টাইগার মাশরাফির অন্য লড়াই
স্পোর্টস ডেস্ক: মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে চলতি বছরে একের পর এক সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। সেরাদের আসরে বাংলাদেশের বেলকি দেখে ক্রিকেট বিশ্ব। পরবর্তীতে দেশের মাটিতে পরাশক্তিদের ধবল ধোলাই সবই অর্জন অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে থাকাকালীন অবস্থায়।তবে তিনি চাইলে জাতীয় দলের সতীর্থদের পাশে নিয়ে আজ বড় একটা কেক কাটতে পারতেন। কেকের ওপর লেখা থাকবে ‘সাফল্যের এক বছর’।
গত বছর জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে এই ২১ নভেম্বরেই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন মাশরাফি। সেই থেকে শুধু সাফল্যেরই রেণু উড়ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। জিম্বাবুয়েকে ধবলধোলাই করে টানা ১২ ওয়ানডে হারের জ্বালা জুড়ানোর পর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা; দেশে ফিরে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা সিরিজ জয়। বছরের শেষ প্রান্তে এসে জিম্বাবুয়েকে আবারও ওয়ানডেতে ধবলধোলাই। বাংলাদেশ দলের সাফল্যের তো বটেই, মাশরাফির অধিনায়কত্বের এক বছর পূর্তি উপলক্ষেও একটা উৎসব হতে পারে আজ।
কিন্তু ক্রিকেটার মাশরাফির যে উপস্থিতিটা সবাই মাঠে দেখে, তা আসলে রুপালি পর্দার সেসব চরিত্রের মতোই, পর্দার বিনোদনদায়ী চেহারায় যাঁরা ঢেকে রাখেন বাস্তব জীবনের কষ্টের ছবি। মাঠে উইকেট পেয়ে মাশরাফি উদ্বাহু হন, ফেটে পড়েন জয়োল্লাসে, দর্শক শুধু এটুকুই দেখে। এই খেলার জন্য তাঁকে কতটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে খবর কজন রাখেন?
১৪ বছরের ক্যারিয়ারে দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত গত চার বছর ছুরির নিচে যেতে না হলেও বেশি পরিশ্রমে এখনো হাঁটু ফুলে যায়, ব্যথা হয়। খেলা শেষে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে বের করে নিতে হয় হাঁটুতে জমা বিষাক্ত রস। ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নামতে পারেন না। হাঁটু দুটো কয়েকবার ভাঁজ করতে হয়, সোজা করতে হয়—তারপর শুরু হয় দিন। মাঝেমধ্যে রাতগুলোও হয়ে ওঠে আতঙ্কের। ঘুমের মধ্যেই অনুভব করেন, কোনো একটা পা বাঁকানো যাচ্ছে না। মাশরাফির ভাষায়, ‘রাতে মাঝে মাঝে আমার অবস্থা দেখে সুমি (মাশরাফির স্ত্রী) ভয় পেয়ে যায়। ব্যথায় পা’টা হাঁটু থেকে যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে...আমি অদ্ভুত শব্দ করে উঠি।’
সবকিছুর মধ্যেই কোনো না কোনো রসিকতা খুঁজে পান মাশরাফি। তাঁর চোখে এই সবই ‘ছোটখাটো’ সমস্যা। একটা বয়সে গিয়ে শরীর ঠিক রাখতে ডাক্তাররা প্রতিদিন নিয়ম করে ঘণ্টা খানেক হাঁটার পরামর্শ দিলেও মাশরাফির পক্ষে সেটা নাকি কখনোই সম্ভব হবে না। একটানা যে বেশিক্ষণ হাঁটতেই পারেন না! ‘আমি সেটা পারব না। বাম হাঁটুতে মিনিসকাস একেবারেই নেই। আমিই মনে হয় একমাত্র মানুষ যার মিনিসকাস নেই’—কথাটা এমনভাবে বললেন, যেন মিনিসকাস না থাকাটা একটা গর্বের ব্যাপার!
২০১১ সালে সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের সময় অস্ট্রেলিয়ার শল্যবিদ ডেভিড ইয়াং একটা সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। জোড়াতালির হাঁটু নিয়ে এভাবে খেলা চালিয়ে গেলে ৪০-৪৫ বছর বয়সে হুইলচেয়ারে বসে পড়তে হবে মাশরাফিকে। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারেই তাঁকে বলেছেন, ‘তোমার নিজেরও তো একটা জীবন আছে। সেটা নিয়ে ভাবো। আমি তোমার পা’টা ঠিক করে দিচ্ছি। এরপর আর খেলো না।’ এ কথা শুনে মাশরাফির প্রতিক্রিয়া কী ছিল, শুনবেন? ‘আমি হেসে বলেছি, তুমি সারা জীবন আমাকে এত সাহস দিয়ে গেছ, আর এখন এসব কী বলছ! তুমি তোমার অপারেশন করো। বাকিটা আমি বুঝব।’
ইয়াংয়ের অবশ্য এমন প্রতিক্রিয়ায় অবাক না হওয়ারই কথা। মাশরাফিকে তো আর সেবারই নতুন দেখেননি! মেলবোর্ন থেকে একেকবার হাঁটু কাটাকাটি করে ফেরত পাঠিয়েছেন, কয় দিন পরই শুনেছেন তাঁর রোগী মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এবারও সে রকমই হতে যাচ্ছে বুঝে ডাক্তার আর তাঁকে ঘাঁটাননি। তবে বয়স ৪০-৪৫ হয়ে গেলে মাশরাফির হাঁটু দুটো আর কার্যক্ষম থাকবে না, এমন শঙ্কা থেকে খেলা ছাড়ার পর এখনকার হাঁটু দুটো ফেলে কৃত্রিম হাঁটু লাগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। মাশরাফির কথাটা পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
হাঁটুতে এতবার ছুরি চালিয়েও কোনো পেসার এত বছর ধরে খেলা চালিয়ে গেছেন—এ রকম উদাহরণ সম্ভবত ইয়াংয়েরও জানা নেই। গত মার্চে একটি ওয়েবসাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জীবনে অনেক রোগী দেখেছি। ৩০ বছরের শল্যবিদ জীবনে বহু ক্রিকেটারকে নিয়েই কাজ করেছি। কিন্তু মাশরাফির চেয়ে অবিশ্বাস্য ক্রীড়াবিদ আর দেখিনি। দুই হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পরও ১১ বছর খেলা চালিয়ে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার মতোই।’
খেলার সময় মাশরাফির ঊরুর মাঝামাঝি থেকে দুই পায়েরই অর্ধেক পর্যন্ত শক্ত করে মোড়ানো থাকে টেপে। হাঁটুর অংশটাকে উন্মুক্ত রেখে পায়ের দুপাশ বেয়ে নেমে যায় সেটা। তার ওপরে পরেন ‘নি ক্যাপ’। খেলার সময় দৌড়ঝাঁপের ধাক্কায় যেন হাঁটুর জোড়া ছুটে না যায়, সে জন্যই এ ব্যবস্থা।
এভাবে খেলে মাঠে হয়তো কিছুটা নিরাপদ থাকা যায়, কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও যে আছে! বাঁ পা থেকে কাপড় সরিয়ে টেপ লাগানোর জায়গাটা দেখাচ্ছিলেন মাশরাফি। জিম্বাবুয়ে সিরিজে লাগানো টেপের আঠা এখনো লেগে আছে। এখানে-ওখানে দাগ, কয়েকটা জায়গায় চামড়া উঠে গেছে। সেগুলো দেখিয়ে বলছিলেন, ‘টেপের নিচে থেকে ঘামতে ঘামতে অনেক জায়গার চামড়া পচে যায়। তখন আরেক ঝামেলা। পচে যাওয়া জায়গায় বাড়তি প্রোটেকশন নিয়ে তারপর টেপ লাগাতে হয়।’
টেপ বেশি সময় লাগিয়ে না রাখলে এ সমস্যা আর হয় না। কিন্তু সেটা কতক্ষণ লাগানো থাকবে, তা নির্ভর করে বাংলাদেশ দল আগে ব্যাটিং করবে না বোলিং করবে তার ওপর। আগে বোলিং করলেই মাশরাফির স্বস্তি। ব্যাটিংয়ের সময় যেহেতু শুধু ‘নি ক্যাপ’ পরলেই চলে, বোলিং শেষে ইনিংস বিরতিতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় টেপের বাঁধন থেকে। তবে দল আগে ব্যাটিং করলে টেপ, ‘নি ক্যাপ’ পরে থাকতে হয় পুরো ম্যাচেই। টেপ লাগাতে ৩০-৪০ মিনিট লেগে যায় বলে টসের আগেই পা দুটো মুড়ে ফেলতে হয়। প্রথমে ব্যাটিং করলেও তখন আর কিছু করার থাকে না।
অন্যরা যখন খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে আড্ডায় মেতে ওঠেন, মাশরাফিকে তখন ম্যাসাজ টেবিলে শুয়ে পড়তে হয় টেপ খুলতে। খেলার আগেও একই দৃশ্য। আর সবাই জার্সি-ট্রাউজার পরে মাঠে নেমে যাচ্ছেন, কিন্তু মাশরাফিকে তার আগে ৩০-৪০ মিনিট ধরে নিতে হয় ‘টেপ-সজ্জা’।
নিজের সঙ্গে এই লড়াইয়ে এখন কিছুটা ক্লান্ত মাশরাফি। যত দিন খেলবেন, এই ক্লান্তি আর অস্বস্তি নিয়েই খেলতে হবে। ডেভিড ইয়াংয়ের ‘অলৌকিক মানব’ তবু স্বপ্ন দেখেন আরও বড় ‘অলৌকিকের’, ‘আল্লাহ যদি আমাকে বলতেন, তুই পাঁচটা ম্যাচ টেপিং ছাড়া খেল। কিচ্ছু হবে না। এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর কিছুতেই পাব না আমি। উনি যদি জানতে চান, মাঠে তুই কী চাস? আমি বলব, পাঁচটা ম্যাচ আগের মতো খেলতে চাই। শুধু ট্রাউজার, জার্সি, জুতা পরে বল করতে নেমে যাব। ছোটবেলার সেই জীবনটা পাঁচ ম্যাচের জন্য হলেও ফেরত চাই।’
মাশরাফি—আমাদের ক্রিকেটের বীরচূড়ামণি। তাঁর প্রার্থনা হয়তো পূরণ হবে না। তবে বীরের এই আকাঙ্ক্ষা আমাদের খেলোয়াড়দের প্রেরণা হয়ে থাকবে। সূত্র : প্রথম আলো
২১ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আরিফুর রাজু/এআর