রফিকুল ইসলাম : বাবা শাহা আলমের মুখটা মনে নেই আরচার মো. সাগর ইসলামের। সোমবার রাতে প্যারিস অলিম্পিকে কোয়ালিফাইয়ের কীর্তি গড়া সাগরের বয়স যখন মাত্র ৩ বছর তখন তার বাবা মারা যান স্ট্রোক করে।
সবার ছোট সাগর ইসলামরা দুই ভাই দুই বোন। চার সন্তানকে নিয়ে সংসার চালানোর জন্য সাগরের মা সেলিনার একমাত্র অবলম্বন ছিল একটি চায়ের দোকান। রাজশাহী শহরের ছোট বনগ্রাম এলাকায় ছোট্ট দোকানে চা বিক্রি করেই সংসার চালাতেন সাগরের মা।
সোমবার রাতে তুরস্কের আনতালিয়া থেকে সাগর ইসলাম যখন তার পরিবার, নিজের বেড়ে ওঠা, আরচার হওয়া, বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া এবং অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করাসহ নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন তখন বারবার তার মুখে ছিল মায়ের চায়ের দোকানের কথা। মায়ের ওই ছোট্ট চায়ের দোকানটি যেন সাগরের অনেক গর্বের। সাগর নিজেই এখন গর্ব দেশের মানুষের।
‘পনের বছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন। আমার বয়স তখন ৩ বছর। বাবা বেঁচে থাকলে আজ অনেক খুশি হতেন। তবে আমার জীবনের সবকিছুতে বড় অবদান মায়ের। সংসারে আমি সবার ছোট। বড় দুই বোন ও ভাই বিয়ে করেছেন।
মা চা বিক্রি করে আমাদের মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন। সবাইকে মানুষ করেছেন। ১৪ বছর ধরে মা সেই চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। এখন চায়ের সঙ্গে ভাতও বিক্রি করেন। আমার বড় ভাই মাকে দোকানে সহযোগিতা করেন’- অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করে হোটেলে ফিরে বলছিলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মাধ্যমিকের এই শিক্ষার্থী।
স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি চায়ের দোকানে মাকে সহযোগিতা করতেন। ফাঁকে বাসার পাশের এসবি আরচারি ক্লাবেও যেতেন সাগর ইসলাম। ধীর ধনুক নিয়ে অনুশীলন করতেন। ২০১৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। পরেরবার সফল হয়েছেন। ২০১৯ সালে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন সাগর ইসলাম।
তুরস্কে রিকার্ভ ব্যক্তিগত ইভেন্টের সেমিফাইনালে উঠে অলিম্পিকে সরাসরি খেলা নিশ্চিত করা সাগর শেষ পর্যন্ত জিতেছেন রৌপ্য পদক। ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারেননি উজেবেক আরচারের সঙ্গে। জিতলে অলিম্পিক কোয়ালিফাই করার মঞ্চটি আরো রাঙাতে পারতেন রাজশাহীর ১৮ বছরের এই প্রতিভাবান আরচার।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এটি তার তৃতীয় রৌপ্য পদক। আছে আরো দুটি ব্রোঞ্জও। তবে এবারের এই রৌপ্যটি তার কাছে বিশেষ কিছু। হবেই না কেন? এই রৌপ্য জয়ের পথে তিনি যে প্যারিস অলিম্পিকের টিকিটও হাতে পেয়েছেন! বাংলাদেশের ক্রীড়ার প্রেক্ষাপটে সরাসরি অলিম্পিক খেলতে পারা বিশেষ কৃতিত্বেরই। যেখানে অন্যদের তাকিয়ে থাকতে হয় আইওসির ওয়াইল্ডকার্ডের দিকে।
তুরস্কে একসঙ্গে দুটি প্রতিযোগিতায় খেলছেন আরচাররা। অলিম্পিক কোটা প্লেস প্রতিযোগিতা শেষ। আজ (মঙ্গলবার) থেকে শুরু হচ্ছে বিশ্বকাপ স্টেজ-৩।
প্রথম প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দারুণ সফল সাগরের কৃতিত্বে। সাগরকে এখন অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুত করতে ফেডারেশন সম্ভাব্য সবকিছু করবেন বলে জানিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ চপল, ‘অলিম্পিকের সময় বেশি নেই। এই সময়ের মধ্যে আমরা সাগরের প্রস্তুতির জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবো।’
অলিম্পিকে কোয়ালিফাইয়ের পর সতীর্থ, কোচ, অফিসিয়ালসহ অনেকেই অভিনন্দন জানিয়েছেন সাগরকে। এমনকি অভিনন্দন পেয়েছেন লাল-সবুজের বাংলাদেশ থেকেও। কিন্তু সাগর খুশির খবর যাকে সবার আগে দিতে চেয়েছিলেন সেই মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারেননি। কারণ, তার মা সেলিনার যে মোবাইল ফোনই নেই!
আমার ভাইয়ের মোবাইলে মায়ের সঙ্গে কথা বলি। আমি কোয়ালিফাইয়ের পর মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। কারণ, তখনো ভাই বাসায় ফেরেননি। রাতে ভাই বাসায় ফেরার পর মায়ের সঙ্গে কথা বলে শুভ সংবাদ দিয়েছি। তার আগেই অবশ্য তিনি শুনেছিলেন’- বলছিলেন সাগর ইসলাম।
সাগর তার মায়ের অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন,‘আজ মায়ের হাতে মোবাইল নেই। তিনি পরিশ্রম করে সবই করেছেন আমাদের ভাই-বোনদের জন্য। এখন আমি জাতীয় দলে খেলে যে সম্মানী পাই তাতেই আমার চলে। অথচ এক সময়ে মায়ের কাছে টাকার জন্য কত আবদার করতাম। তিনি কষ্ট হলেও দিতেন।’
তুরস্ক যাওয়ার আগে কখনো কি ভেবেছিলেন অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করতে পারবেন? ‘আমার বিশ্বাস ছিল। কারণ, ভালো অনুশীলন করেছি। কষ্ট করেছি। কোনো ছুটিতে যাইনি। নিশ্চিত ছিলাম না। তবে আত্মবিশ্বাস ছিল’-বলছিলেন দেশের আরচারির নতুন তারকা সাগর ইসলাম।
অলিম্পিক গেমস ক্রীড়াবিদদের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। সেখানে কী লক্ষ্য নিয়ে যাবেন? সাগরের চোখ পদকেই, ‘আসলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছি। এখন সেখানে খেলতে যাবো ততটা ভালো করা যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে। আর পদক জয়ের স্বপ্ন কার না থাকে? পদকের স্বপ্ন নিয়েই প্যারিসে যাবো।’
কোটা প্লেসের ফাইনালেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে পারলেন না। সেখানে অলিম্পিক তো আরো কঠিন জায়গা? ‘তুরস্কেও সবগুলো ম্যাচ কঠিন ছিল। ফাইনালে আসলে হয়নি। পুরোদিন খেলার মধ্যে ছিলাম। কোনো বিশ্রাম ছিল না। এমন হতেই পারে। তবে আমি সন্তুষ্ট’-বলছিলেন সাগর ইসলাম।-জাগোনিউজ২৪