ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক
১৩ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি