ভারতের ভরাডুবির ম্যাচে রেকর্ডের ছড়াছড়ি
নজরুল ইসলাম, মুম্বাই থেকে: মুম্বাইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের ফুড বাজারে সাতসকালেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সেই অগ্নিকাণ্ডের লেলিহান শিখা ওয়াংখেড়ে পর্যন্ত পৌঁছনোর সুযোগ ছিল না। দমকলবাহিনীর অক্লান্ত প্রয়াসে নিমেষেই আগুন নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু রবিবারের দ্বিপ্রহরে ওয়াংখেড়ের বাইশগজে প্রোটিয়াদের আগুন নেভাবে কে? না, ধোনির হাতে তেমন কোনও দমকলবাহিনী ছিল না, যা দিয়ে নেভাতে পারতেন ডি’কক, ডু’প্লেসিস, ডি’ভিলিয়ার্সদের ব্যাটের আগুন।
এই ত্রয়ীর দাপটেই পুড়ে ছারখার ধোনির বোলিং–সংসার। যে বোলিং ছিল ‘ক্যাপ্টেন কুল’–এর গর্ব, এক লহমায় সেই গরিমা ধুয়ে–মুছে সাফ হয়ে গেল আরব সাগরের জলে। মেরিন ড্রাইভে আছড়ে–পড়া ঢেউয়ের মৃদু গর্জনকে ম্লান করে দিয়ে ধোনি–সাম্রাজ্যের ওপর বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়ে গেল প্রোটিয়ারা। বিদেশের মাটিতে গত কয়েক বছরে সিরিজ জয়ের রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখল ডি’ভিলিয়ার্স বাহিনী।
লজ্জা, চরমতম লজ্জায় মুখ ঢাকল ভারতীয় বোলিং। অল্পের জন্য একদিনের ম্যাচে নিজেদের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও ভারতীয় বোলারদের গলি ক্রিকেটের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল প্রোটিয়ারা। ফিল্ডিংয়ের নতুন নিয়মের ফলে ইদানীং নাকি শেষ ১০ ওভারে ৬০–৭০ রানের বেশি তোলা যাচ্ছে না। ভারতীয় অধিনায়কের এটাই পর্যবেক্ষণ। দক্ষতা থাকলে নিয়ম কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, দেখিয়ে দিয়ে গেলেন ডি’ভিলিয়ার্স, ডু’প্লেসিসরা।
শেষ ১০ ওভারে ১৪৪ রান তুলে ফেললেন প্রোটিয়ারা। তা–ও আবার পেশিতে টান ধরে ‘ল্যাংড়া’ হয়ে–যাওয়া ডু’প্লেসিস বাইশগজে থাকা সত্ত্বেও। দৌড়তে পারছিলেন না, তাই খুচরো রানের রাস্তায় গেলেন না। ওভার বাউন্ডারি তো আর ফিল্ডার দিয়ে আটকানো যাবে না। প্রোটিয়াদের ৪৩৮ রানের ইনিংসে ৩৮টি বাউন্ডারি, ২০টি ছয়। এর মধ্যে ১১টি ছয় এল ডি’ভিলিয়ার্সের ব্যাট থেকে, ৬টি ডু’প্লেসিসের।
ভারতীয় শিবির প্রোটিয়া অধিনায়ককে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিল। কিন্তু সিঁদ কেটে অন্য কেউ যে চুরি করে নিয়ে যেতে পারে, স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। ডি’কক, ডু’প্লেসিসদের গুরুত্ব না দেওয়ার মাশুল দিতে হল। ভারতের বিরুদ্ধে ডি’ককের সাফল্যের কথা ভুলে গেলেন ধোনিরা ? ২০১৪–এ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টানা তিনটি শতরানের কথা মনে ছিল না?
এক বছরের পুরনো কথা না হয় বাদই দেওয়া হল, এই সিরিজে শতরানের কথাও তো মাথায় থাকা উচিত। ডু’প্লেসিসের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মটা গড়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। যার ওপর দাঁড়িয়ে ইমারত তৈরি করলেন ডি’ভিলিয়ার্স। একদিনের ম্যাচে এক ইনিংসে তিনটি শতরানের নজির এর আগে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকারই। এই বছর ১৮ জানুয়ারি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে জোহানেসবার্গে করেছিলেন আমলা, রসোউ ও ডি’ভিলিয়ার্স। নিজেদের সেই রেকর্ডকে ওয়াংখেড়েতে আবার সেই ফিরে দেখা। ডি’ভিলিয়ার্সের সঙ্গী এবার ডি’কক, ডু’প্লেসিস ।
৮৭ বলে ১০৯ রানের ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরার সময় ডি’কক পেছন ফিরে দেখছিলেন, ভারতীয় বোলিং শুয়ে পড়েছে। ভি ভি আই পি বক্সে নীতা আম্বানি, মুকেশ আম্বানিদের সঙ্গে বসে খেলা দেখতে আসা জাহির খানের হাত নিশপিশ করছিল কি না কে জানে? তবে ধোনির সংসারে জাহিরের মতো বোলােরর অভাব বারবার ফুটে উঠল। ব্রেক থ্রু দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর মতো পারদর্শী বোলার যে এই ভারতীয় দলে নেই।
ভারতীয় বোলিংয়ের দৈন্যের সুযোগ নিয়ে ডু’প্লেসিস (১১৫ বলে ১৩৩) তো খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে গেলেন। পেশিতে টান ধরে তঁাকে মাঠ ছাড়তে হওয়ায় একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড চাক্ষুষ করার সুযোগ সম্ভবত হারালেন ওয়াংখেড়ের দর্শকরা। আর ভারতীয় বোলিংকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন ডি’ভিলিয়ার্স (৬১ বলে ১১৯)।
বেচারি ভুবনেশ্বর কুমার। তিনিও শতরান করে গেলেন। তবে ব্যাটে নয়, বোলিংয়ে। ১০ ওভারে ১০৬! অল্পের জন্য অস্ট্রেলিয়ার মিক লিউসের রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না। ১০ ওভারে ১১৩ রান দেওয়ার নজির রয়েছে লিউসের। সেবারও কিন্তু বিপক্ষে ছিল এই দক্ষিণ আফ্রিকা। অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ রান তাড়া করে জিতেছিল প্রোটিয়ারা। ভারত কিন্তু পারল না, পারার কথাও ছিল না।
শুধু ভুবনেশ্বর কুমারকে খলনায়কের আসনে বসানো ঠিক হবে না। প্রোটিয়াদের সংহারমূর্তির হাত থেকে রেহাই পাননি মোহিত, হরভজন, অক্ষর, অমিতরাও। পঁাচ স্বীকৃত বোলার থাকতেও কোহলি, রায়নাদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছিলেন ধোনি। খলনায়কের আসনে বসানো যেতে পারে ওয়াংখেড়ের বাইশগজকেও। বোলারদের বধ্যভূমি ছাড়া আর কোনও বিশেষণ হয়ত প্রযোজ্য নয়। তার প্রমাণ ভারতীয় ইনিংসেও। শিখর ধাওয়ান, অজিঙ্কা রাহানেদের ফর্মে ফেরার জন্য ওয়াংখেড়ের অবদান কম নয়। ব্যাটিংয়ের স্বর্গোদ্যানে আসল কাজটা কিন্তু শুরুতেই করে ফেলেছিলেন ডি’ভিলিয়ার্স। সিরিজ নির্ধারণের ম্যাচে টসে জিতে শুরুতেই ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধোনিকে।
ওয়াংখেড়েতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। অথচ ৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে ১৪২টি একদিনের ম্যাচ খেলা হয়ে গেলেও জন্মভূমির বাইশগজে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ হয়নি। মুম্বইওয়ালারা তাকিয়ে ছিলেন বিরাট কোহলি ও ঘরের ছেলে রোহিত শর্মার দিকে। শচীনের পর ভারতীয় ক্রিকেটে যিনি মুম্বইয়ের ‘মুখ’, মুম্বইয়ের ব্যাটন বহনের দায়িত্ব যাঁর হাতে, সেই রোহিত শর্মাও (১৬) হতাশ করলেন। রাবাদার বলে নিজের বয়ফ্রেন্ডকে ‘সুইসাইড’ করতে দেখে বক্সে বসা অনুষ্কা শর্মারও গালে হাত।
গোটা সিরিজে ভারতের ব্যাটিং যাঁদের ঘিরে কেন্দ্রীভূত, সেই রোহিত–কোহলিও ব্যর্থ। সাফল্য পেলেও প্রোটিয়াদের হিমালয়সমান রানের চূড়া টপকানো সম্ভব হত বলে মনে হয় না। শিখর ধাওয়ান (৬০) ফর্মে ফিরলেন, রান পেলেন অজিঙ্কা রাহানেও (৫৮ বলে ৮৭)। কিন্তু ওই দিয়ে কি আর চূড়ায় ওঠা যায়? লজ্জা হয়ত কিছুটা ঢাকা যেত, যদি বড় পার্টনারশিপ গড়ে উঠত। সেটাও সম্ভব হল না। ২২৪ রানে শেষ ভারত, হার ২১৪ রানে। ভারতীয় ইনিংসের ৩৩তম ওভারে ভি ভি আই পি বক্সে শচীনের আগমন ঘটতেই ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ‘শচীন শচীন’ আওয়াজ। ধোনিদের লজ্জাজনক হারের সাক্ষী থাকলেও বোলিংয়ের দৈন্য দেখার সুযোগ হল না।
ওয়াংখেড়েতে সাফল্য নেই, চাপের মুখে নতজানু, ‘চোকার্স’— প্রোটিয়াদের সম্পর্কে কতই না তকমা সেঁটে গেছে। প্রেশারের ম্যাচে নাকি ব্যর্থ। ডি’ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকা কিন্তু সেই ঐতিহ্য ভেঙে দিয়ে গেল আরব সাগরের তীরে, মেরিন ড্রাইভে ভারতের ওপর রোলার চালিয়ে।
২৬ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি
�