নাজমুল হাসান নাঈম: ক্রিকেট খেলি বোধহয় ১৯৯৬ থেকে। এক বছর আগে বা পরে থেকেও হতে পারে। তবে নিয়মিত প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ টুর্নামেন্ট বা ম্যাচ খেলি ৯৯ থেকে। স্পষ্ট মনে আছে। প্রথম ম্যাচে ৪ টা উইকেট পেয়েছিলাম একটা টুর্নামেন্টে। তখন হাত ঘুরিয়ে পেস বল করাদের কদর অনেক।
মোটামুটি ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দিয়েছি ২০১১ তেই। কালেভদ্রে দুই একটা টুর্নামেন্টে নেমেছি অনুরোধের ঢেঁকি গিলে। বেধরক পিটুনি খেয়েছি ব্যাটসম্যানদের হাতে, আবার ধারাবাহিকভাবে আফ্রিদি (০) করেছি!
২০১৬ তে এসে একটা শর্টপিচ টুর্নামেন্ট দিয়ে পাকাপাকিভাবে ক্রিকেট ছেড়ে দিলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর ক্রিকেট খেলবো না। বোলার বল করলে চোখে দেখিনা। নিজে বোলিং করলে এক ওভারে আটটা-নয়টা ওয়াইড এর কম দেই না। যেটা আবার লাইনে দেই সেটা যায় বাউন্ডারির বাইরে। রিফ্লেক্স, বডি কেউই চায়না ক্রিকেট খেলে নিজেকে আরোও হাস্যরসের পাত্র বানাই।
২০১৭ তে এসে আবার আফ্রিদি হলাম। বন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটা টুর্নামেন্টে ফিরলাম।
প্রথম দুই ম্যাচে মোটামুটি ভালোই খেলেছি। আন্দাজে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ রানও করেছি। বিপত্তি বেজেছে আজ। মোটামুটি ভালোর চেয়ে বেশি ভালো খেলে ফেলেছি। তবে ম্যাচে মন ছিলো না, কনসেনট্রেশন ছিলো না। ম্যাচের একটা পর্যায়ে বুঝে ফেলি, ম্যাচটা পাতানো। আমাদের পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করতে অন্যদল ম্যাচটা ছেড়ে দিচ্ছে। ফিল্ডার একই জায়গা দিয়ে বারবার চার মারছি দেখেও সেখানে যাচ্ছেনা, বোলার ক্রমাগত হাফবলি বল দিয়ে যাচ্ছে! মাঠ ঘেরা দর্শক আনন্দ পাচ্ছে! হাত তালি দিচ্ছে। আমার গর্ব লাগার কথা। মাশরাফির মতো দাড় করানো কলার আরোও প্রবলভাবে নিজের ফুরিয়ে না যাওয়ার অহংকার প্রকাশ করার কথা, অথচ আমার তখন লজ্জা লাগছে। নিজেকে একজন প্রতারক মনে হচ্ছিলো। মফস্বলের কিছু দর্শকদের আনন্দের সাথে প্রতারণা! তাদের হৃদয় নিংড়ানো উচ্ছ্বাসের সাথে প্রতারণা! ক্রিকেট নামক বিশুদ্ধ আবেগে থৈথৈ এক খেলার আবেগের সাথে প্রতারণা!
২১ বছর ক্রিকেট খেলেছি। প্রফেশনাল না হোক, কিন্তু মোটামুটি দেশের কয়েকটা জেলায় পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ক্রিকেট খেলেছি। টেপ টেনিসে খেলেছি ঢাকার প্রায় সব মাঠেই। বহু ম্যাচে নিজে অস্বাভাবিক রান দিয়েছি। আবার বহু ম্যাচে, হারা ম্যাচ এক স্পেলেই জিতিয়ে এনেছি, কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো কোনোদিন অসততার আশ্রয় নেইনি। আজকের একটা ম্যাচ আমার সারাজীবনের টুকটাক মহল্লার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দাগ বসিয়ে দিলো। স্রেফ একটা ম্যাচ!
আজকের এই কষ্ট দীর্ঘদিনের প্রেমিকা ছেড়ে গেলে যে কষ্ট হয়, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে একটা চাপ লাগে। কেমন হাহাকার দিয়ে ভরা একটা সময়! প্রচন্ড কষ্ট লাগে! মানুষের আবেগের উপর পর্দা দিয়ে, সেই পর্দার আড়ালে রান করার কষ্ট!
আমি ভাবি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বা প্রফেশনাল ক্রিকেটে যারা ম্যাচ ফিক্সিং করে, তাদের অনুভূতি কেমন হয়! তারা কীভাবে ঘুমায়! তাদের কি দর্শকদের কথা মনে পড়েনা! তাদের কি কোটি কোটি দর্শকদের আবেগ, উচ্ছ্বাসের কথা মনে পড়েনা! মনে পড়েনা, কীভাবে একটা দল, একটা জাতি, একটা দেশ তাদের সবকিছুকে থামিয়ে দিয়ে এই একটা খেলার জয় পরাজয় দেখতে প্রার্থনায় বসে!
সেই ২০০১ থেকেই আশরাফুলের প্রতি আমার ভালোবাসাটা অস্বাভাবিক! অন্ধের মতো। এমনকি তাকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ হিসেবে রাত জেগে প্ল্যাকার্ড বানিয়ে মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে পুলিশের দৌড়ানি পর্যন্ত খেয়েছি। অথচ আজকেই সেই ভালোবাসা ঘৃনায় পৌঁছে গেছে। কতটা অবলীলায় সে বছরের পর বছর ম্যাচ পাতিয়েছে! কতটা নিষ্ঠুরভাবে আমাদের ইমোশন নিয়ে খেলে গেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ! আমি জানি সে একা নয়, পিছনে কলকাঠি নাড়ার মতো অনেক বিগ হেড আছে। না হলে গতবার দেশের শ্রেষ্ঠ ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে আবহানী দুর্নীতি করে কীভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়! ক্রিজ থেকে দেড় হাত বাইরে তাসকিন থাকতেও, কীভাবে আম্পায়ার তাকে রান আউট ঘোষণা করেন না কিংবা কীভাবে আজ দ্বিতীয় বিভাগে ৪ বলে ৯৪ রান দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে! কীভাবে!!
ফিক্সিংয়ের কালো ছায়া আছে আন্তর্জাতিক অনেক ক্রিকেট তারকার জীবনেও। হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, সেলিম মালিক, আসিফ, আমির আরোও কত শত জন! এদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে, নিষেধাজ্ঞাও পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। অথচ এর বাইরেও তো আছে কতশত জন। যাদের নিয়ে আমরা কল্পনাও করিনা। সর্বাকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন, অসাধারণ বক্তা, শুদ্ধ ক্রিকেটের প্রতীক সাঙ্গাকারার নামেই বা কেন তাদের স্বদেশি হাসান তিলকারাত্নে বারবার ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তুলবেন! বারবার প্রমাণ দিতে যেয়েও কেন কারো কাছে তার অভিযোগ ভিত্তি পাবেনা! কেন তদন্ত হবে না! কেন এপ্রিলের ২ তারিখে বিশ্বকাপ ফাইনালে দিবারাত্রি ম্যাচে পরে ডিউ ফ্যাক্টর হবে জেনেও, শক্তিশালী ভারতের লাইন আপের বিরুদ্ধে আগে ব্যাট করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে!
এসব দেখতে দেখতে, একসময় ঘোর লাগিয়ে রাখা ক্রিকেট আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড অভাবের মধ্যেও, টাকা জমিয়ে সেই স্কুল বয়সে শুধু্ ক্রিকেট খবর নিতে রেডিওতে খেলার খবর শোনার জন্য ব্যাটারি কিনে মায়ের হাতে প্রতিদিন উত্তম মাধ্যম খাওয়া এই আমি, হাতের কাছেই ক্রিকইনফো এ্যপে ঢুকেও খোঁজ নিতে আকর্ষণ বোধ করিনা।
ক্রিকেটের প্রতি আমার ভালোবাসা কমতে কমতে এমনিতেই প্রায় শূন্যের কোঠায়! আজ আবার নিজেও নিজেকে কলঙ্কিত করলাম, একটা সাধারণ শর্টপিচ টুর্নামেন্টে ম্যাচ পাতিয়ে। এভাবে আসলে ক্রিকেট হয়না, এভাবে আবেগের সাথে প্রতারণা হয়। কলঙ্কিত হয় এই মহান খেলা।
১৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এপি/ডিএস