মাশরাফিদের জার্সি তৈরির ইতিহাস শোনালেন অনিকেত
স্পোর্টস ডেস্ক: মুশফিকের সেঞ্চুরি। সাকিব-মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেট। হাসছে তামিমের ব্যাট। হাওয়ায় উড়ে ক্যাচ লুফে নিচ্ছেন সাব্বির। যার ফল ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়ে ধবলধোলাই। এককথায় উড়ছে মাশরাফি বাহিনী। প্রথম টি-টোয়েন্টিতেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। অবশ্য টাইগারদের জন্য এ নতুন কিছু নয়। জয় এখন নিয়মিত ব্যাপার!
তবে এবারের জয়ে চট্টগ্রামের গর্বের ব্যাপারটা অন্যদের চেয়ে খানিকটা বেশি। হবেই না বা কেন, মাশরাফিদের গায়ে যে চট্টগ্রামের ছেলে অনিকেত ভট্টাচার্যের নকশা করা জার্সি। হ্যাঁ, বাংলাদেশ দল এখন খেলছে নতুন জার্সি পরে। সেই জার্সির নকশাকার অনিকেত।
কীভাবে অনিকেতের নকশা করা জার্সি মাশরাফিদের গায়ে? মুঠোফোন কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) আয়োজিত ‘অদম্য জার্সি ডিজাইন কনটেস্ট’-এ সেরা হয় অনিকেতের জার্সি।
এর আদ্যোপান্ত জানতে অনিকেতের সঙ্গে কথা হয় ১২ নভেম্বর। আগের দিন রাতে ঢাকা থেকে এসে বিকেলেই আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে ঢাকায় কাজ করছেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়।
শুরুতেই মূল প্রসঙ্গ, জার্সি। শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখমুখ। বললেন, ‘এটি আমার জন্য বিরাট পাওয়া। বড় একটি সাফল্য। বাংলাদেশ দল আমার নকশা করা জার্সি পরে খেলছে ভাবতেই অন্য রকম লাগছে। আমি এমনিতেই ক্রিকেটপাগল। এখন এই পাগলামি আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।’
অনিকেত জানান, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া অনেকটা ‘খেলার ছলে’। অফিসের সহকর্মীরাই এর মন্ত্রণাদাতা। তাঁদের কথা, ‘দিয়ে দেখ না কী হয়। না হলে নাই।’ এভাবে শুরু। কাজে লেগে পড়লেন। পুরোনো সব জার্সি ঘেঁটে দেখে মাথায় কিছু একটা খেলতে লাগল। নিজের ভেতরই যেন টের পেলেন ভালো কিছু হতে পারে। এবার আর খেলা নয়, পুরোদস্তুর পেশাদারি। ঢেলে দিলেন সবটুকু। এমনিতে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় টি-শার্টের নকশা করেছেন। সেই অভিজ্ঞতাও কাজে লেগেছে। খেটেখুটে দাঁড় করালেন ২০ থেকে ২২টি নকশা। নিজেই আবার বাছাই করলেন। সেখান থেকে জমা দিলেন ১০টি নকশা। খোঁজ নিলেন প্রায় আট হাজার নকশা জমা পড়েছে। প্রতিযোগী পাঁচ হাজার। সংখ্যা শুনেই মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। তারপরও একটা আশা তো ছিল। এরপর কেটে গেল মাস খানেক। একদিন ফোন পেলেন সেরা ১১টি জার্সিতে তাঁরটাও আছে। তারপর সেই ক্ষণ ৫ নভেম্বর। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলে অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেখানেই বিচারকদের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর সেরার স্বীকৃতি। যে দিনটি অনিকেতের জীবনে হয়ে থাকবে শুধুই বিজয়ের। তাঁর ভাষায়, ‘মাহেন্দ্রক্ষণ’।
নতুন জার্সিতে আরও বিধ্বংসী মাশরাফিরা l প্রথম আলো১১ থেকে ৫, এরপর ১—এই সংখ্যাগুলো ক্রিকেট ইনিংসে রানের দিক থেকে একেবারেই নগণ্য। কিন্তু অনিকেতের জীবনের ইনিংস বড্ড দামি। এভাবেই তো প্রতিযোগিতার সব ধাপ পেরিয়ে সেরার মুকুট হাতের মুঠোয়। তবে সেরা হওয়ার পর জেঁকে বসে শঙ্কা! অনেকের মন্তব্য, বাংলাদেশের আগের জার্সিই তো ‘লাকি’। এই জার্সি পরে প্রায় ম্যাচে জিতেছে। কেন বদলানো? যদি ‘অপয়া’ হয়। এমন সব কথা তরি করে দিল শঙ্কা। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে প্রথম ওয়ানডে খেলাটা স্টেডিয়ামে বসে দেখার পরিকল্পনা থাকলেও বাদ দিলেন অনিকেত। সব কাজ ফেলে টেলিভিশনের সামনে বসে আছেন। বুকের ভেতর ধুকপুকানি। প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে উৎকণ্ঠায়। অবশেষে জয়। শেষমেশ সিরিজে তো একেবারে ধবলধোলাই।
অনিকেত বলেন, ‘টাইগাররা তো জান লাগিয়ে খেলেন দেশের জন্য। প্রতিটি খেলোয়াড় অসাধারণ নৈপুণ্যে এগিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশকে। লড়াকু খেলোয়াড়ের কাছে পয়া-অপয়ার মতো কুসংস্কারের কোনো স্থানই নেই। এটা আরও একবার প্রমাণ হলো।’ জার্সির নকশায়ও অনিকেত ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধ আর নতুন বাংলাদেশ।
জমিনে সবুজের ওপর সাদা রেখার স্তম্ভ। যা মনে করিয়ে দেয় স্মৃতিসৌধের কথা। হাতে টকটকে লালে শহীদদের রক্ত। বুকে লেখা বাংলাদেশ-যে জার্সি পরে ছুটছে তো ছুটছেই মাশরাফিরা। অনিকেত বলেন, নকশা করার সময় আমাদের স্মৃতিসৌধ, অপরাজেয় বাংলাদেশ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভাস্কর্য মাথায় ছিল। যার প্রতিফলন নতুন এই জার্সিতে রয়েছে।
এবার শুরুর দিকে কথা ‘ক্রিকেটপাগলে’ আসি। ‘আমি ছোটবেলা থেকে ক্রিকেটের পাঁড় ভক্ত। বাবার হাত ধরে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যেতাম। আমি নিজেও স্কুল টিমে ছিলাম। স্পিন বল করতাম। ফিল্ডিংয়েও ভালো ছিলাম। কিন্তু খাটো হওয়ার কারণে স্কুল দলের হয়ে বড় কোনো টুর্নামেন্টে খেলা হয়নি। শচীন টেন্ডুলকার আমার প্রিয় ক্রিকেটার। দেশে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, তামিম, মুস্তাফিজ, সৌম্যদের ভক্ত। তাঁরা তো প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপন ধরান। এটা বেশ উপভোগ করি।’ বললেন অনিকেত।
রাউজানের কদলপুরে গ্রামের বাড়ি হলেও অনিকেতের বেড়ে ওঠা নগরের চন্দনপুরায়। দুরন্তপনায় প্যারেড মাঠ চষে বেড়ানো ছেলেটা এখন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াবে! বেড়াবেই তো মাশরাফিদের জয়ে যে এখন তিনিও জড়িয়ে থাকবেন আষ্টেপৃষ্ঠে।-প্রথম আলো
১৫ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ