স্পোর্টস ডেস্ক : এক জনের ক্রিকেট যাত্রাপথের রেখচিত্র অবিশ্বাস্য রকমের ঊর্ধ্বগামী, প্রায় লোকগাথায় রূপান্তরিত। অন্য জনের ক্রিকেটজীবন অমসৃণ, হোঁচটে ভরা, উঁচু-নিচু। এক জনকে নিয়ে প্রচলিত প্রবাদ— ছেলেটা সোনার কপাল নিয়ে এসেছে। অন্য জনের সম্পর্কে লোকমুখে ঘোরা ব্যঙ্গ, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে!
এক জন এই সে দিন পর্যন্ত ছিলেন দেশের ক্রিকেট ঔদ্ধত্যের প্রতীক। অন্য জনের টিমে অন্তর্ভুক্তি ছিল ভারতীয় ক্রিকেটে নিরন্তর সমালোচনার বিষয়। এক জন এই মুহূর্তে গণরোষের প্রিয়, একাকী নিশানা। অন্য জন ভাসছেন জন-সমাদরের উত্তাল সমুদ্রে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং রোহিত গুরুনাথ শর্মা।
ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন মানচিত্রে যাঁদের অবস্থান প্রায় পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছে। অতীতের ‘অধিনায়ক জয় হে’ কোরাসের বদলে দেশের অলিগলিতে এখন নতুন স্লোগান— ধোনি, আর নয় হে। আর নিয়তির এমন পরিহাস যে, অতীতে তাঁরই স্নেহধন্য হিসেবে শ্লেষবিদ্ধ রোহিত শর্মা এখন সাফল্যের সবচেয়ে বড় মুখ, নির্ভরতার অন্যতম বড় নাম।
সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ান ডে-র চব্বিশ ঘণ্টা আগে তাই এমএসডি আর রোহিত শর্মা যে ভিন্ন মেজাজে আবির্ভূত হলেন, তাতে আশ্চর্যের বিশেষ কিছু নেই। ওয়ান ডে-র সব টিমের মধ্যে এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেই ধোনির গড় সবচেয়ে কম— মাত্র ২৭.৩০। তাই হয়তো প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি আরও জমাট। আর পাঁচটা দিনের চেয়ে এ দিন নেটে আরও বেশি সময় কাটাতে দেখা গেল ধোনিকে।
দেখা গেল, ছোট ছোট খেপে আলাদা আলাদা ক্লাস নিতে। কখনও সাপোর্ট স্টাফ রাঘবেন্দ্রর থ্রো ডাউনে লেগস্টাম্পের দিকে শাফল করে নতুন শটের মহড়া। তার পরপরই টানা শর্ট বল মোকাবিলার প্র্যাকটিস। আচমকা উঠে আসা একটা ডেলিভারির ধাক্কায় ডান হাতে চোট পেয়ে কিছুক্ষণ ব্যাটিং থামাতে হল। বারবার হাত ঝাঁকানো দেখে মনে হল, ভালই লেগেছে। কিন্তু মেডিক্যাল কিট নিয়ে ছুটে আসা ফিজিওকে ফিরিয়ে দিয়ে ফের ডুবে গেলেন ব্যাটে রান ফেরানোর সাধনায়।
ধোনি যে নেটে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটালেন, তার আশপাশটা কার্যত জনশূন্য। সাংবাদিক আর নিরাপত্তারক্ষী মিলিয়ে দর্শকসংখ্যা মেরেকেটে দশ কী বারো। প্র্যাকটিস দেখতে আর কত ভিড় হবে, এ রকম কিছু ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। কারণ হোলকার স্টেডিয়ামের উল্টো দিকের গ্যালারি তখন এমন জীবন্ত যে, মনে হবে ম্যাচ বুঝি আজই! ওই গ্যালারির সামনেও একজোড়া নেট, আর সে নেটের অন্যতম মালিকের চেহারাটা দূর থেকে খুব ভাল বোঝা না গেলেও তাঁর পরিচয় জানতে চোখ নয়, কানই যথেষ্ট। ওই দুটো নেটের একটায় ব্যাট করছেন রোহিত শর্মা, হাজারতিনেক দর্শকের ‘রোহিত, রোহিত’ চিৎকারের মধ্যে।
কানপুরে দেড়শো করে ওঠা মুম্বইকরকে নিয়ে উত্তেজনা স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরিমাণ কিছুটা অপ্রত্যাশিত। আইপিএল-বুভুক্ষু, চার বছর পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পাওয়া মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর যে বিরাট কোহলি, শিখর ধবন, সুরেশ রায়নাদের ভুলে গোটা দিন একজনকে নিয়েই পড়ে থাকবে, আশ্চর্যের।
রোহিত প্রসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং কোচ শার্ল ল্যাংভেল্ড যা বলে গেলেন, তা-ও কম চমকপ্রদ নয়। কেকেআরের এক সময়কার সদস্য শার্লের বক্তব্য, রোহিতকে ফেরাতে হলে প্রথম দশটা বলের মধ্যে ফেরাতে হবে। সেটা না করতে পারলে, রোহিত কুড়ির আশেপাশে রান করে ফেললে নাকি তাঁকে আটকানোর কোনও উপায় তাঁর টিমের কাছে নেই! ইনদওরের ছোট, রান-ভর্তি মাঠে তো আরওই নেই।
সাংবাদিক সম্মেলনে এসে রোহিতের সদম্ভ সব ঘোষণা বোধহয় যে প্রেক্ষিতে খুব বিসদৃশ লাগবে না। কানপুরে পারিনি, ঠিক। কিন্তু জেনে রাখুন, এক ভুল আমরা বারবার করব না। কোনও চ্যাম্পিয়ন টিম সেটা করে না।
শিখরের অফ ফর্মটা চিন্তার ব্যাপারই না। ভুলে যাবেন না, বিশ্বকাপ আর বাংলাদেশ সিরিজে ও-ই সবচেয়ে বেশি রান করেছে। সেঞ্চুরির পর অনেকের ফোকাস নড়ে যায়। আমি কিন্তু নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে যাই আরও বেশি রান করার জন্য। যতক্ষণ সম্ভব ব্যাট করার জন্য।
হ্যাঁ, আমাদের ডেথ বোলিংয়ে উন্নতি দরকার। কিন্তু আগের অনেক ছোট ছোট ভুল এর মধ্যেই বোলাররা শুধরে নিয়েছে। নতুন নিয়মে এখন সার্কেলের বাইরে বাড়তি ফিল্ডার থাকবে, তাতে আরও লাভ হবে। আমাদের ব্যাটিং কম্বিনেশনটা এখনও থিতু হয়নি, জানি। কিন্তু ক’টা ম্যাচ দিন, সব সেট হয়ে যাবে।
সব শুনে মনে হবে, সত্যিই তাঁর টিমের বিশেষ কোনও সমস্যা নেই। মনে হবে, সমস্যা থেকে থাকলে তার সমাধানও হাতের মুঠোয়। মনে হবে ব্যর্থতার খাদ থেকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সমতলের দূরত্ব পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যেকার ব্যবধান নয়, পাশাপাশি দুই পাড়ার মিনিটখানেকের পথ।
আপাতত অবশ্য এগুলো ‘মনে হবে’তেই আটকে। বাস্তব আপাতত অন্য কথা বলছে— শান্তির দুই প্রতীকের নামাঙ্কিত এই সিরিজ আপাতত রোহিতের টিমকে অশান্তি ছাড়া কিছু দিতে পারেনি।-আনন্দবাজার
১৪ অক্টোবর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর