সুলতান মাহমুদ কনিক : গত ৭ জুলাই (ঈদ-উল-ফিতরের দিন) সকাল থেকেই শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের বিভিন্ন চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি, তদন্ত) মো. মুর্শেদ জামান। সেই সময় সাহসিকতার সাথে বন্দুকযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিহত করেন জঙ্গিদের। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা বন্দুকযুদ্ধে পুলিশ ৬৫৬ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। এরমধ্যে মুর্শেদ জামানের ছোঁড়া গুলিতেই প্রথম নিহত জঙ্গি আবির রহমানের পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর এলোপাতাড়ি গুলিতে তার মৃত্যু নিশ্চত হয়। ঘটনার সময় এই সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছাড়াই বন্দুকযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা হিসেবে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়েই কেন বন্দুকযুদ্ধে লিপ্ত হলেন- এটা যেমন একটা প্রশ্ন, তেমনি তার সাহসিকতারও প্রশংসা করা হচ্ছে। এসব প্রশ্ন নিয়েই সেই সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা মুর্শেদ জামানের সঙ্গে কথা বলেছেন কিশোরগঞ্জের এই প্রতিনিধি।
প্রশ্ন : প্রথমে আপনি কীভাবে জানতে পারলেন বন্দুকযুদ্ধ চলছে?
মুর্শেদ জামান: ওয়ারলেসে আমরা সবাই শব্দ শুনছি, বাঁচাও বাঁচাও। এ রকম শব্দ শোনার পরে এসপি স্যার প্রথম রিপ্লে দিছে, কে... কোন স্টেশন। আবার কিছুক্ষণ পরে, এসপি স্যার যখন কন্ট্রোলে ডাকতেছে, তখন আবার ওই কণ্ঠস্বরে বলছে, আমাদের ওপর বোমা মারছে, আজিমুদ্দিন স্কুলের কাছে। এই সংবাদ পেয়ে এসপি স্যার নির্দেশ দিলেন, সদর থানার ওসি স্যার আর আমাকে ওয়ারলেসে বললেন তোমরা তাড়াতাড়ি যাও।
প্রশ্ন : এসপি সাহেবের নির্দেশ পাওয়ার পরে কী করলেন?
মুর্শেদ জামান: নির্দেশ পেয়েই আমি আর ওসি স্যার আসতেছি, তখন রাস্তায় যারা দায়িত্ব পালন করছিল, সেখান থেকে চায়না অস্ত্র দেখে চারজন কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে আজিমুদ্দিন স্কুলের মাঝ মাঠে আসি। তখন ঘটনাস্থলে আক্রান্ত কনস্টেবল আসাদুল আমাদের কাছে এসে বলে, স্যার ওইখানে সবাইকে মারতাছে, ওদেরকে বাঁচান। এই কথা শুনে আমি যখন দেখলাম সাথে যে ফোর্স তা দিয়ে কিছু হবে না, তখন এক কনস্টেবলের কাছ থেকে চায়না রাইফেলটা হাতে নিয়েই সামনে এগিয়ে যাই। তখন আমার সাথে চার-পাঁচজন আছে। আর ওসি স্যার আরো ফোর্স ডাকছে। কিন্তু জায়গাটা এরকম ছিল যে ঘটনাস্থল মুফতি মোহাম্মদ আলী জামে মসজিদ পাশে জঙ্গিরা একটা ব্যাকআপে ছিল। কিন্তু আমাদের কোনো ব্যাকআপ ছিল না। কোনো দেয়াল ছিল না।
প্রশ্ন : এরপর?
মুর্শেদ জামান: তখন, আজিমুদ্দিন স্কুলের রাস্তার পাশে গাছের আড়াল থেকে গুলি করতে করতে একটা একটা গাছ আগাচ্ছি। আগানোর পরে যখন কাছাকাছি চলে আসছি, তখন চিন্তা করলাম যে ওরা যদি পিছু না হটে, তাহলে ওদের কাছে তো বোমা আছে। তাই, একটা টার্গেট নিয়ে আর সামনে না গিয়ে গুলি করতে থাকি। এভাবে উপর নিচ থেকে কিছুক্ষণ গুলি করার পর, তারা পেছন দিকে চলে যায়। ওখন দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠাই। এ সময় আমার সহকর্মীদের রক্ত আমার হাতে শরীরে লাগে। এরপরই আমি চিন্তা করি, আর কিছু পারি আর না পারি ওদের এখান থেকে পালাতে দিবো না।
প্রশ্ন : এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?
মুর্শেদ জামান: জঙ্গিরা তখন মসজিদের পাশের গলিতে ঢুকে যায়। আশপাশ থেকে তখন মানুষ দেখছিলো। ওরা ওই জায়গায় সবাইকেই মারছে, কিন্তু পরে থাকা পুলিশের কোনো অস্ত্র নেয় নাই। তখন অস্ত্রগুলো আমাদের হেফাজতে নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই, কোন দিকে যাবো, কীভাবে কাজ শুরু করবো। এমন সময়েই তারা গলির ভেতর থেকে গুলি করতে শুরু করে। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, জঙ্গিরা পালাতে চাচ্ছে না, তারা পালানোর মত না। তারা ওই গলির আড়াল থেকে বের হয়ে গুলি করতেছিল। কিন্তু আমরা যে জায়গাটাতে অবস্থান নিই, তা একেবারে গলির সোজা রাস্তা। সেখান থেকে আড়াল নিয়ে গুলি ছোড়ার কোনো সুযোগ ছিল না।
প্রশ্ন : কতক্ষণ ধরে চলে বন্দুকযুদ্ধ?
মুর্শেদ জামান : গোলাগুলি চলছে প্রায় দুই ঘণ্টার উপরে। তখন প্রতি মুহূর্তেই তারা আক্রমণ করতেছিল।
প্রশ্ন : আপনার পরনে তখন পাঞ্জাবি ছিল। ওইদিন কি দায়িত্বে ছিলেন?
মুর্শেদ জামান : আমি ঈদের আগের সারারাত দায়িত্ব পালন করি। ব্যাগ তল্লাশি এবং মাঠের নিরাপত্তার জন্য এসপি স্যার যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের জন্য মাঠে ছিলাম। সকাল বেলা যে চেকপোস্ট আছে এবং যারা যারা সাসপেক্ট, আমাদের এসবির নির্দেশে সাদা পোশাকে সার্ভিলেন্স করার জন্য নিয়োজিত ছিলাম।
প্রশ্ন : বন্দুকযুদ্ধে কতগুলো গুলি ছুঁড়েছেন? যেটুকু শুনলাম তাতে আপনার গুলিতেই তো সন্ত্রাসী আবির নিহত হয়েছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?
মুর্শেদ জামান : প্রায় ১০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ি আমি। সন্ত্রাসী আমার গুলিতে মারা গেছে ঠিক তা নয়, তবে প্রথম আমার গুলিটাই ওর পায়ে লাগে। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর অনেকেরই গুলি লাগছে তার শরীরে।
প্রশ্ন : প্রথমে আপনার শরীরে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট তো ছিল না, এটা ছাড়া কেন অংশ নিলেন?
মুর্শেদ জামান : আমার কনস্টেবলদের দ্রুত উদ্ধার এবং ওই জায়গাটায় যাওয়া ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। আমি যদি ওই সময় সামনে না আগাই, তাহলে আমার পেছনে যে কনস্টেবলরা ছিল, তারা সাহসই পেত না ওই জায়গায় যাওয়ার।
প্রশ্ন : গুলশান ট্রাজেডিতে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। এইভাবে সাহসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো, তাহলে তার দায়িত্ব কে নিতো?
মুর্শেদ জামান : আসলে শোলাকিয়াতেও আমার পুলিশ অফিসাররা আহত হয়েছে। এক কনস্টেবল তো ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তার লাশটা যখন আমি উদ্ধার করি, তখন তার রক্ত আমার শরীরে লেগেছিল। তখন আমার কাছে আর কোনো রিস্ক মনে হয় নাই। যে জায়গাটাতে গেছি আমি, যে ছবিটা দেখে আপনাদের কাছে মনে হচ্ছে, সেটা আমার কাছে কোনো ঝুঁকি মনে হয় নাই। ওই জায়গা থেকে আমি সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষভাবে দেখতেছিলাম। তার কাজকর্মগুলো দেখতে পারছিলাম। এসময় তাকে দেখে আমার মেধা, বুদ্ধি সম্পুর্ণ ছিল তাৎক্ষণিকভাবে।
প্রশ্ন : একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে এই হামলাকে কীভাবে দেখছেন?
মুর্শেদ জামান : নারকীয় তাণ্ডব। জঙ্গি হামলা এবং তাদের ভেতর কোনো ভয়ভীতি ছিল না। হামলাকারীদের কোনো মৃত্যু ভয় ছিল না। তারা প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের গুলি করেছে। যতক্ষণ আমরা তার পেছনে পেছনে গেছি, ততক্ষণ সে গুলি করছে। শেষ মুহূর্তে যখন তার অস্ত্রে গুলি জ্যাম হয়ে যায়, বা অন্য কোনো কারণে গুলি ছুঁড়তে পারে নাই, তখন আমরা গুলি বন্ধ রাখি। আমরা দেখছিলাম, জঙ্গিরা কী করে। আমরা পরীক্ষা করার জন্য কিছু সময় গুলি বন্ধ রাখি। পরে দেখি সে বের হয়ে গেছে। কিন্তু নিহত জঙ্গি আবির এরকম ছিল যে, শেষ পর্যন্ত সে আমাদের আঘাত করবে।
প্রশ্ন : আপনারা কয়জনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন?
মুর্শেদ জামান : আমরা প্রত্যক্ষভাবে দুইজন জঙ্গির সাথে যুদ্ধ করেছি।
প্রশ্ন : ছবিতে দেখেছি ঘটনার সময় আপনার সঙ্গে থাকা অন্যরা পিছিয়ে ছিল। কেন?
মুর্শেদ জামান : অন্যরা পিছিয়ে ছিল না। আমাদের পুলিশ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল। তারা পালাতে পারে নাই এই একটি মাত্র কারণে। কারণ, জঙ্গিদের পালানোর সব পথ ততক্ষণে আমাদের অফিসাররা অবস্থান নিয়ে ফেলেছে।
প্রশ্ন : ঈদের দিন কী পরিকল্পনা ছিল?
মুর্শেদ জামান : আমাদের এসপি স্যার বলেছিলেন যে, সুন্দরভাবে ঈদের জামাত শেষ করতে পারলে, ছুটি দেয়া হবে, পরিবার নিয়ে ঈদ উদযাপনের জন্য। ভাবছিলাম বাড়ি যাবো, সবাইকে নিয়ে ঈদ করবো। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না।
প্রশ্ন : ঘটনার সময় আর কোনো আপনজন ফোন করেছিল?
মুর্শেদ জামান : ঘটনা চলাকালে পরিবার থেকে, এলাকা থেকে অনেকেই ফোন করেছিল। আমি শুধু পরিবারকে বলছি, আমি ভালো আছি। দোয়া করো। অনেকেই ফোন করে সন্ত্রাসীদের অবস্থান সম্পর্কে অবগত করেছে, যে তারা কোন জায়গার মধ্যে অবস্থান নিয়েছে। আশপাশের বাসা বাড়ি থেকেই বেশি ফোন এসেছে। আমাদের এলাকার প্রত্যেক লোকই প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে।
প্রশ্ন : এই ঘটনা আপনাকে কী অভিজ্ঞতা দিল?
মুর্শেদ জামান : আমি একটা বিষয় বলতে পারি, যে আমার আরেকটু ‘সিকির্উড’ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো। আরেকটু স্বয়ংসম্পুর্ণ হয়ে যাওয়া উচিত ছিলো, তাহলে আরও কম সময়েই আমরা তাদের পরাস্ত করতে পারতাম। এটা এখন আমার বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন : ভবিষ্যতে দেশের জন্য আরও কী ধরণের কাজ করতে চান?
মুর্শেদ জামান : আমি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। পুলিশ বাহিনীতে আছি, এটি একটি সেবামূলক পেশা। আমি মনে করি এটা একটা রহমত, যে সঠিকভাবে সেবা দিতে পারা। আমি আরও ভালো ভালো কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন : আপনার পুলিশে যোগদানের তারিখ?
মুর্শেদ জামান : ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখ। প্রথম যোগদান করি ডিএমপিতে।
প্রশ্ন : আপনার দেশের বাড়ি এবং স্ত্রী সন্তান?
মুর্শেদ জামান : ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানা। স্ত্রী এবং এক মেয়ে এবং এক ছেলে রয়েছে।
প্রশ্ন : সর্বশেষ কবে পদোন্নতি পেয়েছেন?
মুর্শেদ জামান : ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে পদোন্নতি পেয়ে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় পরিদর্শক (ওসি, তদন্ত) হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মুর্শেদ জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ। -বাংলামেইল
১০ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম