আব্দুর রাজ্জাক ঘিওর, মানিকগঞ্জ: শামীম আহমেদ। পেশায় ব্যাংকার। কিন্তু তার কাজই তাকে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা করেছে। অনন্যসাধারণ হয়ে উঠেছেন তিনি। অসহায় ছিন্নমূল মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন তিনি। ফিরিয়ে দেন তাদের পরিবারের কাছে
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পখুুরিয়া বাসস্ট্যান্ড। যাত্রীছাউনিতে প্রায় দুই বছর ধরে অবস্থান করছেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণী। খাবার না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগা ওই তরুণীর শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। কেউ জানতে চাইলে খুব অস্পষ্ট স্বরে নিজের নাম বলতেন- পারুলী। গ্রামের বাড়ি যশোর। এর বেশি কিছু তিনি মনে করতে পারেন না। পরিবার-পরিজনের কোনো হদিস তিনি দিতে পারেন না। কেউ কিছু দিলে খান, না হলে উপোষ দিনই কাটে। তাকে যিনি দেখেন তিনিই আফসোস করেন।
কিন্তু আসল কাজটি করলেন শামীম আহমেদ নামে এক মহৎ ব্যক্তি। পারুলের দিকে মমতার হাত বাড়ালেন তিনি। তাকে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবন ও স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিলেন যমুনা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার শামীম আহমেদ। গত ২৭ আগস্ট সকালে ঘিওরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে নতুন শাড়ি নিয়ে যাত্রীছাউনিতে থাকা পারুলের কাছে যান শামীম ও তার বন্ধু আলী সাব্বিরসহ কয়েকজন। গায়ে নতুন শাড়ি জড়িয়ে উচ্ছল হয়ে ওঠেন পারুল। সেখান থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আগেই যোগাযোগ করে রেখেছিলেন শামীম। তাই সেদিনই জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে দ্রুত ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হয়। পারুলীর ঠিকানা এখন এখানেই। শামীমের এ মহৎকাজের সঙ্গী হয়েছেন তার সহকর্মী আলী সাব্বির, ফেসবুক বন্ধু ডা: শামীম হোসেন, পুলিশের এএসআই সাজিদুর রহমান, আবদুল মালেকসহ কয়েকজন।
কেবল পারুলীই নন, শামীম আহমেদের মানবিকতায় এর আগেও মানসিক ভারসাম্যহীন আরো দুই নারীকে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করিয়েছিলেন শামীম। এখন তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। ফিরেছেন স্বজনদের কাছে। তাদের একজন নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলার লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের রিকশাচালক আলাউদ্দিনের মেয়ে জবা। অপরজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার দাওরিয়া গ্রামের সতীর্থ সরকারের মেয়ে শিউলি রানী সরকার। জবাকে ঢাকা থেকে আর শিউলি রানীকে বান্দরবানের থানচি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল।
ঢাকায় একটি ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন জবা ও শিউলি রানীকে সুস্থ করে তাদের পরিজনের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাহিনী। গত বছর তিনি অফিসে যাওয়ার পথে পল্টন মোড়ে মানসিক প্রতিবন্ধী তরুণী জবাকে দেখতে পান ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো অবস্থায়। প্রথম দিন তিনি জবাকে খাবার কিনে দেন। অফিসে গিয়ে সহকর্মী আলী সাব্বিরের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন, জবাকে চিকিৎসা করাবেন। যোগাযোগ করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের সাথে। তারাও ইতিবাচক সাড়া দেন। শেষে পল্টন পুলিশের সহায়তায় গত বছরের জুলাই মাসে জবাকে সেখানে ভর্তি করেন। তখনো জবার পরিচয় জানা ছিল না। শামীম আহমেদের দেয়া আদুরী নামেই তাকে ভর্তি করে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। কয়েক দিনের চিকিৎসায় অনেকটা স্বাভাবিকতা আসে জবার মধ্যে। তার কিছু কিছু কথার সূত্র ধরে ফেসবুক ও পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় জবার বাবাকে।
বান্দরবানের থানচিতে বেড়াতে গিয়ে শামীম আহমেদ একটি গাছের নিচে মানসিক প্রতিবন্ধী তরুণী শিউলিকে দেখতে পেয়েছিলেন বিপর্যস্ত অবস্থায়। শিউলিকে তিনি অন্তরা নামে ভর্তি করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে। একইভাবে বান্দরবানেও পোস্টারিং করেন। পরে খুঁজে পাওয়া যায় শিউলির আত্মীয়স্বজন।
শামীম পারুলীর খবর পান এক পরিচিতজনের মাধ্যমে। খবর পেয়েই পারুলীকে দেখতে গত সপ্তাহে তিনি বন্ধু সাব্বিরকে নিয়ে ছুটে আসেন ঘিওর উপজেলার পখুুরিয়া বাসস্ট্যান্ডে। সিদ্ধান্ত নেন পারুলীকেও চিকিৎসা করাবেন। ঘিওর থানার অনুমতি নিয়ে পারুলীকে উদ্ধার করে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করান। মানিকগঞ্জের পশ্চিম সাহিলী একতা সমাজকল্যাণ সংস্থা নামের একটি প্রতিষ্ঠান অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
পারুলীর ডেরায় (যাত্রীছাউনি) শামীম আহমেদ ও তার বন্ধুরা পৌঁছার পর এক নয়ন জুড়ানো দৃশ্যের অবতারণা হয়। শামীম পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন পারুলীকে। উপহার দেন একটি নতুন শাড়ি। পারুলীও বায়না ধরে ব্লাউজ, পাউডার আর সুগন্ধির। ব্লাউজের বায়না পূরণ করতে না পারলেও সাথে সাথে কিনে আনা হয় পাউডার আর সুগন্ধি। উপহার পেয়ে পারুলীর করুণ মুখ ভরে ওঠে আনন্দের হাসিত।
পারুলীকে নিয়ে ঢাকায় আসার আগে স্থানীয় সাংবাদিকদের মানসিক ভারসাম্যহীন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর এই নেশায় বিভোর শামীম আহমেদ বলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি মাত্র।’ তিনি মনে করেন, যার যার অবস্থান থেকে প্রত্যেক মানুষকেই হতে হবে মানবিক। তাহলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। জানা যায়, নিজের বেতনের টাকার কিছু অংশ বাঁচিয়ে এই কাজ করছেন শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, সমাজ যাদের অবহেলা ও অবজ্ঞা করছে, তাদের মুখে হাসি ফোটানো যে কী আনন্দ, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। তিনি আশা করেন, তাকে দেখে সমাজের অন্যরাও যেন মানসিক ভারসাম্যহীনদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। তাদের পাশে দাঁড়ান। শামীম আহমেদের স্বপ্ন ভবিষ্যতে একটি মানসিক হাসপাতাল গড়ে তোলার, যেখানে নাম-পরিচয়হীন মানসিক রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসহ পুনর্বাসন করা হবে।-নয়া দিগন্ত
০৮ অক্টোবর,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/এইচএস/কেএস