শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১৬, ০৯:৩৬:৪৮

বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশি সাইক্লিস্টদের রাজত্ব

বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশি সাইক্লিস্টদের রাজত্ব

স্পোর্টস ডেস্ক: একজন সাইক্লিস্টকে মাড়িয়ে দিয়ে ছুটে পালাল বন্যপ্রাণীটা। বুনো পাহাড়ি এলাকা। জন্তু-জানোয়ারের আকস্মিক হামলায় হকচকিয়ে গেল ৬০ জনের দলটা। রাইডে ক্ষণিকের ছেদ পড়ল। আহত সাইক্লিস্টকে সেবাশুশ্রূষা দিয়ে আবার ছুটল সবাই। একজনের পেছনে আরেকজন প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন। সবকটা সাইকেলের সামনে লাইট জ্বলছে। সে আলোয় ঘুটঘুটে আঁধারও পালিয়েছে। কিন্তু আগন্তুকদের দেখে বনের বাসিন্দারা বুঝি খানিকটা বিরক্ত। তাই ছোট্ট একটা সতর্ক সংকেত দিল।

দলের সঙ্গে নিয়াজ ও ইফতেখার (বাঁ থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয়)‘ভয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না।’ বললেন নিয়াজ মোর্শেদ। রাইড শুরুর আগে আয়োজকদের নির্মম রসিকতাটা মনে পড়ল তাঁর। জায়গাটায় বন্য হাতির দাপট খুব। দ্রুত সটকে পড়তে পারলে বাঁচোয়া। নয়তো ওদের পায়ের তলায় পরে মরতে হবে। অবশ্য সেটা হলেও মন্দ হয় না। কষ্ট করে আর এক হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হবে না।

আন্তর্জাতিক এক চ্যারিটি রাইডে যোগ দিতে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন নিয়াজ। সফরসঙ্গী ছিলেন আরেক বাঙালি। খ্যাতিমান সাইকেল স্প্রিন্টার শাহ্ ইফতেখার আলম। চার দিনের সেই রাইডে পাক্কা এক হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছেন তাঁরা। শুরুটা করেছিলেন থাইল্যান্ড সীমান্ত থেকে। জায়গাটা মালয়েশিয়ার মধ্যে, নাম বেলুম।

মালয়েশিয়ার অসহ্য গরম আর রুক্ষ, কঠিন পাহাড়ি এলাকায় দিনে গড়ে আড়াই শ কিলোমিটার সাইকেল চালাতে বহু ঘাম ঝরেছে। ব্যথায় টনটন করে উঠেছে পেশি। ব্যথানাশক মলম লাগিয়েছেন। তবু সাইকেল থেকে নামেননি। বিদেশিদের শান-শওকত, দামি দামি সব সাইকেল আর শক্তি-সামর্থ্যের কাছে নিজেদের তুচ্ছ, নগণ্য মনে হয়েছে। শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসতে চেয়েছে। তবু মনের জোরে টিকে থেকেছেন। দেশের সম্মানের কথা ভেবেছেন। একজন আরেকজনকে সাহস জুগিয়েছেন। চার দিনের সেই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা টিকে থেকেছেন। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন সম্মান।

যেভাবে বিদেশের মাটিতে

মালয়েশিয়ায় গিয়ে সাইকেল চালানোর প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী এজাজ মাহমুদ। সিঙ্গাপুরের কিডনি ডায়ালাইসিস ফাউন্ডেশন (কেডিএফ) প্রতিবছরই এই চ্যারিটি রাইডের আয়োজন করে। প্রস্তাবটা ছিল, বাংলাদেশ থেকে যে কেউ যোগ দিতে পারেন এই রাইডে। কিন্তু নিজ খরচায়। এগিয়ে এলেন এজাজ মাহমুদ। ঢাকায় সাইক্লিস্টদের সঙ্গে আলাপ করে নিয়াজ ও ইফতেখারকে বেছে নিলেন।

নিয়াজ সাইকেল ট্যুরিংয়ে দেশসেরা। আটবার তিনি ক্রস কান্ট্রি করেছেন। বাংলাদেশের মানচিত্রটাকে এ মাথা থেকে ও মাথা অবধি রীতিমতো কাটাকুটি করেছেন এই সাইক্লিস্ট। আর ইফতেখার নামকরা সাইকেল স্প্রিন্টার। ১৭টি স্বর্ণপদক আছে তাঁর ঝুলিতে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বাংলাদেশের দ্রুততম সাইক্লিস্ট তিনি।

প্রতিযোগী তো পাওয়া হলো, এবার স্পনসর! শুরুতে শঙ্কায় ছিলেন সবাই। পরে বিমানভাড়ার স্পনসর মিলল। এগিয়ে এল আকিজ গ্রুপ। ভেলোস ব্র্যান্ডের দুটি সাইকেল দিল মেঘনা গ্রুপ। আর বিদেশে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আয়োজকেরাই করে দিলেন। ব্যস, ১৩ জানুয়ারি রাতে মালয়েশিয়াগামী বিমানে চড়ে বসলেন দুই সাইক্লিস্ট।

সেই চারটি দিন

নিয়াজ-ইফতেখাররা থাইল্যান্ড সীমান্তের বুনো সেই পাহাড়ি এলাকায় গিয়ে পৌঁছান ১৪ জানুয়ারি বিকেলে। সেখানে আগে থেকেই ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপিন্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের ৫৮ জন সাইক্লিস্ট অপেক্ষা করছিলেন। চাকরিসূত্রে তাঁরা সবাই সিঙ্গাপুরে থাকেন। সেখান থেকেই মালয়েশিয়া এসেছেন সাইকেল চালাতে। অবশ্য তাঁদের কাছে মালয়েশিয়ার এই ট্রেইলগুলো পরিচিত। তাঁরা আগেও এসব রাস্তায় সাইকেল চালিয়েছেন। কিন্তু দুই বাংলাদেশি এখানে একেবারেই আনকোরা।

১৫ জানুয়ারি থেকে রাইড শুরু। সেদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠতে হলো। পাঁচটায় নাশতা সেরে সোয়া ছয়টায় হাজার কিমির পথে যাত্রা শুরু। বেলুমের আকাশ তখনো আঁধারে ঢাকা। সূর্য উঠতে তখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। সাইকেলের সামনের লাইট জ্বালিয়ে রাইডাররা চলতে শুরু করলেন। পিঁপড়ার মতো সারবেঁধে এগোচ্ছেন সবাই। জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা, গা ছমছমে পরিবেশ। এক-দুই কিলোমিটার যেতে না যেতেই দূর থেকে ঘোড়ার খুরের মতো একটা আওয়াজ তাঁদের কানে এল। প্রাণীটা হঠাৎ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আড়াআড়িভাবে রাস্তা পার হয়ে ছুট দিল। একজন সাইক্লিস্ট ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লেন। চোটটা অল্পের ওপর দিয়েই গেল। তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার সাইকেলে চড়ে বসল সবাই।

উঁচু-নিচু পাহাড়ি এলাকা। ঘণ্টায় গতিবেগ ২৮ থেকে ৩২ কিলোমিটার। ওপর থেকে নিচে নামার সময় (ডাউন হিল) গতি হয়ে যায় দ্বিগুণ। ৩০-৪০ কিলোমিটার পরপর বিরতি নিচ্ছিল দলটা। দলনেতা সবার পেছনে। দলে ৮-১০ জন নারী সদস্য ছিলেন। দলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটির বয়স ছিল ৬৫। তিনিও পুরো এক হাজার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে গেছেন। আর সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছিলেন নিয়াজ মোর্শেদ।

প্রথম দিন বিকেল সাড়ে চারটায় রাইড শেষ হলো। ২২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তাঁরা এসে থামলেন কুয়ালা বেসুতে। একপাশে সমুদ্র, আরেক পাশে পাহাড়। এমনই মনোরম পরিবেশে দ্বিতীয় দিনের রাইড শুরু হয়। কিন্তু সেদিনের আবহাওয়া ছিল রুক্ষ, বলেন ইফতেখার। প্রচণ্ড গরম ছিল দ্বিতীয় দিন। পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। অনেক কষ্টে রাত আটটায় এসে শেষ হলো দ্বিতীয় দিনের রাইড। এদিন তাঁরা ২৮৫ কিলোমিটার চালিয়েছেন। ‘সাইকেল থেকে নেমে দেখি হাত-পা কাঁপছে,’ বললেন নিয়াজ। সেদিন তাঁরা এসে পৌঁছান মালয়েশিয়ার চেরাটিং নামের একটা জায়গায়।

বিদেশিদের প্রাণপ্রাচুর্য দেখে যারপরনাই হতাশ হলেন দুই বাংলাদেশি। ওদের প্রাণশক্তি যেন অফুরন্ত। ‘দেশে একদিনে আমরা ২০০-৩০০ কিলোমিটার চালিয়ে বিছানায় শুয়ে-বসে, আরাম করে কাটাই তিন দিন। কিন্তু ওরা সমানতালে চালায় প্রতিদিন। এটাই ওদের প্রাণশক্তির মূল রহস্য।’ বললেন নিয়াজ মোর্শেদ।

মালয়েশিয়ার রাস্তায় বাংলাদেশের তৈরি সাইকেল ভেলোস নিয়ে বন্ধুর এক পথ পাড়ি দেন নিয়াজতৃতীয় দিন চেরাটিং থেকে সেই ভোের যাত্রা শুরু। ২৩৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছালেন মারসিংয়ে। মালয়েশিয়ায় তাপমাত্রা তখন ৩১-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোদে চামড়া পুড়ে ফোসকা পড়ে যায় এমন দশা। তবে বিশ্রাম, আর প্রচুর খাওয়া-দাওয়া করে টিকেছিলেন সাইক্লিস্টরা। ‘শক্তি জোগাতে এই কয়েক দিনে কম করে হলেও শ খানেক চকলেটবার সাবাড় করেছি।’ হাসতে হাসতে বললেন নিয়াজ। তবে দুঃখও আছে মনে। তৃতীয় দিন নিয়াজ সাইকেল নিয়ে নামতেই পারেননি, প্রচণ্ড ব্যাথার কারণে। শেষের দিন অবশ্য পুরোটাই চালিয়েছেন। ইফতেখারও স্বীকার করলেন, ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ায় চার দিনে প্রায় দেড় শ কিলোমিটার রাস্তা তিনিও চালাতে পারেননি।

চতুর্থ দিন আবারও পাহাড়ি এলাকা। গলদঘর্ম হয়ে শুধুই ছুটে চলা। এবার অবশ্য শেষ গন্তব্য সিঙ্গাপুর। সে দেশের অভিজাত গলফ গার্ডেনে বরণ করে নেওয়া হলো সাইক্লিস্টদের।

 

অসহ্য গরম উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে গেছে ৬০ জনের দলটা। ছবি: নিয়াজ ও ইফতেখারের সংগ্রহ থেকে

দুই স্বপ্নচারী

কথায় কথায় নিজেদের স্বপ্নের কথা বলেন বিদেশবিভুঁই থেকে ফেরা এই দুই সাইক্লিস্ট। নিয়াজ মোর্শেদের নেশা ঘুরে বেড়ানো। সাত মহাদেশে সাইকেল চালানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। ইউরোপ, আমেরিকা ঘোরার ইচ্ছা আছে তাঁর। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি মানুষজনকে বাংলাদেশে ঘোরার আহ্বান জানাবেন তিনি। এ দেশের পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার সুপ্ত একটা বাসনাও আছে তাঁর মনে। কিন্তু এই সব কিছুর জন্য চাই পৃষ্ঠপোষকতা।

ইফতেখার আলম সাইক্লিংয়ের একজন কোচ। বাংলাদেশ ভেলোস রেসিং টিমের কোচের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে সাইক্লিংয়ের নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বহু পুরস্কার জিতেছেন। এখন তাঁর স্বপ্ন একটি সাইক্লিং একাডেমি দেওয়ার। ‘বাংলাদেশে সাইক্লিং অবহেলিত। এই জায়গাটাকে আরও মজবুত করতে চাই আমি।’ ইফতেখারের কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়। সূত্র : প্রথম আলো

৩০ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/আরিফুর রাজু/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে