সোমবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০৫:৩৯:১৪

দেশে ফিরে একটি ফুলও জুটল না মাবিয়ার!

দেশে ফিরে একটি ফুলও জুটল না মাবিয়ার!

রাশেদুল ইসলাম: কত উচ্ছ্বাস, কত আহ্লাদ, কত আবেগ- কোথায় গেল সবকিছু! টেলিভিশনে যে মেয়েটির কান্নার দৃশ্য গোটা দেশের হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছিল। মাবিয়া আকতার সীমান্তর যে আনন্দাশ্রুতে 'আমার সোনার বাংলা...' সুর গৌহাটির বাতাস মুখর করে তুলেছিল, এসএ গেমসের সেই স্বর্ণকন্যাকে কি একটি ফুল দিয়েও বরণ করা উচিত ছিল না? একটি শুকনো শুভেচ্ছাবার্তাও কি তার প্রাপ্য ছিল না? কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের যে গর্ব তবে কি তা হারিয়ে যেতে শুরু করেছে? প্রশ্ন জাগে নীরবে ঢাকায় ফেরা স্বর্ণকন্যার শুকনো মুখটি দেখে। শহরের ঘিঞ্জি মহল্লার টিনের ঘরে এখনও যে জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।

বুধবার তামাবিল সীমান্ত দিয়ে যখন দেশে ফেরেন মাবিয়া, ভেবেছিলেন ফুল নিয়ে কেউ না কেউ অপেক্ষা করবে তার জন্য! অথচ কেউ খোঁজও নেয়নি তার। এটা কি সম্ভব হতো, যদি ক্রিকেট দল দেশের বাইরে থেকে কোনো ট্রফি জিতে আসত? কিংবা ফুটবল দল জিতে আসত কোনো ম্যাচ? প্রশ্নটা অভিমানী মাবিয়ার, যার উত্তর জানা নেই কারও।

অভাবের সংসারে সংগ্রাম করে বড় হতে হতে এখন আর কারও ওপর আক্ষেপ বা অভিমান হয় না মাবিয়ার। শুধু কষ্ট হয়, 'যদি আমার বাবা-মাকে একটু ভালো জায়গায় রাখতে পারতাম, একটু ভালো পরিবেশে থাকতে পারতাম...।' বলতে বলতে থেমে যান মাবিয়া। খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগের এক ঘিঞ্জি এলাকার দুই কামরার একটি টিনের ঘর। অনটনের সংসারে বাবার ছোট্ট মুদি দোকানটাই ভরসা। মেয়ে ভারোত্তোলক বলে কোচের পরামর্শ মেনেই অনেক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হয়। মেনে চলতে হয় অনেক কিছু! কিন্তু মুদি দোকানি বাবার পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না, অর্থের অভাবে পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায় একসময়।

কিন্তু যার ভাগ্যে আছে স্বর্ণমুকুট, সে কি দমে থাকতে পারে! তাই পেটে অল্প কিছু দিয়েই মাবিয়া চলে যান ভারোত্তোলন ফেডারেশনে, কিছু সুহৃদের চেষ্টায় এখনও এ গেমটি চালিয়ে যেতে পারছেন মাবিয়া। আনসার থেকেও একটি চাকরি দেওয়া হয়েছে তাকে, যা পাওয়ার পর নিজেই আবার পড়ালেখা শুরু করেছেন। কিন্তু নিজের জেদ আর শক্তি দিয়ে এতটুকু পথ আসার পর মাবিয়া কি রাষ্ট্রের কাছে চাইতে পারে না কিছু।

এই দেশকে নিয়ে এসএ গেমসে অন্য দেশের অ্যাথলেটরা যখন কানাঘুষা করতেন, যখন বাংলাদেশ পদক পাচ্ছে না গেমসে বাংলাদেশিদের কটাক্ষ করা হতো, তখনই এসেছিল মাবিয়ার স্বর্ণপদক। আর গেমসে অন্যদের কাছ থেকে দেশের সম্মান বাঁচাতে পারার আনন্দেই সেদিন পুরস্কারমঞ্চে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন মাবিয়া, 'সেদিন যখন প্রথমবারের মতো আমার হাত ধরে আমাদের ইভেন্টে বাজল সে সুরটা, সত্যি কথা- নিজেকে সামলাতে পারিনি। সে সময় ওই মঞ্চে দাঁড়িয়েও আমার শুধু মনে হয়েছিল, আমাদের নিয়ে গেমসে আর কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না। আমাদের ভারোত্তোলনকে আর কেউ খাটো করে দেখবে না। বিশ্বাস করুন, ওই অতটুকু সময়ের মধ্যেও শুধু এগুলোই ভেতরে কাজ করছিল।' গতকাল নিজের বাসায় বসে যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখনও স্বর্ণকন্যার চোখ ছলছল করছিল।

চাওয়া তো তার তেমন কিছু নয়, 'সবাই মুখে মুখে বলছেন, আমি বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছি। কিন্তু কেউ তো আমার জন্য সেদিন বর্ডারে দাঁড়িয়ে ছিলেন না। কিছু না দিক, অন্তত মৌখিকভাবে আমাকে অভিনন্দন জানালেও খুশি হতাম।

অথচ ক্রিকেট হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যেত। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলায় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের মানুষরা আসেন। অথচ আমাদের খবর কেউ রাখেন না। আমাদের ভারোত্তোলনে অনেক প্রতিভাবান আছেন। একটু নজর দিলে তারা অলিম্পিক থেকেও পদক এনে দিতে পারেন।'

স্বপ্নটা তার অনেক বড়, কিন্তু সীমাবদ্ধটা তার চেয়েও বোধহয় বড়। যেখানে ভারোত্তোলনের মতো বিশেষ ইভেন্টগুলোতে অন্যান্য দেশের ক্রীড়াবিদদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকে, স্পন্সররা সম্ভাবনাময় ক্রীড়াবিদদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে থাকে। সেখানে মাবিয়া আক্তার সীমান্তদের 'বাড়তি খাওয়া'র জন্যই কথা শুনতে হয়। সারাক্ষণ চিন্তা করতে হয়, বাসে চড়ে কীভাবে সময়মতো অনুশীলনে যেতে পারব? বাসে সিট পাব তো? পরীক্ষার ফি বাবা জোগাড় করতে পারবে তো? মায়ের ওষুধ ফুরিয়ে যায়নি তো?-সমকাল
১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জেএম/আরএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে