রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭, ০১:১২:৫৬

বাবা বেঁচে থাকলে আজ আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করতে পারতেন: সাইফউদ্দিন

বাবা বেঁচে থাকলে আজ আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করতে পারতেন: সাইফউদ্দিন

স্পোর্টস ডেস্ক: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকটা সাদামাটাই হয় মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের। শ্রীলঙ্কা সফরে টি-টোয়েন্টি অভিষেকে দুই ম্যাচে মাত্র এক উইকেট পান ডানহাতি এই পেস বোলার। শুরুতে সেভাবে নজর কাড়তে না পারায় আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ এবং চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা হয়নি ২০ বছর বয়সী এই উঠতি ক্রিকেটারের। জাতীয় দলের এই অপার সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার খেলাধুলা.কমে মুখোমুখি হয়েছেন শনিবারের বিশেষ সাক্ষাৎকারে। নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প, জাতীয় দলের হয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর ক্রিকেট খেলে যাওয়ার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

কি ভাবে ক্রিকেটার হয়ে উঠলেন?

আসলে ২০০৯ সাল থেকে আমার ক্রিকেট খেলা শুরু। তখন আমি ফেনীর শাহীন একাডেমিতে পড়াশুনা করতাম। স্কুল থেকেই আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু। স্কুল ক্রিকেটে ভালো খেলার পর ফেনী জেলার হয়ে বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন দলে যেমন অনুর্ধ্ব-১৪, ১৬ এবং ১৮তে খেলেছি। বয়স ভিত্তিক দলে ভালো করায় পর্যায়ক্রমে উপরের লেভেলে খেলার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছি। তখন আমার পারফরম্যান্স ভালো ছিলো না। ভারো করতে না পারায় দল থেকে বাদ পড়ে যাই। বয়স থাকায় পরবর্তীতে আবার যুব বিশ্বকাপে ডাক পাই। লক্ষ্য ছিলো ভালে কিছু করব। কোন একটা পর্যায়ে নিজের জায়গা করে নিবো। এমন একটা টার্গেট ছিলো। এটা ফুলফিল হয়েছে। এর পাশাপাশি জাতীয় লিগ, বিসিএল, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ভালো খেলাতে হয়ত আমি জাতীয় পর্যায়ে এসেছি।

কোন ক্লাবের হয়ে ক্রিকেটে হাতে খড়ি?

ফেনিতেই আমার ক্লাব ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু। যে ক্লাবের হয়ে ২০০৮ সালে আমি দ্বিতীয় বিভাগে খেলেছি। ঢাকাতে আমি প্রথমে গুলশান ইয়ুথ ক্লাবের হয়ে কোয়ালিফাই খেলেছি। এরপর ঢাকা ক্রিকেটার্সের হয়ে তৃতীয় বিভাগে, সিসিএসের হয়ে প্রথম বিভাগে খেলেছি। এরপর প্রিমিয়ার লিগেও খেলছি। এবার আবাহনীর হয়ে খেলছি। আর বিপিএলে খেললাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে।

কখন থেকে মনে হলো ক্রিকেটটাকে পেশা হিসেবে নেয় যায়?

২০১০-১১মৌসুমে যখন আমি এজ লেভেল ক্রিকেটটা খেলি (অনুর্ধ্ব-১৫ দলে)। তখন আমি শখের বসে ক্রিকেট খেলতাম। বন্ধুরা খেলে আমি তাদের সাথে খেলতাম। খুব ভালো লাগতো। সেই সময়ে টেপ টেনিস বলে খেলতাম। পরের বছর অনুর্ধ্ব-১৬ বিভাগীয় দলে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হলাম, কয়েকটা ম্যাচে দলের জয়ের পেছনে আবদান রাখার পর আমাকে নিয়ে অনেক হই হই হয় জেলায়। তারপর থেকেই মূলত আমি ক্রিকেটটাকে পেশা হিসেবে বেঁছে নিয়েছি। তখন থেকেই আমার ধ্যান-জ্ঞান ক্রিকেটে নিবিষ্ট করতাম।

খেলার জন্য পরিবার থেকে সমর্থন পেয়েছেন?

প্রথম দিকে সেভাবে সাপোর্ট পাইনি। ২০০৮ সালে আমার বাবা মারা যান। যে কারণে শুরুর দিকে খেলার জন্য পরিবার থেকে সাপোর্ট পাইনি। তখন পরিবার থেকে চাইতো, খেলা ছাড়া অন্যকিছু একটা করি। পড়াশুনা বা চাকরি-বাকরি বা আদার্স কিছু। এরপর যখন আমি অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে ভারত সফরে যাই। তারপর থেকে আমি আমার পরিবারকে বলেছি, ক্রিকেটে ভবিষ্যত আছে। এছাড়া আমার ক্লাবের বড় ভাইরাও আমার মাকে বুজিয়েছেন। তারা বলেছেন ওকে ক্রিকেট খেলতে দেন, দেখবেন একদিন ভালো করবে। ওর মধ্যে মেধা আছে। এরপর থেকে আম্মু আমাকে আর কখনো ক্রিকেট খেলতে নিষেধ করেননি। তারপর থেকে যখন আমার খেলা থাকতো বা অনুশীলনে যেতাম, তখন মা আমাকে ভোর সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। ব্যাগে সব জিনিসপত্র নিয়েছি কিনা তা দেখতেন। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে আমার জন্য নাস্তা তৈরি করে দিতেন।

ক্রিকেটের জন্য বাবার সমর্থন পেয়েছেন?

আসলে তখন আমি তেমন ক্রিকেট খেলতাম না। বাবা থাকা অবস্থায় আমি পাড়ায় ক্রিকেট খেলতাম। তখন তেমন বড় আসরে আসা হয়নি। তবে বাবাও ক্রিকেটের প্রতি আসক্ত ছিলেন। তিনিও ক্রিকেট খেলা পছন্দ করতেন। বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় বলতেন আগে পড়াশুনা তারপর খেলাধুলা। ওই রকম আরকি, খেলাধুলানর জন্য মানা করতেন, ডাক দিতেন। তবে খেলার জন্য মারধর করতেন না। বাবা পুলিশের চাকরী করতেন। কাজের কারণে বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতেন। খুব কম আসতেন। হয়ত ঈদের সময় ছুটিতে আসতেন। বাড়িতে এলে আমাদের নিয়ে ভালো সময় কাটাতেন। তেমন রাগ করতেন না। বাবাকে খুব কম সময় কাছে পেয়েছি। ঐরকম শাসন করতেন না, আদরই বেশি করতেন। আমরা তিন ভাই দুই বোন। বাবা বাড়িতে এলে সবাইকে সাথে নিয়ে খাবার খেতেন। খুব মজা করতেন।

আপনি এখন জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন, বাবা আপনাকে এই অবস্থায় দেখলেন নিশ্চয়ই খুশি হতেন?

হ্যা, অবশ্যই। বাবা থাকলে অনেক খুশি হতেন। যখন আমি জাতীয় দলে সুযোগ পাই তখন আমার অনেক খারাপ লাগছিলো। আপনারা সবাই দেখছেন, খেলা চলা অবস্থায় মুশফিক ভাইয়ের বাবা মাঠে আসেন। খেলা দেখেন, সবাইকে উৎসাহ দেন। তেমনি তাসকিন আহমেদের বাবাও মাঠে আসেন, উৎসাহ যোগান। আমার বাবা বেঁচে থাকলে তিনি মাঠে আসতেন। উৎসাহ দিতেন কাছ থেকে। এই জিনিসগুলো আমি অনেক ফিল করি। আমার বাবা থাকলে আজ আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করতেন।

জাতীয় দলে কল পাওয়ার ব্যাপারে আপনি কতোটা আত্নবিশ্বাস ছিলেন?

আমাদের দলে খেলা (অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে) মেহেদী হাসান মিরাজ যখন জাতীয় দলে ডাক পেলো। যুব দল থেকে সবার আগে মিরাজের ডেবু হয়। এরপর নাজমুল হোসেন শান্ত সুযোগ পায়। ওনারা সুযোগ পাওয়ার পর থেকেই মনে হয়েছে, একদিন আমরাও সুযোগ আসবে। যদি ভালো করতে পারি। মিরাজ ভাইয়ের খেলা দেখে আমি অনুপ্রনিত হয়েছি। তখন আমার মনে হয়েছে ঘরোয়া লিগে ভালো করলে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসবো। এজন্য আমি ঘরোয়া লিগের টুর্নামেন্টগুলোকে টার্গেট করেছি, প্রথমে বিসেএলে ভালো করেছি। সেখানে ভালো করায় নির্বাচকদের নজরে আসতে পেরেছি। তবে আমার মনে হয় এমার্জিং কাপে (অনুর্ধ্ব-২৩) ভালো করায় জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এমার্জিং কাপে আমি বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট টেকার হয়েছি (চার ম্যাচে ৭ উইকেট, পাশাপাশি ৬৮ রান করেছি)। এই পারফরম্যান্সের কারণেই আমি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছি।

মাত্র দুইটা টি-টোয়েন্টি খেলেই দল থেকে বাদ পড়ে গেলেন। আপনার কি মনে হয় এখন জাতীয় দলে টিকে থাকা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং?

হ্যা, অবশ্যই অনেক চ্যালেঞ্জিং। খেলাটা বড় কথা না। জায়গাটা ধরে রাখা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আগের চেয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন। আসলে যখন খেলার ইচ্ছা ছিলো খেলে ফেলেছি। খেলার পর এখন মনে হচ্ছে আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। অনেক বেশি টাসে থাকতে হবে। দেশকে আরো কিছু দেয়ার আছে। এট লিস্ট ১০-১৫ বছরের জন্য জাতীয় দলে খেলার টার্গেট সেট করতে হবে আমাকে। ইনশাআল্লাহ ঐরকম পরিশ্রম করতেছি।

জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ায় ভেতরে ভেতরে হতাশা কাজ করে?

আসলে কেউ ইচ্ছে করে খারাপ করতে চায়না। সাবাই চায় সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। আসলে উইকেট জিনিসটা কপালে থাকা লাগে। চাইলে আসলে হয় না। আমার বোলিংটা আসলে ভালো হয়েছে। আমি নিজে খুশি। আরো ভালো করতে পারলে ভালো হতো। দ্বিতীয়তো হলো ব্যাটিং সেভাবে পাইনি। মাত্র পাঁচটা বল পাইছিলাম। আশা করি সামনে বোলিং, ব্যাটিং এবং ফিল্ডিংয়ে আরো ভালো কিছু করতে পারব। দল থেকে বাদ পড়ায় এটা নিয়ে আমার মধ্যে কোন হতাশা নেই। আমি চেষ্টা করবো ঘরোয়া লিগে সেরাটা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে। সুযোগ আমার সামনে আসবেই। আমি যদি ফিট থাকি, আর নিয়মিত পারফরম করে যেতে পারি তাহলে সুযোগ আজ না হয় কাল পাবোই।

টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফি ভাইয়ের অবসরে আপনাদের মতো তরুণদের উপর দায়িত্ব চলে এসেছে। এটা কতটা চ্যালেঞ্জিং?

অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং। ক্রিকেট তো মানুষ সারা জীবন খেলে না। একটা সময় আসলে সবাইকেই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। মাশরাফি ভাইও তাই করেছেন। একটা সময়ে এলে আমাকেও জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তবে তিনি অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। তার মতো আইডল ক্রিকেটার পাওয়াটা সত্যি অনেক কঠিন। ক্রিকেট বোর্ড যদি পেস বোলিংয়ের সেই জায়গাটায় আমাকে মনে করে, ভাবিষ্যতে যদি সুযোগ পাই তাহলে আমি আমার শতভাগ দেয়ার চেষ্টা করব। এই দায়িত্বের ব্যাপারে অনেকেই বলে, আমি নিজেও জানি। বাংলাদেশে পেস বোলিং অলরাউন্ডার খুব কম। আমিও চাচ্ছিনা অনেকের মতো হইতে, আসলাম, খেললাম আর চলে গেলাম। এমনটা আমি চাই না। আমি যখনই টিমে সুযোগ পাবো চেষ্টা করব জায়গাটা পাকাপুক্ত করে নিতে। এটাই আমার লক্ষ্য।
৩০ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে