স্পোর্টস ডেস্ক : ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে খেলতে আর আইপিএলে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে আমার জন্য নির্ধারিত কাজটি করার সময় এসে গেল। একেকটি বিশ্বকাপ আসে এবং আমাকে ফাইনালের আগাম লাইনআপটি দৈনিক কালের কণ্ঠ’র জন্য লিখতে বসে যেতে হয়!
এবার অবশ্য দুটি বিশ্বকাপের মাঝখানে বিরতিটা ছয় মাসের বেশি নয়। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের রেশ থাকতে থাকতেই এবার টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসর। এর ফাইনালে কে কার মুখোমুখি হতে পারে, সে সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করতে বসে বারবার আমার মনে আহমেদাবাদই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, ধরতে পেরেছেন যে কাপ অস্ট্রেলিয়ার বলতে আমি আসলে কী বলতে চাচ্ছি।
আগামী ২৯ জুন বার্বাডোজের ফাইনালেও সর্বশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপের মতো অস্ট্রেলিয়া-ভারত লড়াই দেখার জন্য ভীষণ রকম অপেক্ষায় থাকব আমি। আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু বলায় ঝুঁকি থাকে। ভুল প্রমাণিত হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বলে রাখছি, দূর ক্যারিবীয় দ্বীপে আহমেদাবাদের ফাইনালের ‘রিপ্লে’ দেখব বলেই জানাচ্ছে আমার ক্রিকেটবোধ। অন্তত আমার যুক্তি-তর্ক-বিশ্লেষণ অস্ট্রেলিয়ার হাতেই কাপ দেখছি।
ক্রিকেট মাঠে অবশ্য সেসব যুক্তি মার খেতেই পারে। তর্কে হেরেও যেতে পারি। আমার বিশ্লেষণ যে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাবে, সে নিশ্চয়তাও দিচ্ছি না।
পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখছি, আমার ‘সাকসেস রেট’ কখনোই শতভাগ নয়। দেড় বছরের মধ্যে এটি তৃতীয় কাপ অস্ট্রেলিয়ারবিশ্বকাপ, যেটি নিয়ে আমার প্রেডিকশন করছি।
আগের দুইবারও পুরোপুরি মেলেনি। যেমন ধরা যাক, ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কথা। সেই সময়ের কালের কণ্ঠ’র বিশ্বকাপ সংখ্যা কারো সংগ্রহে থাকলে ঘেঁটে দেখতে পারেন, আমি বলেছিলাম ফাইনালে খেলবে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড।
অথচ নিজেদের মাঠে অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল অবধিও যেতে পারেনি। বিশ্বকাপ জিতে অবশ্য সেবার আমার মান বাঁচিয়েছিল ইংলিশরা! পুরোপুরি ভুল তো আর প্রমাণিত হইনি। পরের বছর একই সময়ে হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়ও আমার সাফল্য শতকরা ৫০ ভাগ। আমি ফাইনালে তুলে দিলেও ওই আসরে ইংল্যান্ডের ভরাডুবি হয়েছিল।
কাপ ভারতের হাতেই দেখতে পেয়েছিলাম, কিন্তু আহমেদাবাদের নীল সমুদ্র স্তব্ধ করে দিয়ে রাজ্যপাট কিনা দখল করেছিল অস্ট্রেলিয়া। নানা কারণে এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ওদের ট্রফি জেতার পক্ষে সবচেয়ে বেশি ফেভারিট না ধরে পারছি না। জোর সেই সম্ভাবনার ব্যাখ্যায় অস্ট্রেলিয়ার দলীয় শক্তির গভীরতার কথা না বললেই নয়। স্রেফ একটি উদাহরণ দিই।
এবারের আইপিএলের সূত্রে জেইক ফ্রেজার-ম্যাগার্কের নামটি আপনাদের টি-টোয়েন্টি প্রিয় মনে এত দিনে খোদাই হয়ে যাওয়ার কথা। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ রীতিমতো মাত করে দেওয়া ছেলেটি নিয়মিত ২৫০-৩০০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেও বিশ্বকাপ দলে থাকার জন্য বিবেচিত হয়নি।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওর অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ দলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে যাওয়া হচ্ছে। তবে সেটি শুধুই ‘ট্রাভেলিং রিজার্ভ’ হিসেবে। অর্থাৎ কেউ চোটে পড়লেই শুধু স্কোয়াডের অংশ হতে পারবে সে। এ রকম একটি রত্নকে অবলীলায় চূড়ান্ত ১৫ জনে না রাখার সিদ্ধান্তই অস্ট্রেলিয়ার গোলাবারুদের মজুদ কতটা, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম।
যদিও আইপিএলের ‘কপি’ এই বিশ্বকাপ হবে বলে আমার মনে হয় না। অনেকেরই ধারণা, ভারতের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের মতো দেদার রানবন্যা বয়ে যাবে বিশ্ব আসরে। কিন্তু এখানে এটিও মাথায় রাখতে হচ্ছে যে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ ব্যবহারের নিয়মটি বিশ্বকাপে থাকছে না। বাড়তি একজন পুরোদস্তুর ব্যাটার খেলাতে পারায় আইপিএলের দলগুলো অবশ্যই উপকৃত হয়েছে।
এবার যে আমরা প্রচুর রানের ম্যাচ অনেক দেখেছি, তাতে এই নিয়মের সুবিধাই পেয়ে এসেছে একেকটি দল। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেটও অবাধ রানপ্রবাহের নিশ্চয়তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ব্যাট-বলের সমান সমান লড়াইয়ে জমজমাট এক বিশ্বকাপের সম্ভাবনা দেখছি। আমার বিষয় যেহেতু শিরোপার অঙ্ক, তাই একেবারে গ্রুপ পর্ব থেকে প্রতিটি দলের শক্তিমত্তা কিংবা দুর্বলতার বিশ্লেষণে যাচ্ছি না।
শুরু করছি সেমিফাইনাল পর্ব থেকেই। আমি শেষ চারে দেখছি চারটি দলকে। দুটি দলের কথা তো এরই মধ্যে বলেছি। ভারত আর অস্ট্রেলিয়া। অন্য দুটি বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
জানি, প্রোটিয়াদের কথা বলতেই কঠিন পরিস্থিতিতে সব সময় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া এক দলের ছবি আপনাদের চোখে ভেসে উঠছে। এমন নয় যে আমার চোখেও ভাসেনি। তবে শেষ চার পর্যন্ত ওদের পৌঁছে যাওয়ায় কোনো সমস্যা দেখছি না। ওদের খেলোয়াড়রাও ফর্মে আছে, বিশেষ করে হেইনরিখ ক্লাসেন। ওদের দলগত ভারসাম্য যা, তাতে সেমিফাইনালের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু এরপর? শিরোপা লড়াইয়ের অঙ্কে ‘নার্ভ’ ধরে রাখার যে বিষয়টি, সেটি দক্ষিণ আফ্রিকাকে পিছিয়ে রাখছে বলে ওদের ফাইনালে দেখছি না। দেখছি না ইংল্যান্ডকেও। যদিও জফরা আর্চারকে নিয়ে ওরা বিশ্বকাপে খেলছে। শক্তি বাড়ার কথা, কিন্তু এত দিন পরে এই ফাস্ট বোলার কতটা ছন্দে ফিরতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।
ব্যাটিংয়ে পাওয়ার হিটার প্রচুর থাকলেও বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের বোলিংটা এবার খুব জমাট বলে মনে হচ্ছে না। দলীয় ভারসাম্যের এই ঘাটতি থাকায় ওদেরকেও আমি ফাইনালে নিচ্ছি না। নিচ্ছি যাদের, তাদের মধ্যে ভারতের বহুমাত্রিক শক্তিমত্তা।
তিন-তিনজন কোয়ালিটি স্পিনার ওদের দলে। ব্যাটারদের কেউ কেউ হয়তো ফর্মে নেই, তবু যথাসময়ে তারাও জ্বলে উঠবে বলে বিশ্বাস করি। বোলিংয়েও ওদের বিকল্পের অভাব নেই। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেটও আমাদের এশিয়ার মতোই। এর সুবিধাও ভারত পাবে।
তবে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়াকে ওদের চেয়ে না এগিয়ে রেখে পারছি না। আইপিএলেই দেখুন না, ওদের খেলোয়াড়রা দারুণ ছন্দে আছে। অস্ট্রেলিয়াকে সর্বশেষ অ্যাশেজ এবং ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতানো ট্রাভিস হেডও বিশ্বকাপে রান করার প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে আইপিএল থেকে।
শুরুতে কত সমালোচনা অথচ যত সময় গেছে, ততই ছন্দে ফিরেছে ফাস্ট বোলার মিচেল স্টার্কও। বলতে পারেন, আইপিএলে অস্ট্রেলিয়ানদেরই আধিপত্য। আর এটি যখন আইসিসি ইভেন্ট, আমি নিশ্চিত যে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সম্ভাবনায় ওরা যে কারো শীর্ষ বাছাইয়ের মধ্যে থাকেই থাকে।
ব্যাটিংয়ের ফায়ার পাওয়ার ও বোলিং বৈচিত্র্য মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়া তাই শিরোপার সেরা দাবিদার। নক আউট ম্যাচ কিভাবে জিততে হয়, সেটিও ওদের চেয়ে ভালো কেউ জানে বলে আমার মনে হয় না। তা ছাড়া ফাইনালের মতো স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ে ‘নার্ভ’ ঠিক রাখার দিক থেকেও ওরা ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে। এ জন্যই বলছিলাম, এবারের ফাইনাল হবে আহমেদাবাদের ‘রিপ্লে’!-কালের কণ্ঠ