শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১৬, ০৬:১৭:২৪

‘তাপসের দুই মেয়ে স্কুলে যায় না, খাবার জোটে না’

‘তাপসের দুই মেয়ে স্কুলে যায় না, খাবার জোটে না’

তানভীর সোহেল ও গাজীউল হক: তাপস চন্দ্র দাস। বয়স ৪০ বছর। পেশায় রাজমিস্ত্রি। মা, স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকতেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মাধবপুর ইউনিয়নের উত্তর চান্দলা গ্রামে। মাসে ৫০০ টাকার যে ঘরটিতে এই পরিবারের বাস, তাতে বিদ্যুতের সংযোগ নেই। কেননা, বিল দেওয়ার ক্ষমতা তাপসের ছিল না। সাতজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। দরিদ্র এই পরিবারটি হঠাৎ করেই ‘ভিক্ষুক পরিবারে’ পরিণত হয়েছে। গত ৭ মে চতুর্থ দফা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের দিন মাধবপুর ইউনিয়নের উত্তর চান্দলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে দুই সাধারণ সদস্য (মেম্বার) পদপ্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় তাপস চন্দ্র দাসকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাপসের বড় মেয়ে নিপা রানী দাস স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। মেজ মেয়ে পার্বতী রানী দাস পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। তার পরের মেয়েটি অনন্যা রানী দাস প্রথম শ্রেণিতে। একমাত্র ছেলে শুভ চন্দ্র দাস এখনো স্কুলে যায় না।


গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করে তাপস যা পেতেন, তা দিয়ে পরিবারের খাওয়াটা কোনো রকমে চলে যেত। খুপরিঘরে গাদাগাদি হয়ে বাস করতেন তাঁরা। তাপসের বাবা কানু চন্দ্র দাসের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তির মেহার কালিবাড়ী এলাকায়। আর মাধবপুর এলাকাটি তাপসের মায়ের বাড়ির। বাড়ি বানানোর কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এই এলাকাতেই বসতি গড়েন তাপস। আশপাশের লোকজন এই পরিবারটিকে পছন্দ করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল তাপসের। মিছিল-সভায়ও যেতেন। স্থানীয় আদি শিবমন্দির কমিটির সদস্যও ছিলেন তাপস। ঘটনার দিন কেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় সদস্য পদপ্রার্থী মো. রেজাউল করীমকে সমর্থন করতেন তিনি। কিন্তু অপর প্রার্থী সুলতান আহমেদের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে রেজাউলের সমর্থকদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। রেজাউলের লোকেরা পালিয়ে গেলেও সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তাপস চন্দ্রকে সামনে পেয়ে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।


প্রসঙ্গত, রেজাউল ও সুলতান দুজনই আওয়ামী লীগের সমর্থক। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে তাপসের মা জোসনা রানীর সঙ্গে বাড়ির উঠানে কথা হচ্ছিল। ২৬ বছর আগে তাঁর বড় ছেলে চট্টগ্রাম থেকে নিখোঁজ হন। এবার হারালেন ছোট ছেলেকেও। আর কোনো ছেলে নেই তাঁর। কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, ‘তাপসের মেয়েরা আর স্কুলে যাচ্ছে না। খাবারই জোটে না, স্কুলে কীভাবে যাবে? এখন আশপাশের মানুষ কিছু দিচ্ছে। বাড়িওয়ালা গত মাসের ভাড়া নেয়নি। আওয়ামী লীগের এমপি আবদুল মতিন খসরু পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তা দিয়েই চলছে।’ জোসনা রানী বললেন, ছেলে মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকে এসেছেন। এখন আর কেউ আসেন না। খোঁজও রাখেন না।


শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘এহনও সাহায্যের ওপরে আছি। ইডাও তো ভিক্ষাই। হ্যারপর রাস্তায় ভিক্ষা করণ শুরু করব।’ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বাপ, ২০ বছর ধরি এহানে আছি। মানুষ ভালো পায়। ভিক্ষা দিব? কী কও, দিব না?’ তাপসের স্ত্রী মল্লিকা রানী দাসের চোখে-মুখে অনিশ্চয়তা। তিন মেয়ে এক ছেলেকে নিয়ে এখন অথই সাগরে। বললেন, ‘মুখে কিছু ফুটে না। বুক তো ফাটি যায়। ছাওয়াল মাইয়ারা বাপের নেওটা ছিল। বাপের মরার খবরে বড় মাইয়া জ্ঞান হারায় ফেলে। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তার ওষুধ লাগে। কোনো আয় নাই। মানুষের দয়ায় চলতাছি।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মল্লিকা রানী বলেন, ‘কোনো কাজকামও জানি না। কখনো হেয় (তাপস) কাজ করতেও দিত না। নিজেই চালাইত। গেরামে কাজও তো পাওয়া যায় না। এ টেনশন নিয়া কেমনে বাচুম। নির্বাচন আমাগো পথে বসাইছে।’ যাঁর নির্বাচনে কাজ করতে গিয়ে তাপস মারা গেলেন, তাঁর বাবা আবদুর রউফ গতকাল বলেন, ‘এখনো তাঁরা যতটা পারছেন সাহায্য-সহযোগিতা করছেন। পরিবারটি কোনো রকমে খেয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এভাবে কত দিন? ছয়জনের এই পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো সারা জীবন কারও পক্ষে কি সম্ভব?’


মামলার খবর রাখে না পরিবারটি: তাপস খুন হওয়ার পর স্ত্রী বাদী হয়ে ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তবে মামলার খবর রাখেন না স্ত্রী। স্বামী হত্যার বিচার চান। কিন্তু কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন, তা বুঝতে পারেন না। আসামি কারা ধরা পড়েছে তা-ও বলতে পারেন না। কেবল মামলার প্রধান আসামি সুলতান প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান, এটা শুনে খারাপ লাগে তাঁর। মামলার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ১৮ জনের মধ্যে ১২ জন আসামি এখন কারাগারে। সুলতান আগাম জামিন পেয়েছেন, এ জন্য পুলিশ তাঁকে ধরছে না। আর পাঁচজনকে মাঝে মাঝে দেখা যায়। ব্রাহ্মণপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম বদিউজ্জামান বললেন, তদন্ত ভালোভাবেই চলছে। অভিযোগপত্র দিতে বেশি দিন লাগবে না। অনেক আসামি ধরা পড়েছে। অন্যদেরও ধরার চেষ্টা চলছে।-প্রথম আলো

২৪ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে