আরিফুর রহমান বাবু: টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি- দেশের হয়ে সব ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি রান তার। ওই তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বাধিক সেঞ্চুরির মালিকও তিনি। এমন সমৃদ্ধ পরিসংখ্যানই তাকে দেশের অন্যতম সেরা ও সফল ব্যাটসম্যানের তকমা গায়ে এঁটে দিয়েছে।
শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেই নয়। ঘরের ক্রিকেটেও তামিম ইকবাল এক সফল ব্যাটসম্যানের প্রতিমূর্তি। সেই আশির দশকের শুরুর দিকে সৈয়দ আশরাফুলের করা ডাবল সেঞ্চুরিটিকে ব্র্যাকেটবন্দী (তখন প্রিমিয়ার লিগ ছিল না, ওই আসর ছিল সিনিয়র ডিভিশন ক্রিকেট লিগ) করলে ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে এক ম্যাচে সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত স্কোরটিও (ফতুল্লা স্টেডিয়ামে ২০০৫ সালে ১৮০+) তামিম ইকবালের।
এবার লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও দেশের হয়ে সবচেয়ে লম্বা ইনিংস স্রষ্টা বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বিখ্যাত খান পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের। আজ বিকেএসপিতে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের বিরুদ্ধে তার ব্যাট থেকে যে ১৫৭ রানের ইনিংস বেরিয়ে এসেছে, সেটা লিস্ট ‘এ’ ক্যাটাগোরিতে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যাানদের খেলা সবচেয়ে বড় রানের ইনিংস।
লিস্ট এ ক্রিকেটে এর আগের দীর্ঘ ইনিংসটিও ছিল তার (২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৫৪)। আগেরবার আবাহনীর হয়ে লিগের শেষ ম্যাচে আম্পায়ারের সাথে অসাদাচারণ করে এক ম্যাচ সাসপেন্ড হয়েছিলেন। সেই শাস্তি ভোগ করতে হলো এবার।
তাইতো মোহামেডানের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে পারেননি তামিম। মঙ্গলবার অসহনীয় গরম ও প্রাণ ওষ্ঠাগত উত্তাপে প্রথম দিন খেলতে নেমেই বাজিমাত এ বাঁহাতি ওপেনারের। ১২৫ বলে ১৫৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। যে গরমে খোলা আকাশের নিচে ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা দায়, সেখানে তামিম আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় ক্রিজে কাটিয়েছেন।
হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল। আউট হয়েছেন ইনিংস শেষ হওয়ার আগে। খেলা দেখা শ‘ তিনেক ক্রিকেট অনুরাগীর প্রায় সবার কথা, একটু দেখে ও ভেবেচিন্তে খেললে হয়তো ডাবল সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারতেন। দিন শেষে তামিম নিজেও তা স্বীকার করেছেন। খেলা শেষে মাঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আলাপে অকপটে স্বীকার করেছেন,
তার ডাবল সেঞ্চুরির পথে বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল গরম। ‘প্রচণ্ড গরমে কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। আর শরীর চলছিল না।’
প্রচণ্ড গরমে ইনিংসের শেষ দিকে পায়ের মাসলে ক্র্যাম্পও করেছিল। অমন গরমে অত বড় ইনিংস খেলে শুধু দর্শক-ভক্ত ও মোহামেডান সমর্থকদের প্রশংসায় ধন্য হননি। প্রতিপক্ষ শিবির কলাবাগান ক্রীড়া চক্রর ক্রিকেটার, কোচ ও কর্মকর্তা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেছেন তামিম ইকবালই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। অমন গরমে তার ব্যাট থেকে আসা লম্বা ইনিংসটিই মোহামেডানের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে।
এমন ভালো ও স্মরণীয় ইনিংস খেলার পুরস্কার হিসেবে ম্যাচসেরা পারফরমারও হয়েছেন তামিম। কিন্তু কঠিন সত্য হলো তামিম আজ মাঠে এমন এক কাজ করেছেন, যা আইন ও নিয়মের পরিপন্থী না হলেও চরম দৃষ্টিকটু। আজ বিকেএসপির চার নম্বর মাঠে ব্যাটিংয়ের সময় তামিম পানি পান করেছেন চেয়ারে বসে।
ভাবছেন, প্রচণ্ড গরমে মাঠ ছেড়ে ড্রেসিং রুমে এসে চেয়ারে বসে বুঝি পান পান করেছেন। কিংবা মাঠ থেকে বেরিয়ে সীমানার বাইরে এসে রিজার্ভ বেঞ্চে বসা ক্রিকেটারদের চেয়ারে বসেই হয়তো জলপান করেছেন তামিম। তাহলে কথাই ছিল না।
বিষয়টি মোটেই তা নয়। তামিম যেটা করেছেন, সেটা সত্যিই দৃষ্টিকটু। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা ক্রিকেটারদের ডেকে মাঠের ভেতর চেয়ার নিয়ে গিয়ে তাতে বসে পানি পান করার মতো প্রায় অস্বাভাবিক কাজটি করেছেন দেশ বরেণ্য ক্রিকেটার। তাও একবার নয়। দুবার।
রিঙ্কসের সময় হলেই মোহামেডানের রিজার্ভ বেঞ্চের ক্রিকেটাররা তামিম ইকবালের জন্য মাঠে পানি, কলা, কমলালেবুর পাশাপাশি চেয়ারও নিয়ে গেছেন। তাতে বসেই তামিম পানি পান করেছেন। ব্যাটিংয়ের শেষ দিকে খোড়াচ্ছিলেন।
কলাবাগান ইনিংসের তিন ভাগের এক ভাগ না যেতেই খুড়িয়ে খুড়িয়ে মাঠ ছেড়ে চলেও আসেন। আর মাঠে ফেরেননি। তার বদলে অধিনায়কত্ব করেন রকিবুল হাসান।
মানা গেল, প্রচণ্ড গরমে তার কষ্ট হচ্ছিল। পায়ে ক্র্যাম্পও হয়েছিল। তাই দুই তিন মিনিট বসে বিশ্রাম নিতে চেয়েছেন।
সেটা মাঠে বসেই নেয়া যেত। কিংবা সীমানার বাইরে রিজার্ভ ক্রিকেটাররা যে চেয়ারে বসেছিলেন, সেখানে এসে তাদের পাশে বসেই পানি পান করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তামিম মাঠেই চেয়ার পেতে বসেম পানি পান করলেন। এটা যে আইনের লঙ্ঘন, তা নয়।
ক্রিকেট আইনে কোথাও এমন কথা লেখা নেই যে, পানি পানের বিরতিতে মাঠে চেয়ার নিয়ে যাওয়া যাবে না। তবে সাধারণত কেউ তা করেন না। এর চেয়ে গরমেও খেলা হয়। গরমে ঘেমে ক্লান্ত-অবসন্ন ক্রিকেটাররা মাঠে চোখে, মুখে পানি দেন সব সময়। কেউ কেউ ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মোছেন। কেউ বা আবার ঘামে ভেজা জার্সি বা গেঞ্জি বদলে আসেন।
কিন্তু মাঠে চেয়ার পেতে পানি পানের দৃশ্য প্রায় বিরল। অন্তত ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে এমন ঘটনা আগে চোখে পড়েনি। এটা আসলে চোখে লাগার মতো। তাই চক্ষুলজ্জার কথা ভেবে কেউ তা করেন না। করেননিও। কিন্তু দেশসেরা ওপেনার ও দেশ বরেণ্য ক্রিকেটার তামিম ইকবাল করলেন।
ম্যাচ রেফারি আখতার উদ্দীন শিপারের কাছে এ ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি বিব্রতবোধ করেন। জাগো নিউজের প্রতিবেদকের সাথে আলাপে শিপার বলেন, ‘বিষয়টা খানিক বিব্রতকর। কারণ আইনে কোথাও লেখা নেই যে, খেলা চলাকালীন মাঠে চেয়ার নিয়ে যাওয়া যাবে না। বা কেউ পানি পানের বিরতিতে মাঠে চেয়ার পেতে বসে পানি পান করতে পারবে না। তবে সাধারণত গরম বা শারীরিক সমস্যা যেমনই হোক না কেন, কেউ তা করে না। যেহেতু আজ তামিম করেছে, তাই আমি বিষয়টি নোটিশ করেছি। মোহামেডান শিবিরকে জানিয়ে দিয়েছি, চেয়ার মাঠে আনা-নেয়ার কারণে যদি পানি পানের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগে বা ব্যয় হয়, তাহলে আমি বিষয়টা নোটিশ করব। এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ হিসেবে দেখব। আমি বারবার বলেছি, যদি তামিম ইকবালের দেখাদেখি কলাবাগান ফিল্ডার-বোলাররাও মাঠে চেয়ার নিয়ে বসে পানি পান শুরু করে দেয়, তাহলে কেমন হবে ?’
বিষয়টি নিয়ে জাগো নিউজের সাথে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের কোচ দেশ বরেণ্য ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব জাতীয় দলের এবং মোহামেডান ও আবাহনীর সাবেক কোচ এবং বাংলাদেশ আম্পায়ার্স বোর্ডের সাবেক সম্পাদক জালাল আহমেদ চৌধুরীও কথা বলেন।
তিনি এ সম্পর্কে কোনোরকম নেতিবাচক মন্তব্য না করলেও বিষয়টিকে বেশ দৃষ্টিকটু বলে মন্তব্য করেছেন। তার কথা, ‘ক্রিকেটাররা সাধারণত মাঠে চেয়ার পেতে পানি পান করে না। কারো খারাপ লাগলে ড্রেসিং রুমে গিয়ে কয়েক মিনিট বসে আসতে পারে। কিন্তু তাই বলে মাঠে চেয়ার নিয়ে বসে পানি পান করা চোখে লাগে বৈকি।’
ক্রিকেটের প্রচলিত আইনে পানি পানের বিরতিতে মাঠে চেয়ার পেতে পানি পান করার পক্ষে-বিপক্ষে সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। তাই হয়তো তামিম শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। কিন্তু সাধারণত এমন কাণ্ড কেউ করেন না। তামিম এক নজিরবিহীন ঘটনারই জন্ম দিলেন।-জাগোনিউজ
১৮ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/এপি/ডিসি