দিয়েগো মারাদোনার পূর্ণাঙ্গ জীবনী (১ম পর্ব)
স্পোর্টস ডেস্ক: দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার জন্ম ৩০ অক্টোবর ১৯৬০ সাল। তিনি একজন আর্জেন্টিনীয় ফুটবল কোচ সেইসাথে একজন ম্যানেজার এবং প্রাক্তন খেলোয়াড়। অনেক বিশেষজ্ঞ, ফুটবল সমালোচক, প্রাক্তন ও বর্তমান খেলোয়াড় এবং ফুটবল সমর্থক তাকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে গন্য করেন।তিনি ফিফার বিংশ শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ে পেলের সাথে যৌথভাবে ছিলেন।
মারাদোনাই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুইবার স্থানান্তর ফি এর ক্ষেত্র বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। প্রথমবার বার্সেলোনায় স্থানান্তরের সময় ৫ মিলিয়ন ইউরো এবং দ্বিতীয়বার নাপোলিতে স্থানান্তরের সময় ৬.৯ মিলিয়ন ইউরো। নিজের পেশাদার ক্যারিয়ারে মারাদোনা আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেছেন। ক্লাব পর্যায়ে তিনি তার নাপোলিতে কাটানো সময়ের জন্য বিখ্যাত, যেখানে তিনি অসংখ্য সম্মাননা জিতেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি ৯১ খেলায় ৩৪ গোল করেন।
তিনি চারটি ফিফা বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন। যার মধ্যে ছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপ, যেখানে তিনি আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং দলকে বিশ্বকাপ জয়ে নেতৃত্ব দেন। প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে স্বর্ণ গোলক জিতেন তিনি। প্রতিযোগিতার কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা ২–১ গোলে জয় লাভ করে। আর্জেন্টিনার পক্ষে উভয় গোলই করেন মারাদোনা। দুইটি গোলই ফুটবল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দুইটি ভিন্ন কারণে। প্রথম গোলটি ছিল হ্যান্ডবল যা “হ্যান্ড অফ গড” নামে খ্যাত। দ্বিতীয় গোলটি মারাদোনা প্রায় ৬০ মিটার দূর থেকে ড্রিবলিং করে পাঁচজন ইংরেজ ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে করেন। ২০০২ সালে ফিফাডটকম এর ভোটাররা গোলটিকে শতাব্দীর সেরা গোল হিসাবে নির্বাচিত করে।
মারাদোনাকে ক্রীড়া জগতের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং সংবাদ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গের অন্যতম মনে করা হয়। ১৯৯১ সালে ইতালিতে ড্রাগ টেস্টে কোকেইনের জন্য ধরা পড়ায় ১৫ মাসের জন্য ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ইফিড্রিন টেস্টে ইতিবাচক ফলাফলের জন্য তাকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে তিনি তার কোকেইন নেশা ত্যাগ করেন। তার কড়া রীতি মাঝেমাঝে সাংবাদিক এবং ক্রীড়া সংশ্লিষ্টদের সাথে তার মতভেদের সৃষ্টি করে। ম্যানেজার হিসেবে খুব কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ২০০৮ সালের নভেম্বরে তাকে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১০ বিশ্বকাপের পর চুক্তি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আঠারো মাস এই দায়িত্বে ছিলেন।
প্রারম্ভিক জীবন
দিয়েগো মারাদোনা ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর বুয়েনোস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের পলিক্লিনিকো এভিতা হাসপাতালে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তবে তিনি বেড়ে ওঠেন ভিয়া ফিওরিতোতে, যা বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ প্রান্তের একটি শান্তিটাউন। তিন কন্যা সন্তানের পর তিনিই ছিলেন বাবা-মা’র প্রথম পুত্র সন্তান। তার ছোট দুই ভাই ররেছে হুগো (এল তুর্কো) এবং রাউল (লালো), যাদের উভয়েই পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়।
মারাদোনা হলেন ‘চিতরো’ দিয়েগো মারাদোনা এবং ‘দোনা তোতা’ দালমা সালভাদর ফ্রাঙ্কোর পঞ্চম সন্তান।
১০ বছর বয়সে, যখন তিনি এস্ত্রেয়া রোজার হয়ে খেলছিলেন তখন তাকে খুঁজে বের করেন একজন স্কাউট। তিনি দ্য লিটল অনিঅনের (আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের যুব দল) একজন মূল খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ১২ বছর বয়সে বল-বয় হিসেবে, প্রথম বিভাগের খেলার অর্ধ বিরতির সময় বল দিয়ে জাদুকরী কারুকার্য দেখিয়ে তিনি দর্শকদের সন্তুষ্ট করতেন।
ক্লাব ক্যারিয়ার
আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স এবং বোকা জুনিয়র্স
১৯৭৬ সালের ২০ অক্টোবর, নিজের ষোলতম জন্মদিনের দশ দিন আগে আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের হয়ে মারাদোনার অভিষেক হয়। সেখানে তিনি ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছিলেন এবং ১৬৭ খেলায় ১১৫টি গোল করেন। এরপর তিনি ১ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বোকা জুনিয়র্সে পাড়ি জমান। ১৯৮১ মৌসুমের মাঝামাঝি সময় বোকায় যোগ দিয়ে ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম লীগ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেন।
বার্সেলোনা
১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে বার্সেলোনায় যোগ দেন মারাদোনা। ১৯৮৩ সালে, কোচ সিজার লুইস মেনত্তির অধীনে বার্সেলোনা এবং মারাদোনা রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা দেল রে এবং অ্যাথলেতিক বিলবাওকে হারিয়ে স্পেনীয় সুপার কাপ জিতে। তবে, বার্সায় মারাদোনা কিছুটা খারাপ সময় কাটিয়েছেন। প্রথমে তাকে হেপাটাইটিসের সাথে লড়তে হয় এরপর তাকে পড়তে হয় গোড়ালির ইনজুরিতে। অবশ্য, চিকিত্সা শেষে দ্রুতই মাঠে ফিরে আসেন মারাদোনা।
বার্সেলোনায় মারাদোনা ৫৮ খেলায় ৩৮টি গোল করেন। বার্সেলোনায় থাকাকালে মারাদোনা ক্লাব পরিচালকদের সাথে ঘনঘন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, বিশেষ করে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ইয়োসেপ লুইস নুনেজের সাথে। ১৯৮৪ সালে, আরেকটি রেকর্ড স্থানান্তর ফি-তে (৬.৯ মিলিয়ন ইউরো) সিরি এ ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন তিনি।
নাপোলিতে মারাদোনা তার পেশাদার ক্যারিয়ারের শিখরে পৌছান। তিনি খুব দ্রুত ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সেই সময়টিই ছিল নাপোলির ইতিহাসের সফলতম যুগ। মারাদোনার অধীনে নাপোলি ১৯৮৬–৮৭ ও ১৯৮৯–৯০ মৌসুমে সিরি এ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে এবং ১৯৮৯–৮৮ ও ১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে তারা রানার-আপ হয়। এছাড়া মারাদোনার সময়ে নাপোলি একবার কোপা ইতালিয়া জিতে (১৯৮৭) এবং একবার রানার-আপ (১৯৮৯) হয় এবং ১৯৯০ সালে ইতালীয় সুপার কাপ জিতে। ১৯৮৭–৮৮ মৌসুমের সিরি এ-তে মারাদোনা সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন।
ইতালিতে থাকাকালে মারাদোনার ব্যক্তিগত সমস্যা বৃদ্ধি পায়। তার কোকেইন নেশা বহাল থাকে। অনুশীলনে অনুপস্থিত থাকায় ক্লাবের পক্ষ হতে তাকে ৭০,০০০ মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। ইতালিতে মারাদোনাকে পুত্র সন্তান সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হতে হয়।
পরবর্তীতে, মারাদোনা এবং নাপোলিতে থাকাকালে তার অর্জনসমূহের প্রতি সম্মান জানিয়ে নাপোলির ১০ নম্বর জার্সিটি দাপ্তরিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সেভিয়া, নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ এবং বোকা জুনিয়র্স
ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা থেকে ফিরে ১৯৯২ সালে মারাদোনা নাপোলি ছেড়ে দেন। স্পেনীয় ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ এবং ফরাসি ক্লাব অলিম্পিকে মার্শেই তার প্রতি আগ্রহী হলেও তিনি স্পেনীয় ক্লাব সেভিয়াতে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর ছিলেন।১৯৯৩ সালে তিনি লিওয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে খেলেন এবং ১৯৯৫ সালে তিনি বোকা জুনিয়র্সে ফিরে আসেন এবং সেখানে দুই বছর খেলেন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কিছু পূর্বে মারাদোনা টটেনহাম হটস্পারের হয়েও মাঠে নামেন ইন্টারন্যাজিওনালের বিপক্ষে। খেলায় টটেনহাম ২–১ গোলে জয় লাভ করে। তিনি গ্লেন হোডেলের সাথে খেলেন, যিনি মারাদোনার জন্য তার ১০ নম্বর জার্সিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
সূত্র: উইকিপিডিয়া।
৩০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ