কিশোরগঞ্জ: গুলশানের পর ছক অনুযায়ী শোলাকিয়ায় হামলা চালায় জেএমবি (জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ)। হামলার নেপথ্যের হোতা সাকিব মাস্টার। ধরা পড়া জঙ্গি শফিউল ইসলামের কাছ থেকে এ বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাকে ধরতে বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়া ও গাইবান্ধার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হয়। সেখানে আটক হওয়া এক জঙ্গির মাধ্যমে সাকিব মাস্টারের ঢাকার অবস্থান সম্পর্কে নতুন তথ্য পায়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ হোতাকে ধরতে পারলে অনেককে জালে আটকানো সম্ভব হবে। একই সঙ্গে জঙ্গি দমন ও প্রতিরোধ অনেকখানি সফল হবে।
এদিকে সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ের দুটি চাঞ্চল্যকর জঙ্গি হামলার ঘটনায় আটক চার জঙ্গিকে যে কোনো সময় প্রকাশ্যে আনা হতে পারে। এদের মধ্যে একজন আদালতে জবানবন্দি দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলায় সংঘটিত জঙ্গি হামলার সঙ্গেও এরা জড়িত। এদের হাতে ছিল টার্গেকৃত বিদেশী নাগরিক ও ভিন্ন ধর্মের লোকদের তালিকা।
গোয়েন্দারা আশা করছেন, জঙ্গি হামলার নেতৃত্বে থাকা সাকিব মাস্টারই এখন মোস্ট ওয়ান্টেড। তাকে ঢাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে পাওয়া যেতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের মতোই অন্য আরেকটি বাহিনী সাকিব মাস্টারের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার কথা। তারা আশা করছেন, যে কোনো সময় তাকে গ্রেফতারের খবর আসতে পারে। জানা গেছে, আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নতুন একটি নেটওয়ার্কের খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ওই নেটওয়ার্কে থাকা জঙ্গি সদস্যরা আরও হামলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
এ চক্রটি নতুন একটি অ্যাপস ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে। তাদের দ্রুত আটক করে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। এদিকে শোলাকিয়ায় নৃশংস হামলায় ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া জাহিদুল হক তানিমকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। স্থানীয় পুলিশ বলছে, তানিমের আচরণ, বক্তব্য অস্বাভাবিক ও রহস্যময়। তার দেয়া তথ্য খুবই রহস্যজনক।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তানিম ইংরেজি, আরবি, কোরিয়ান ও জাপানিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানে। তার পাসপোর্টে বেশ কয়েকটি দেশের ভিসাও লাগানো রয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, তানিমের ফেসবুকেও ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের উগ্রবাদীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকার তিতুমীর কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অনার্সে পড়ুয়া এ শিক্ষার্থীর রহস্যজনক আচরণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যদিও তানিমের ভাই মো. আকাইদ আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে দাবি করেন, সে (তানিম) ঢাকার বাইরে অন্য কোথাও যায়নি।
বন্ধুদের সঙ্গে একবার কক্সবাজার গিয়েছিল। তানিম ঢাকার পল্টনে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। ওই সময় সে জাপানিসহ দু-একটি বিদেশী ভাষা শেখে। বছরখানেক চাকরি করার পর মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে তার চাকরি চলে যায়। আকাইদ আরও দাবি করেন, তানিম ধার্মিক প্রকৃতির ছিল। নিয়মিত সে নামাজ পড়ত।
তানিমের কাছ থেকে বিভ্রান্তিকর তথ্য মিললেও এ মামলার অন্যতম আসামি শফিউল ইসলাম একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চলছে অভিযান। শফিউল গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় র্যাব হেফাজতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে।
আইনশৃংখলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শফিউলের কাছ থেকে জঙ্গি নেটওয়ার্ক, শোলাকিয়া ও গুলশান হামলার ছক এবং জড়িত অন্যান্য জঙ্গিদের সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শফিউলের তথ্য অনুযায়ী গুলশান ও শোলাকিয়া হামলা একসূত্রে গাঁথা। পঞ্চগড়ের পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর, কুড়িগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের তরুণ দত্ত, মহিমাগঞ্জের ব্যবসায়ী দেবেশ চন্দ্র হত্যাকাণ্ডেও জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে ভয়ংকর জঙ্গি শফিউল। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শোলাকিয়া হামলায় জড়িত অন্যান্য জঙ্গিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
এদিকে এ মামলায় তদন্তকাজে সহযোগিতা করতে বৃহস্পতিবার এডিশনাল জিআইজি মো. জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পুলিশের পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত দল শুক্রবার কিশোরগঞ্জ আসে। এ দলটি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছে। এ ঘটনায় রোববার বিকালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার হোসেন খান জানান, মামলার প্রধান আসামি শফিউলের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে তানিমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে এক যুবককে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল শেকলবন্দি যুবকের নাম ফয়সাল আহমেদ নাদিম। সে জাহিদুল হক তানিমের বড় ভাই।
এ অবস্থা দেখে নাদিমকে প্রশ্ন করা হলে সে জানায়, ‘না ভাই আমি পাগল-টাগল না। আমি সুস্থ মানুষ। নেশাটেশা না করলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। আর এজন্য আমাকে ২৪ রোজার দিন থেকে জিঞ্জির দিয়ে বেঁধে রেখেছে। এ সময় সে আরও বলেন, নেশাটেশা না করলেও আসলে পাগল হচ্ছে তানিম। এসময় সেখানে উপস্থিত তানিমের বাবা শহরের ব্যাটারি ব্যবসায়ী আবদুস ছাত্তার বলেন, ‘বইলেন না ভাই, সে (তানিম) ঢাকায় বোনের বাসায় থেকে তিতুমীর কলেজে ইংরেজিতে অনার্স পড়ছিল। তার মা নাছিমা আক্তারের মৃত্যুর পর থেকে সে পাগলের মতো হয়ে যায়। এ কারণে টাকা জমা দিয়েও সে চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দেয়নি।
একপর্যায়ে বেশি পাগলামি শুরু করায় কয়েক মাস তাকে বাড়িতে শেকলবন্দি করে রাখা হয়। তারপর বাড়ি থেকে মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসা-যাওয়া করত, আমিও লেখাপড়ার জন্য খুব চাপ দিতাম না। ঈদের আগের দিন রাতে সে বাড়ি আসে। শোলাকিয়ায় নামাজ পড়তে গিয়ে সেখানে হাঙ্গামার ঘটনার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।’ এ সময় আবদুস ছাত্তার দাবি করেন, ‘খোঁজ নিয়ে যতদূর জেনেছি, এ হামলার সময় তানিম দৌড়ে যে বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল পাঞ্জাবি পরা অস্ত্রধারী জঙ্গিরাও সেদিকে যায়।
এ পরিস্থিতিতে হয় তো নিজেকে জঙ্গিদের থেকে আলাদা রাখতে এক ফাঁকে গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফেলে দেয়। তারপরও বলি, যত ধরনের খোঁজখবর নেয়া দরকার পুলিশ নিক, আমার ছেলে কোনোভাবে এ ঘটনায় জড়িত থাকলে তারও কঠিন শাস্তি হোক। তবে আমার একটাই দাবি, বিনা দোষে যেন তার ছেলেকে এ ঘটনায় ফাঁসানো না হয়।’-যুগান্তর
১৬ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ