শুক্রবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৭, ০৯:৫৪:০৮

তাদের অন্তত প্রতিপক্ষ বানাবেন না

তাদের অন্তত প্রতিপক্ষ বানাবেন না

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: সময়টা ২০০৬ সালের শেষ দিকের কোনো একটা মাস সম্ভবত।

মুশফিকুর রহিম তখন জাতীয় দলে; তবে স্রেফ ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলছেন। কিপিং করছেন তখনও বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা কিপারদের একজন খালেদ মাসুদ পাইলট। দেশ জুড়ে দারুন বিতর্ক, কার কিপিং করা উচিত?

পাইলট, নাকি মুশফিক?

আমরা প্রথম আলো থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘স্টেডিয়াম’ নামে অধুনা বিলুপ্ত ফিচার পাতায় পরষ্পরের সম্পর্কে পাইলট ও মুশফিকের মূল্যায়ন নিয়ে একটা বড় ফিচার করবো। দু জনকেই ফোন দিলাম। দু জনই সময় দিলেন পরদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে।

আমি একটা যুদ্ধ কাভারের মানসিকতা নিয়ে মিরপুর গেলাম। কল্পনা করছিলাম, তারা পরষ্পরকে দেখে মুখ কালো করে ফেলবেন, আড়ষ্ট উত্তর দেবেন এবং কোনোক্রমে উত্তর দিয়ে উঠে চলে যাবেন।

আমি যে তখনও শিক্ষানবীশ এবং দুনিয়ার কিছুই জানি না, তার প্রথম প্রমাণ পেয়েছিলাম সেদিন। মাঠে ঢুকে দেখি, পাইলট ভাই মুশফিকের কাধে ভর দিয়ে একটা পা ভাজ করে দাড়িয়ে আছেন। দু জন এক মনে কম্পিউটার এনালিস্ট নাসু ভাইয়ের কথা শুনছেন; এখনও জাতীয় দলের সাথে থাকা নাসির আহমেদ নাসু নিজে পাইলটপূর্ব যুগের দেশসেরা উইকেটরক্ষক।

আমার চমকের আর শেষ হয় না।

নাসু ভাই বললেন দু জনকে প্র্যাকটিসে যেতে। সেই প্র্যাকটিসটা আমার জন্য একটা শিক্ষা সফরের মতো ছিলো। পাইলট কিপিং প্র্যাকটিস করাচ্ছেন মুশফিককে; যে মুশফিক তাকে জাতীয় দল থেকে ছিটকে দিতে চলেছেন। রাবারের ব্যাট দিয়ে পাইলটের আঘাত করা বল ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে গ্লাভসে নিচ্ছেন মুশফিক। একটা বল মিস করায় শক্ত একটা ঝাড়িও দিলেন পাইলট।

লম্বা অনুশীলন শেষ করে দু জন হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন। পাইলট ভাই আমাকে চিনতেন। এক গাল হেসে বললেন, ‘আসো, দেবুদা। ইন্টারভিউ দেই। আসো, দু জনের মধ্যে যুদ্ধ লাগাও।’

শুনে মুশফিকও হেসে আটখানা।

আমি সেইদিন বুঝেছিলাম, ক্রিকেটারদের নিয়ে যত রেশারিশি, যত গালগপ্প, যত কল্পনা আমাদের মিডিয়ায় এবং ভক্তদের মনে। আসলে ভেতরে ভেতরে এরা বন্ধু; বন্ধুও ঠিক নয়, ঠিক যেনো এক পরিবারের কয়েকটা ভাই।

গত কয়েকটা দিন ধরে খুব মনোকষ্টে আছি।

বিভিন্ন  ফেসবুক গ্রুপে দেখছি নতুন করে সাকিব আর মাশরাফির তুলনা করে, তাদের মুখোমুখি কল্পনা করে নানারকম পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নকে সামনে এনে লোকে পোস্ট করছেন। সেসব পোস্টে সাকিবভক্তরা মাশরাফিকে গালি দিচ্ছেন, মাশরাফিভক্তরা সাকিবকে গালি দিচ্ছেন।

এতে আমি রাগ হতে পারতাম। কিন্তু রাগ হতে পারিনি; কষ্ট পেয়েছি।

বেদনা নিয়ে ভেবেছি, আমাদের জাতীয় দল সম্পর্কে এই ধারণা আমাদের ভক্তদের মধ্যে! আমাদের খেলোয়াড়দের প্রতি এই রকম শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস নিয়ে ঘুরি আমরা! আমরা কী করে সাকিব আর মাশরাফিকে মুখোমুখি কল্পনা করি?

সাকিব আর মাশরাফি।

এমনিতেই আমাদের ক্রিকেটারদের পারষ্পরিক সম্পর্ক আক্ষরিক অর্থে ভাই ভাইয়ের মতো। তারপর এই দু জন খেলোয়াড় পরষ্পরের এতো ঘনিষ্ঠ, এতোটা শ্রদ্ধা তারা পরষ্পরকে করেন; তাদের আমরা কিভাবে এমন করে অশ্রদ্ধা করতে পারি!

এই ক দিন আগে ‘মাশরাফি’ বইটা থেকে সাকিব আল হাসানের সাক্ষাতকার খেলাধুলা ডটকমে প্রকাশ করেছি আমরা। সেখানে কী আপনারা দেখেননি যে, সাকিব কিভাবে নিজেকে মাশরাফিভক্ত বলে দাবি করেছেন!

আপনাদের জন্য আমি প্রয়োজনে ‘সাকিব আল হাসান’ বই থেকে মাশরাফির সাক্ষাতকার এখানে প্রকাশ করে দেবো। দেখতে পাবেন, সাকিবের প্রতি কী অসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা বুকে নিয়ে ঘোরেন মাশরাফি।

কিন্তু এসব সাক্ষাতকার-টার পড়ার কী আদৌ দরকার আছে?

আপনারা খেলাটা নিয়মিত দেখলেই তো বুঝতেন, এই দু জন মানুষের সম্পর্ক। আপনারা কী জানেন না যে, সাকিব আল হাসান একজন সাবেক অধিনায়ক হয়েও স্বেচ্ছায় ও আনন্দের সাথে মাশরাফির সহঅধিনায়ক হয়েছেন? একজন সাবেক অধিনায়ক হয়েও মাশরাফি দুই বছর সাকিবের অধীনে ম্যাচ খেলেছেন।

আপনারা কী জানেন না যে, মাশরাফি ইনজুরিতে পড়লে বা শাস্তি পেলে এই সাকিব দল পরিচালনা করেন? আপনারা কী দেখতে পান না যে, মাশরাফি মাঠে পড়ে গেলে তামিম আর সাকিব কিভাবে দৌড়ে গিয়ে ছলো ছলো চোখে তার পা-টা কোলে তুলে নেন!

আমরা কী মানুষ হিসেবে এতোটাই অন্ধ!

আপনারা ২০১১ বিশ্বকাপে মাশরাফির বাদ পড়া নিয়ে কথা বলেন। একটু পত্রিকার পাতা উল্টে দেখেন; বইয়ের রেফারেন্স বারবার না দেই। পত্রিকাতেই দেখতে পাবেন, দল ঘোষনার আগের দিনও সাকিব বলছেন, আমার দলে দাড়িয়ে থাকার জন্য হলেও মাশরাফি ভাইকে চাই। দল ঘোষনার পর যখন দলে বদলের সম্ভাবনা তৈরী হলো, এই সাকিব বলেছিলেন, শুধু ড্রেসিংরুম চাঙ্গা করার জন্য চলেও মাশরাফি ভাইকে চাই।

[বিশ্বকাপে মাশরাফি কাদের কারণে দল থেকে বাদ পড়েছেন, সেটা নিয়ে অনেক বিস্তারিত আলোচনা আছে। না জেনে সাকিবকে দোষ দেন যারা, তারা ঘটনাক্রম হয় জানেন না, না হয় ভুলে গেছেন। সাকিব শেষ অবদি মাশরাফির জন্য লড়াই করেছিলেন। প্রমাণ আছে সে সময়ের পত্রপত্রিকায় এবং ‘মাশরাফি’ বইয়ে।]

আপনারা কী দেখতে পান না যে, সাকিব বলছেন, আমার এখন দলে ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করারও সবচেয়ে পছন্দের মানুষ কৌশিক ভাই!

দেখেন, আমরা মিডিয়ার মানুষ।

আমরা হয়তো বিন্দুতে সিন্ধু দেখি। আমরা গন্ডগোল কল্পনা করতে পছন্দ করি। তাও তো আজ অবদি ছোক ছোক করেও আমরা এই দুটো মানুষের পরষ্পরের বিপক্ষে একটা বাক্য বা একটা শব্দ খুজে পাইনি। আপনারা তাদের পরষ্পরকে গালি দিচ্ছেন, পরষ্পরের ভক্ত সেজে!

ধিক।

এই মাশরাফি যখন ওয়ানডে অধিনায়ক হলেন, এই আমি মুশফিককে প্রশ্ন করেছিলাম, কাজটা তার পছন্দ হলো কি না। মুশফিক চট্টগ্রামে বসে বলেছিলেন, ‘দেখেন, আমাদের দলটায় প্রতিভার তো অভাব নেই। দরকার উজ্জীবিত করা। সেটা করার জন্য দেশের সেরা মানুষটিই হলেন মাশরাফি ভাই।’

এরপরও আমরা সাকিব-মাশরাফি-মুশফিক দ্বন্ধ খুজে বেড়াই!

ভাবুন তো, সাকিব, তামিম, মুশফিক তাদের পরিবারের সাথে কয়টা দিন কাটান? কয়টা বার তাদের পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়? তার চেয়ে অনেক বেশী সময় কাটে এই সতীর্থদের সাথে হোটেলের রুমে, মাঠে আর অনুশীলনে। সেখানে পরিবারবার শক্ত হয়। সেখানে বিদ্বেষের কোনো জায়গা থাকে না।

মাঠে হয়তো ঘরোয়া ক্রিকেটে লড়াই থাকে, এমনকি জাতীয় দলেও দ্বিমত থাকে। কিন্তু তারা একটা মুহুর্তের জন্য পরষ্পরের প্রতি শ্রদ্ধা হারান না।

মনে রাখবেন, আজ আপনি মাশরাফিভক্ত হয়ে সাকিবকে গালি দিলেন মানে আসলে মাশরাফিকেই অপমান করলেন। মনে রাখবেন, আজ আপনি সাকিবিয়ান সেজে মাশরাফিকে গালি দিলেন মানে সাকিবেরই বুকে আঘাত করলেন।

মাশরাফি, সাকিব এবং জাতীয় দলের কোনো খেলোয়াড় তার বন্ধু, ভাইকে আঘাত করা ভক্তকে পছন্দ করতে পারেন না।

আমি মাশরাফিকে নিয়ে বই লিখেছি, সাকিবকে নিয়ে বই লিখেছি। দু জনেরই বেশীরভাগ ভক্তর চেয়ে অনেক বেশী সময় আমাকে কাজেই তাদের সাথে কথা বলতে হয়েছে, সময় কাটাতে হয়েছে। সাকিব ও মাশরাফিকে পরষ্পর সম্পর্কে গন্ডা গন্ডা প্রশ্ন করেছি, আড্ডায় বসেছি। এই বসা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই দু জনকে পরষ্পরের প্রতিপক্ষ বলে যারা কল্পনা করছেন, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন।

কিছু জানুন আর নাই জানুন, তাদের ভক্ত হলে তাদের মতোই হৃদয়টাকে বড় করুন, সবাইকে শ্রদ্ধা করুন।

এই লেখাটায় আমার লেখা দুটি বইয়ের প্রসঙ্গ বারবার আসায় আমি লজ্জা প্রকাশ করছি। বিজ্ঞাপন করার জন্য নয়, রেফারেন্স হিসেবেই বলতে হয়েছে।-খেলাধুলা
এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে