স্পোর্টস ডেস্ক: শ্রীলঙ্কা সফর থেকে দেশে ফেরা মাশরাফি বিন মুর্তজা ব্যস্ত ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগ নিয়ে। এরই মধ্যে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হলেন তিনি। তাতে টি-টোয়েন্টি অবসর বাদেও আন্তর্জাতিক নিজের ও বাংলাদেশের বর্তমান বিষয় নিয়েও বিস্তর আলোচনা হল।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিলেও সামনের মাসগুলোতে বাংলাদেশের ওয়ানডে পরিকল্পনার বিশাল অংশজুড়েই আছেন আপনি...
আমি ওয়ানডে উপভোগ করছি। আমার মনে হয়, এই মুহুর্তে টি-টোয়েন্টি এবং টেস্টে আমরা ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকলেও ওয়ানডেতে (আইসিসি র্যাংকিংয়ে) দশ থেকে লাফ দিয়ে সাতে চলে এসেছি। আমরা একটা বড় ধাপে পা ফেলেছি, আর এটা এসেছে বেশ কিছু খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সের জোরে। আমি এই মুহুর্তে ওয়ানডে উপভোগ করছি এবং আরো বেশ কিছুদিন ধরে খেলতে চাই, কিন্তু বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো বাঁধাধরা সময় বলে দেওয়া কিছুটা কঠিন। আমি খেলা চালিয়ে যাবো আশা করছি, তবে যদি কিছুটা খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং চাপের মুখে থাকি, তাহলে হয়তো কোনো সিদ্ধান্তে আসতেই হবে।
আপনি গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেটার পর দারুণ একটা সময় কাটিয়েছেন। ২০১৫তে দলে আপনার ভূমিকা থেকে এই বছরে দলে আপনার ভূমিকায় কোনো পার্থক্য আছে কি?
২০১৫ বিশ্বকাপের পর নতুন বলে আর সেভাবে বোলিং করা হয়নি। সম্ভবত দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে কয়েকটা ম্যাচে করেছিলাম। আমার ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই, খুব কম বয়স থেকেই আমি এতবার বোলিং ওপেন করেছি যে আমার স্কিল অনেকটাই গড়ে উঠেছে নতুন বলকে ঘিরেই। একজন বোলারের ভিত্তিটা গড়ে ওঠে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টকে কেন্দ্র করেই। মুস্তাফিজুর ওর কাটারগুলোর জন্য নতুন বলের চেয়ে কিছুটা পুরোনো হওয়া বলেই বেশি কার্যকর। তাসকিন আর রুবেল প্রথম ১০ ওভারের পরই বেশি কার্যকর, যখন সার্কেলের বাইরে আরো দু’জন ফিল্ডার পায় ওরা। সৈয়দ রাসেল, তাপস বৈশ্য এবং মঞ্জুরুল ইসলাম সবাই নতুন বলে ছিল দারুণ কার্যকর, আমিও তাই।
আমি খুব দ্রুত পুরোনো বলে খাপ খাইয়ে নিতে পারি, যদিও শুরুর দিকে এটা আমার জন্য কিছুটা কঠিনই ছিলো। আমি আমার ভূমিকা উপভোগ করছিলাম, আর যেহেতু দল তখন সাফল্যও পাচ্ছিলো, আমার বেশ ভালোই লাগছিলো। মুস্তাফিজুর ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বেশ দ্রুত উইকেট তুলে নিয়েছিলো, তবে ও ইনজুরিতে পড়ে গেলে আমার আবার বোলিং ওপেন করতে হলো। সারাজীবন আমি এটাই করে এসেছি, অথচ গত বছর আফগানিস্তানের সাথে যখন আবার বোলিং ওপেন শুরু করলাম, মনে হচ্ছিলো যেন যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখান থেকেই শুরু করছি আবার।
শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে আপনার প্রথম স্পেলটাই মোটামুটি ম্যাচের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিলো। দ্রুত ব্রেক-থ্রু এনে দেওয়ার এই দারুণ নৈপুণ্যটা অর্জন করলেন কীভাবে?
এটা আসলে নির্ভর করে বোলারের আত্মবিশ্বাস এবং সামর্থ্যের উপর। তামিম (ইকবাল) যখন রান পায় না মানুষ তাঁকে দোষ দিতে শুরু করে, অথচ সে কিন্তু ওয়ানডেতে দুইবার নতুন বল ফেস করে। তাঁর সেই সামর্থ্যও রয়েছে। আমার ক্ষেত্রে, (মোহাম্মদ) শাহজাদ যখন আমাকে এক ওয়ানডেতে ছক্কা মারলো, এরপরই আমি ওকে আউট করে দিলাম, কট বিহাইন্ড। আমার কনফিডেন্স চলে এলো তখনই, মনে হতে শুরু করলো আমি তুঙ্গে আছি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও ব্রেকথ্রু এনে দিলাম এরপর।
ক্যাপ্টেন এবং সিনিয়র প্লেয়ার হিসেবে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়াটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমি এটা আত্মবিশ্বাসের সাথেই নিয়েছিলাম এবং উপভোগ করেছি।
বর্তমানে প্রত্যেক ওপেনিং ব্যাটসম্যানেরই আগ্রাসী থাকাটাই চলতি ট্রেন্ড হয়ে গেছে। একজন বোলারের জন্য আত্মবিশ্বাস এবং ধৈর্য্য ধরে রাখা কতটা কঠিন বলে মনে হয়?
আমার কনফিডেন্সটা আসে আমার লম্বা ক্যারিয়ার থেকে, যখন থেকে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেছি। যখন আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলতে শুরু করি, তখনকার তুলনায় আজকাল আর সেরকম বিপদজনক ওপেনার খুব একটা আছে বলে আমার মনে হয় না।
প্রত্যেক দলে দারুণ সব ওপেনার ছিলেন : ভারতের ছিলো গম্ভীর-শেবাগ, অস্ট্রেলিয়ার হেইডেন-গিলক্রিস্ট, শ্রীলংকার সনাৎ জয়াসুরিয়া আর দক্ষিন আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ- হার্শেল গিবস। আজকাল ওপেনাররা টেকনিক্যালি অতটা সলিড নয়, আমার ওতেই চলে যায়।
আপনি বলছিলেন ড্রেসিংরুমে কোর্টনি ওয়ালশের উপস্থিতি আপনার কাছে আলাদা একটা গুরুত্ব বহন করে। আপনার অ্যাপ্রোচে কি সেরকম টেকনিক্যাল কোনো পরিবর্তন এনেছেন?
আমার অ্যাকশনে আমি কখনোই সেরকম কোনো টেকনিক্যাল পরিবর্তন আনি নাই। এমন সময়ও গিয়েছে যখন আমি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু তবুও কখনো এমন পরিবর্তনের দরকার পড়েনি। কোর্টনি ওয়ালশ আসার সাথে আমার নতুন বল হাতে নেওয়াটা এক বিন্দুতে মিলে গেছে, আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে তিনি দারুণ সাহায্য করেছেন।
বোলারকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর নিজস্ব একটা ধরণ আছে। তিনি একজন লেজেন্ড, তাই আপনি যখন আমার সাথে যেকোনো কিছু নিয়ে কথা বলছেন, তখন তাঁর যেকোনো কথাই আপনাকে আর একবার ভাবতে বাধ্য করবে। আপনার মস্তিষ্ককে অন্যভাবে ভাবতে শেখাবে। আমি সবসময় তাঁর সাথে কথা বলি, প্রচুর প্রশ্ন করি। আমি জানি, আমার সাফল্য নির্ভর করছে আমার কনফিডেন্সের উপর, বড় কোনো টেকনিক্যাল পরিবর্তনের উপর নয়।
গত বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সকালবেলায় সে আমাকে বলেছিলো পাঁচ উইকেট নিতে। ওই ম্যাচে আমি চার উইকেট পেয়েছিলাম, এরপর যখন ড্রেসিংরুমে ফিরলাম, উনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার কথা রাখো নাই, এক উইকেট কম ছিলো।’
আপনার বোলিংয়ে কি এমন কোনো ট্রিগার পয়েন্ট আছে, যেটা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে?
উইকেট পাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস যোগাতে পারে। কিন্তু প্রথম বলটা আপনি যেখানে করতে চাইছেন, সেখানেই করতে পারার উপরও অনেকটাই নির্ভর করে। একটা ইনসুইঙ্গার বা আউটসুইঙ্গার যখন হঠাৎ হয়ে যায়, আর যখন আপনি নিজ ইচ্ছেয় সেটা করতে পারেন, দুটোর মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। যখন এটা আপনি নিজে নিজেই করতে পারবেন, আপনার নিয়মিত উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যাবে। হঠাৎ আসা ইনসুইঙ্গার বা আউটসুইঙ্গার বা যেকোনো ডেলিভারিই ব্যাটসম্যানকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, কেননা বোলার নিজেও জানে না কীভাবে কি হচ্ছে!
আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়, ডানহাতি বা বাঁহাতি যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্যই আমি প্রথম বলটা অফ স্ট্যাম্পের ঠিক উপরে রাখার চেষ্টা করি। সেটা রাখতে পারলেই আমার কনফিডেন্স চলে আসে। এটা ব্যাপার না যে সে এটা ডিফেন্ড করছে নাকি ড্রাইভ খেলে চার মেরে দিচ্ছে। চার হয়ে গেলে কিছুটা খারাপ তো লাগেই, কিন্তু তবু এই কনফিডেন্সটা থাকে যে যেখানে ফেলতে চেয়েছিলাম ওখানেই ফেলতে পেরেছি। আমার মনে হয় প্রথম বলটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশি বোলারদের একটা সমস্যা দেখা যাচ্ছে, উইকেট পাওয়ার পরপরই হঠাৎ যেন বাজে কিছু বল ডেলিভারি করে ফেলে। এই সমস্যাটা নিয়ে সেভাবে কিছু ভেবেছেন?
আমার মনে হয় অভিজ্ঞতাটা একটা বড় ব্যাপার। আমাদের বোলিং অ্যাটাকে অধিকাংশই বেশ অনভিজ্ঞ। মুস্তাফিজুর খুব কম সময়ের মধ্যেই দারুণ সাফল্য পেয়েছে, আর ধীরে ধীরে তাঁর সাফল্যের হার এখন কমে আসতেই পারে। সবসময় আপনি তাঁর থেকে পাঁচ উইকেট আশা করতে পারেন না। প্রতিপক্ষ সবসময়ই তাঁকে এখন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে, আর তাঁদের যদি মনে হয় যে মুস্তাফিজকে ঠেকানো সম্ভব, একটা উইকেট-টেকিং অপশন কিন্তু কমে যাবে। আমার মনে হয়, মুস্তাফিজুর, তাসকিন, রুবেলরা সময়ের সাথে সাথে আরো শাণিত হবে।
ক্রিকেটারদের পরিচর্যার জন্য বাংলাদেশের এখন খুব ভালো কয়েকজন কোচ আছেন। তাঁরা এই টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই কাজ করবেন এবং আমার মনে হয় সমস্যাটা খুব বেশিদিন থাকবে না। আমরা খুব দ্রুত এটা দূর করতে সক্ষম হবো বলেই আশা করি।
শ্রীলংকা ট্যুর থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিটা কী বলে আপনার মনে হয়?
নিঃসন্দেহে মেহেদী হাসান, ওর এবারই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অভিষেক হলো। ওর মধ্যে সবচেয়ে দেখার মত ব্যাপারটা হলো ওর ইতিবাচক মানসিকতা। এটা আমাকে আসলেই অবাক করে দিয়েছে।
তৃতীয় ওয়ানডেতে আমি যখন ২৬তম ওভারে ক্রিজে যাই, আমি ওকে বললাম ৪১ ওভার পর্যন্ত একসাথে ব্যাটিং করবো। আমরা বেশ কিছু উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম, খুব একটা ভালো অবস্থানে ছিলাম না ম্যাচে। এরপর এক ওভার মেডেন দেওয়ার পর ও এসে আমাকে বললো এভাবে খেলা সম্ভব নয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? ও বললো, দুই রানে হারাও যা, ১৫০ রানে হারাও তাই। তার চেয়ে বরং পজিটিভলি খেলি, তাতেই যদি জেতার সম্ভাবনাটা বাড়ে।
পরের ওভারে আমি দুটো চার মারলাম, মিরাজও মারলো। মিরাজ তখন আমাকে এসে বললো, আমরা এভাবেই খেলি আর এখন এভাবেই খেলবো। ম্যাচটা আমরা হেরে গিয়েছি, কিন্তু ওর এই ইতিবাচক মানসিকতাটা দারুণ লেগেছে আমার।
পরেরদিন রাতে সে আমাদেরকে কিছুটা অভিনয় দেখালো, ছোটবেলায় করেছিলো ওরকম। খুব মজার ছিল ব্যাপারটা, তবে ও ছাড়া আমাদের মধ্যে আর কেউ করতে পারতাম না জিনিসটা। এটা অফ দ্য ফিল্ড একটা ব্যাপার, কিন্তু সেখানেও সে দারুণ কনফিডেন্ট একটা ছেলে। আমার মনে হয় ওর খেলায় এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গত মাসে গল টেস্টের পর পরিবর্তনগুলো নিয়ে অনেক কথাবার্তা শোনা গেছে, যার মধ্যে একটা ছিল টি-টোয়েন্টিতে আপনার অবস্থান। এই ফরম্যাট থেকে সম্প্রতি আপনি অবসরগ্রহণ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার এই সিদ্ধান্তে অন্যদের প্রভাব কতটা ছিলো, নাকি এটা একদমই আপনার নিজস্ব সিদ্ধান্ত?
অনেকেই অনেক কিছু শোনে, আর এর মধ্যে নিজের প্রয়োজনমত অনেক কিছুই ভুলে যায়। ম্যান-টু-ম্যান এটাও নির্ভর করে যে সে ব্যাপারগুলো ইতিবাচকভাবে নেবে নাকি নেতিবাচকভাবে।
নেতিবাচক ব্যাপারগুলো আমার মধ্যেও কাজ করে মাঝেমধ্যে, তবে আমি এটাও বিশ্বাস করি যে আমার সিদ্ধান্তগুলো আমি নিজেই নেবো। সবকিছু নির্ধারিত হবে আমার অন-ফিল্ড পারফরম্যান্সের উপরই। ক্যারিয়ারের সিদ্ধান্তগুলো নিজেকেই নিতে হয়।
আমার মনে হয় না অন্যদের কথাবার্তা শুনে আমাকে নেতিবাচক মানসিকতায় পেয়ে বসে। তবে হ্যা, মানসিক চাপ তো একটা থাকেই। আপনাকে এটাও বুঝতে হবে, এই মেন্টাল প্রেশার তৈরির মাধ্যমে আপনার চারিদিকে অন্যরকম একটা পরিবেশও তৈরি হচ্ছে। আর সেটা শুধু আপনার নিজের বোঝাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন।
--------------------
সাক্ষাৎকারটা ইএসপিএন ক্রিকইনফোর জন্য নিয়েছেন ক্রিকেট বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় এই গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইশাম। অনুবাদ করেছেন অর্ক সাহা।
১৫ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/টিটি/পিএস