দেবাশিস দত্ত : ভাল খেলিয়াও পরাজয়ের কাহিনীর তালিকায় আরও একটি সংযোজন হলো মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার পার্থে। প্রথম ব্যাট করে ৩ উইকেটে ৩০৯ রান তুলে যখন জয়ের ব্যাপারে ভারতীয় সমর্থকরা আশায় বুক বাঁধছিলেন, তার ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ছবিটা উল্টে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া শেষ পর্যন্ত ৪ বল বাকি থাকতেই জিতে গেল ৫ উইকেটের ব্যবধানে।
দায়ী কারা? বোলিং বিভাগ নাকি ব্যাটিং? স্কোর খাতা জানাচ্ছে, ভারতীয় বোলারদের মধ্যে অশ্বিন, জাদেজা, রোহিত শর্মা— এই তিন স্পিনার ২০ ওভারে বিলিয়েছেন ১৪০ রান। আর ৩ ফাস্ট বোলার ২৮.২ ওভার হাত ঘুরিয়ে অস্ট্রেলিয়া শিবিরকে উপহার দিয়েছেন ১৫২ রান। বোলিং যে খুব ভাল হয়নি, এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
এই সমস্যায় ভারতকে ভুগতে হয়েছে আগেও। তবু বিদেশি দক্ষ বোলিং কোচ আনার ব্যাপারে প্রবল অনীহা ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের। ব্যর্থতার পরই শিবিরের হাতুড়ে বোলিং কোচেদের দিয়ে যে কিছু হবে না, এ জাতীয় হা–হুতাশ করে ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট।
যেমন করতে হচ্ছে এদিন। দুম করে বাকি চারটি ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচে এই বোলাররা ভাল বোলিং করলেই বলা শুরু হয়ে যাবে, এত সহজে হতাশ হয়ে পড়লে চলবে? সত্যি কথা বলতে কি, এমন হতাশার কান্না শুনতে শুনতে সত্যিকারের ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।
টসের সময় আকাশ ছিল মেঘলা। ওই সময় সাহস করে অধিনায়ক ধোনি প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার পর অবশ্য আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায় এবং শক্ত, ভাল উইকেটে বল ব্যাটে ঠিকঠাক আসার কারণে শট খেলতে পছন্দ করা রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি পার্থের বাইশ গজে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে ২০৭ রান যোগ করে ভারতকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, যেখান থেকে জেতার স্বপ্ন দেখা যায়।
এর আগে একদিনের ক্রিকেটে বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় সর্বোচ্চ রান ছিল ভিভিয়ান রিচার্ডসের। অপরাজিত ১৫৩। সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন রোহিত শর্মা। ১৬৩ বলে অপরাজিত ১৭১ রানের ইনিংসটা দিনের শেষে দাম পেল না ঠিকই, কিন্তু থাকল প্রবলভাবে রোহিতের ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত। অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখলেই মনে হয় বিরাট কোহলি যেন মৃগয়া করতে এসেছেন।
ডনের দেশে শচীন, লক্ষ্মণের মতো বিরাটও যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এদিন শুরুতে রোহিত যখন তরতর করে এগোচ্ছিলেন, কোহলি তখন ধীরে–সুস্থে উইকেট আগলে রাখায় মন দিয়েছিলেন। ফকনারকে ৬ মারতে গিয়ে বাউন্ডারি সীমানার ধারে যখন ধরা পড়লেন, তখন তিনি সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৯ রান দূরে।
শচীনের ১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি তাড়া করতে গিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, তখন তাঁকে ৯ রানের জন্য হা–হুতাশ করতে হবে।
মিচেল স্টার্ক নেই। মিচেল জনসন গার্হস্থ্য জীবনে পৌঁছে গেছেন। প্যাটিনসন বিশ্রামে। এই পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলীয় শিবির অচেনা বোল্যান্ডকে মাঠে নামিয়ে দিল। শিক্ষিত বোলারদের মধ্যে হ্যাজেলউড ১০ ওভারে ৪১ রান না দিলে ভারত হয়ত আর একটু এগোতে পারত এবং তখন, কে বলতে পারে, ৪ বল বাকি থাকতে হয়ত হারতে হত না।
ভারতের বাঁচার আরও একটা সম্ভাবনা ছিল। যখন পঞ্চম ওভারে বারিদার স্রানের বলে ধোনির ক্যাচকে নাকচ করে দেন আম্পায়ার রিচার্ড কেটলবরো। পরিষ্কার আউট। কিন্তু আম্পায়ার বেনিফিট অফ ডাউট দিলেন ব্যাটসম্যান বেইলিকে। আর রক্ষে আছে!
অধিনায়ক স্মিথের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৃতীয় উইকেটে ২৪২ রান তুলে ভারতকে ধাক্কা দিয়ে ম্যাচ জেতার পোডিয়াম থেকে সরিয়ে দিলেন। অধিনায়ক স্মিথ অপরাজিত থাকলেন ১৪৯ রানে। বেইলি ফিরেছিলেন ১১২ রান করে। স্পিনারদের ইচ্ছেমতো পিটিয়ে রান তুললেন স্মিথ–বেইলি জুটি।
হাসিম আমলা, এবি ডি’ভিলিয়ার্সরা এই ম্যাচের ভিডিও রেকর্ডিং নিজেদের সংগ্রহে রাখতে পারেন, স্পিনের বিরুদ্ধে নিজেদের খেলার টেকনিকের উন্নতি করার জন্য।শেষ পর্যন্ত ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক স্মিথ। বেচারা রোহিত শর্মা!
তা হলে এই ম্যাচের গল্পটা দাঁড়াল কেমন? ভারত খুব খারাপ বোলিং করল। ফিল্ডিং তথৈবচ। শুধু ব্যাটিং দিয়ে বা নাগপুরের মতো ভাঙা উইকেটে স্পিনারদের সাফল্যের জন্য তৃপ্তির ঢেঁকুর যে কলকে পাইয়ে দেবে না, এ ব্যাপারটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এই পার্থের উইকেটে জুজু ছিল না। এমনকি বিরাট কোহলিকে যে চতুর্থ ও পঞ্চম উইকেটে বল রেখে বিপদে ফেলা যায়, সেই উদ্যোগও নিল না অস্ট্রেলীয় শিবির।
ডি আর এস নেই এই সিরিজে, থাকলে বেইলিকে ফিরে যেত হত আগেই। বিদেশি বোলিং কোচ নিয়োগ করব না–র মতোই ভারতীয় শিবিরে অটল প্রতিজ্ঞা ডি আর এস–কে প্রত্যাখ্যান করা। তবু বলব, সিরিজের প্রথম ম্যাচে ভারতকে খুব বেমানান লাগেনি। উত্তরোত্তর উন্নতির সম্ভাবনা থাকছে ভালই। অলরাউন্ডার নেই।
সে অর্থে স্যর জাদেজাকেই অলরাউন্ডার হিসেবে ধরতে হবে। স্টুয়ার্ট বিনিকে বিনিয়োগ করে যে লাভ হয়নি, সেটা এতদিন লাগল বুঝতে। জাদেজা যদি এভাবে দরাজহস্তে রান বিলিয়ে দিয়ে যান, তা হলে আবার হয়ত তাকে সৌরাষ্ট্রের হয়ে রনজি খেলতে হবে। সামির ফিরে আসা অনেকটাই ঝাঁজ কমিয়ে দিয়েছে আক্রমণের।
৩ উইকেট পেয়েছেন বলেই স্রান খু–উ–ব ভাল, এটা বলা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সম্ভাবনাময়। অ্যারন ফ্রিঞ্চের ক্যাচটা যেভাবে ধরেছেন, তাতে এই নবাগতর প্রশংসা করা উচিত। হেরে যাওয়া ম্যাচে রোহিত, কোহলির ব্যাটিং সাফল্যের পর যদি কোনও ছোট আলোকবিন্দু খুঁজতে হয়, দূরবিনে অবশ্য পাঞ্জাবের স্রানকেই দেখতে পেলাম। খুব ছোট বিন্দু।
১৩ জানুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ/এসএস/এসবি