নাজমুল হক তপন : বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা একটা গল্পের নাম ‘টোপ’। ওই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিদার বাবুর প্রিয় হবি বাঘ শিকার। ছাগল, ভেড়া এই ধরনের টোপ ব্যবহার করেও বাঘ শিকারে সুবিধা করে উঠতে পারছিলেন না জমিদার বাবু। বাঘ আকৃষ্ট করতে তিনি টোপ হিসেবে ব্যবহার করলেন মানব শিশু। গরীব মানুষের দু-একটা শিশু হারিয়ে গেলে কেই বা তার খোঁজ রাখে? মানব শিশুকে ‘টোপ’ হিসেবে ব্যবহার করে চূড়ান্ত সাফল্য পান জমিদার বাবু। যথারীতি রক্তের নেশায় বাঘ আসে এবং শিশুটি পরিণত হয় শিকারে। সালমা খাতুনদের নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট অভিভাবক বিসিবির (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) কর্মকান্ড স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ‘টোপ’ গল্পটার কথাই।
জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় পাকিস্তানে ক্রিকেট সফর বয়কট করে আসছে সব দল। একটা সময় অন্য দলগুলো বর্জন করলেও পাকিস্তান সফর করেছে বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা। ২০০৮ সালের ৩ মার্চ লাহোরে ম্যাচ খেলতে যাওয়ার পথে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের কাছেই লংকান টিম বাসকে লক্ষ্য করে গুলি ও গেনেড ছোড়ে আততায়ীরা। ওই হামলায় ৬/৭ জন লংকান ক্রিকেটার আহত হন। আততায়ীদের হামলায় ছয় নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াও নিহত হন আরো দুজন। এর পর থেকে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পুরোপুরি বন্ধ। পাকিস্তান নিজেদের ম্যাচগুলো খেলে অন্য দেশে গিয়ে।
দুঃসময়ে হাত বাড়িয়ে দেয়া লংকানদের সফরের প্রস্তাব দেয়ার আর মুখ নেই পাকিস্তানের। এখন তাদের দেশে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরানোর জন্য পিসিবির (পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড) মূল টার্গেট বাংলাদেশ। এ নিয়ে অনুনয়-বিনয়-হুমকি-ধামকি সব কৌশলই প্রযোগ করে যাচ্ছে পিসিবি। আমাদের দেশে সফরে না এলে আমরাও তোমাদের দেশে যাব না, বিপিএলে প্লেয়ার দেব না, তোমাদের ঘরোয়া লীগে খেলোয়াড় দেব না - নিত্য নতুন সব ফন্দি-ফিকির হাজির করছে তারা। পাকিস্তান সফরের পশ্নে বাকি বিশ্বের পথই এতোদিন অনুসরণ করে এসেছে বিসিবি। তাদের আবদার- অনুরোধ- হুমকি সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তান সফরে দল পাঠায়নি বাংলাদেশ। সাকিব-মুশফিক-তামিমদের ঝুঁকির মুখে না পাঠানোর জন্য সাধুবাদও পেয়ে আসছে বিসিবি।
বাংলাদেশ ছেলে ক্রিকেটারদের বিসিবি তথা বাংলাদেশ সরকার যে তাদের দেশে সফরে পাঠাবে না এটা নিশ্চিত হয়ে গেছে পাকিস্তান। এখন তারা ধরেছে অন্য পথ। সাম্প্রতিক সময়ে অভাবনীয় উন্নতি করেছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা। ছেলেদের তুলনায় হাজার ভাগের এক ভাগ সুযোগ-সুবিধা না পেয়েও ইচ্ছাশক্তির জোরে মাঠে আলো ছড়াচ্ছেন সালমা- শুকতারা- জাহানারা- পান্না ঘোষরা। ২০১৪ টি২০ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে শক্তিশালি শ্রীলঙ্কাকে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। নবম স্থান নির্ধারনী ম্যাচে র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা আয়ারল্যান্ডকেও হারায় সালমারা। মোট কথা ন্যূনতম যে সুযোগ পেয়েছে সেটুকুই সর্বোচ্চ কাজে লাগিয়েছে দেশের নারী ক্রিকেটাররা। আমাদের নারী ক্রিকেটারদের প্রায় সবাই উঠে এসেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই তাদের নিত্যসঙ্গী। তাদের সঙ্গে মিডিয়া নেই, স্পন্সর নেই এমনকি দর্শকও নেই। টিভি চ্যানেলগুলোয় সাকিব-তামিম- মুশফিকদের নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। অর্থ-বিত্ত- প্রতিপত্তি সবকিছুই সাকিবদের। ব্ল্যাঙ্ক চেক নিয়ে সাকিবদের পেছনে ছুটছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আর ওদিকে প্রায় নির্বাসনে থেকেই উজান স্রোতে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে সালমাদের।
আনুমানিক ঘোষণা না দিলেও সালমাদের পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য করণীয় সবকিছুই করেছে বিসিবি। নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হল। পর্যবেক্ষক দল রিপোর্টও করল। কিন্তু সেই রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হলো না। একই সময়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সংবাদ আসলো যে বাংলাদেশের মেয়েদের পাকিস্তান সফরে না আসলে আসন্ন বিপিএলে তাদের ক্রিকেটারদের খেলার অনুমতি দেবে না পিসিবি। এমনি অবস্থায় করাচিতে সালমাদের পাঠানোর আনুসঙ্গিক আয়োজনও সেরে রেখেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। এখন সরকারের সবুজ সংকেত পেলেই বাংলাদেশের মেয়েদের পাঠানো হবে এমন কথা বলেছেন বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজন।
এদিকে সালমাদের পাকিস্তান পাঠানোর সম্ভাব্য তারিখ এমাসের ২৭ কিংবা ২৮ এটাও জানা গেছে বিসিবি সূত্র থেকে। এমনকি মেয়েদেরকে পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য দুদিনের বিমানের টিকেট বুকিংও দেয়া হয়েছে, এমন খবর এসেছে গণমাধ্যমে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ পাকিস্তানে সালমাদের নিরাপত্তা বিষয়ে সরকারি অবস্থান কি সেটা অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন পড়ে না বিশেষজ্ঞ হওয়ার। এ নিয়ে বিসিবির মহিলা উইং প্রধান আবদুল আউয়াল চৌধুরীও তার সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক দলের প্রতিবেদন মোটামুটি সন্তোষজনক। পিসিবি আমাদের প্রায় সব শর্ত মেনে নিয়েছে। আমাদের আপত্তির কারণে এখন দুটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি হবে। এসব শর্তে তারা রাজি হয়েছে।’
গোটা ক্রিকেট দুনিয়া যে পাকিস্তান সফর বর্জন করছে তার কারণ নিরাপত্তা। স্বভাবতই প্রশ্নটাই এসেই যায়। পাকিস্তানে নিরাপত্তা ঝুঁকি কাদের বেশি সাকিবদের নাকি সালমাদের? সামান্য বোধবুদ্ধি যাদের আছে সবার কাছেই উত্তরটা সহজ। মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে এটাই যে টেররিস্ট গ্রুপগুলো মানতে পারে না সেখানে বাংলাদেশের মেয়েরা তাদের দেশে গিয়ে ক্রিকেট খেলবে! মালালার ঘটনা কি কারো পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব? গত মাসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় পাঞ্জাবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুজা খানজাদাসহ আরো ১২ জন। কাছকাছি সময়ে করাচিতে পাকিস্তানে কিংবদন্তী ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরামের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ আগে পাকিস্তান সফরের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সালমা খাতুন বলেন, ‘পাকিস্তান যেতে তো ভয় লাগবেই। এত কিছু হচ্ছে ওখানে। ওয়াসিম আকরাম আক্রান্ত। কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। বিসিবি আমাদেরকে যেখানে যেতে বলবে আমরা সেখানেই যেতে বাধ্য।’ এর পর থেকে পাকিস্তান সফর নিয়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেটরদের মুখে কুলুপ।
পাকিস্তানে সাকিবদের চেয়েও সালমাদের ঝুঁকি বেশি তারপরও কেন এ সফরে রাজি হল বিসিবি? কারণটা মোটেও জটিল নয়। অর্থে- প্রাচুর্যে- বিত্ত- বৈভবে সাকিবদের অবস্থান যদি হয় আকাশে তাহলে সালমাদের অবস্থান পাতালে। টোপ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য যুগ যুগ ধরে সালমারাই যে আদর্শ সেই সত্যটিই নতুন করে সামনে টেনে আনলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্ণধাররা।-বণিকবার্তা
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে