রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে : কবির ভাষায়- ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো মানিক ও রতন।’ ঠিক সেই মানিক-রতনের খোঁজ মিলেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম ও গোবিন্দল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায়। দুই ইউনিয়নে প্রায় ৫ হাজার পরিবার সেখানে ছাই থেকে সোনা বের করে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। তাও আবার যেনতেন সোনা নয় একদম খাঁটি সোনা। তবে বর্তমানে এই পেশার মানুষগুলো তেমন ভালো নেই।
কারণ পথেঘাটে তাদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অথচ শত বছরের ঐতিহ্য এখানকার এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের সিংগাইর উপজেলার দুটি ইউনিয়ন চারিগ্রাম ও গোবিন্দল। যেখানে এলাকার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করা। পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরাও নিখুঁত হাতে ছাই থেকে সোনা উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
তাদের উৎপাদিত সোনার কদর দীর্ঘদিন ধরেই জেলা ও জেলার বাইরে বিদ্যমান রয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় জুয়েলারি মার্কেটের ব্যবসায়ীরাও সেখান থেকে পাইকারি দরে সোনা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই। তবে সেখানকার সোনা তৈরির কারিগরদের কিছু ক্ষোভ রয়েছে পুলিশের প্রতি। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকার অলংকার তৈরির কারখানার পরিত্যক্ত ছাই সংগ্রহ করে সিংগাইর আনার পথে পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। এছাড়া, ছাই থেকে সোনা বের করার মূল উপকরণ নাইট্রিক এসিড ব্যবহার ও ক্রয় করার ক্ষেত্রেও তাদের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
সরজমিন সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম এলাকার হাজী অমর পোদ্দারের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৫-২০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক ব্যস্ত সময় পার করছে ছাই থেকে সোনা উৎপাদনের কাজে। কেউ মাটির চুলোয় সিসা জাল করছেন, কেউ পিণ্ডা তৈরি করে রোদে শুকাচ্ছেন। এরকম আরো বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ছাই থেকে সোনা বের করার কাজ করছেন তারা। কথা হয় প্রায় ৬৫ বছরের শ্রমিক ধনী মিয়ার সঙ্গে। তিনি হাজী অমরের বাড়িতে প্রায় ২০ বছর ধরে সোনা উৎপাদন করার কাজ করে আসছেন। জানালেন, ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করা খুবই কঠিন।
হাজী অমর জানালেন, ঢাকার তাঁতীবাজার, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অলংকার তৈরির কারখানা থেকে প্রায় প্রতি ৬ মাস পর পর বিপুল পরিমাণ পরিত্যক্ত ছাই কিনে আনার পর প্রচুর পরিশ্রম করে সোনা উৎপাদন করা হয়। আমাদের হাতে তৈরি এই সোনা মাসে দুইবার নিজ এলাকার জুয়েলারি মার্কেটে বাজার দামের কিছুটা কমে বিক্রি করে থাকি। ছাই থেকে এক ভরি স্বর্ণ বের করতে ২০ হাজার টাকার ওপরে খরচ পড়ে। তবে আমরা যে সোনা উৎপাদন করে থাকি তা একদম খাঁটি। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে এই ব্যবসায় আগের মতো শান্তি নেই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য হালিম মেম্বারের বাড়িতেও চার পুরুষ ধরে চলছে সোনা উৎপাদন করার কাজ। হালিম মেম্বার জানালেন কিভাবে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করা হয়। ৬ মাস কিংবা এক বছর পর পর আমরা দেশের বিভিন্ন জুয়েলারি কারখানা থেকে ছাই সংগ্রহ করে থাকি। এই ছাইকে প্রথমে পুড়িয়ে ধুলায় রূপান্তরিত করা হয়। ওই মিহিন ধুলার সঙ্গে সোহাগা, ব্যাটারির সিসা ও পুইন দিয়ে ছোট ছোট পিণ্ডি বানানো হয়। তারপর রোদে শুকানো এই পিণ্ডি আগুনে গলিয়ে পিচ করা হয়। সেই পিচ ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে গুঁড়া করে মাটির গর্তে চুন ও ধানের তুষ মিশিয়ে পুনরায় আগুনে পুড়িয়ে সিসা বের করা হয়। ওই সিসা পানিতে ধুয়ে ছাকনিতে ছেঁকে আলাদা করা হয়। এরপর একটি পাত্রে নাইট্রিক এসিড মিশিয়ে সিসা থেকে বের করা হয় মূল্যবান সোনা ও রুপা।
হালিম মেম্বার বলেন, আমার চার পুরুষের এই পেশাকে আমি এবং আমার বাবা এখনো ধরে রেখেছি। কিন্তু পেশাটিকে টিকিয়ে রাখাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাই কিনে আনার সময় পথেঘাটে পুলিশ আমাদের নানা ধরনের হয়রানি করে থাকে। সবখানেই হাজার হাজার টাকা দিতে হয়। বাড়িতে এনে কষ্ট করে ছাই থেকে যে সোনা উৎপাদন করি ঠিকই কিন্তু তার লভ্যাংশ আগেই পিপড়ায় খেয়ে ফেলে। তাই বর্তমানে বাপ-দাদার এই পেশাটা ধরে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া, আমরা দেড়শ’ বছরের এই শিল্পকে ধরে রাখলেও সরকারিভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয় না।
দাশিরহাটি গ্রামের শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করেই সংসার চালাচ্ছি। প্রতি মাসে প্রায় ৫ ভরি স্বর্ণ বাজারে বিক্রি করে থাকি। ময়লা আবর্জনাযুক্ত ছাই থেকে সোনা বের করতে কি যে কষ্ট তা কেউ না দেখলে বুঝতেই পারবে না। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো লাভ হয়।
বাদল ব্যাপারী জানালেন, লাভের অংশ রাস্তাঘাটেই দিয়ে আসতে হয়। তাই দিন দিন আগ্রহটা হারিয়ে যাচ্ছে। তারপরও পূর্ব পুরুষের এই পেশা আমরা ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারি না। আসলে এই পেশা আমাদের গ্রামের ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা কোন সহযোগিতা পাই না।
চারিগ্রামের হারেজ ব্যাপারী জানান, আমাদের এলাকার প্রায় প্রতি পরিবারই এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। প্রায় ৪ হাজার পরিবার এই কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করার ক্ষেত্রে আমাদের নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়। একেক সময় মনে হয় পেশাটি ছেড়ে দেই। কিন্তু বাপ-দাদার আত্মা কষ্ট পাবে বলে পারি না।
এলাকার বদু ব্যাপারী জানান, প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে বংশানুক্রমে আমাদের গ্রামে চলে আসছে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার জুয়েলারি দোকান থেকে পরিত্যক্ত ছাই মাটি কিনে আনি। দোকানের আকার ও কর্মচারী ভেদে এই মাটি আমরা বিভিন্ন দামে ৬ মাস পর পর টাকা দিয়ে কিনে থাকি। বেশি ছাই মাটি হলে তা থেকে প্রতিমাসে ১০ ভরি পর্যন্ত সোনা তৈরি করা যায়।ৎ
গোবিন্দল গ্রামের সোনার কারিগর শাজাহান জানান, কেমিক্যালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন লাভ খুব একটা হয় না। সোহাগা, ব্যাটারির ছাই এর দাম অনেকাংশে বেড়ে গেছে । এছাড়া সব চেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয় নাইট্রিক এসিড ক্রয় করতে গিয়ে।
চারিগ্রাম মালিপাড়া গ্রামের গফফর জানালেন, এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়ে হার্ডওয়্যারের দোকান করি। কারণ ব্যবসায় সুখ নেই।
এদিকে ছাই থেকে সোনা উৎপাদনকে কেন্দ্র করে চারিগ্রামে গড়ে উঠেছে একটি জুয়েলারী মার্কেট। অর্ধশত দোকান রয়েছে সেই মার্কেটে। বেশ জমজমাট স্বর্ণ বেচা কেনা হয় সেখানে। তবে ক্রেতাদের কাছে এই মার্কেটের মূল আর্কষণ হচ্ছে ছাই থেকে তৈরি হওয়া যে সোনা এখানে বিক্রি হয় সেটার ওপর। ঢাকার বড় বড় জুয়েলারি ব্যবসায়ী ও মহাজনরা এই মার্কেট থেকে প্রতিনিয়তই স্বর্ণ কেনা-বেচার সাথে জড়িত রয়েছে। এছাড়া জেলা ও জেলার বাইরে থেকে প্রচুর সংখ্যক ক্রেতা সেখান থেকে প্রতিনিয়তই স্বর্ন ও স্বর্নের অলংকার কিনে নিয়ে যায়। বিশেষ করে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার ও সোমবার এই মার্কেটে সবচেয়ে বেশি সোনা বেচা কেনা হয় বলে জানান জুয়েলারী ব্যবসায়ীরা।
মার্কেটের সভাপতি ও স্বর্ণ কেনা বেচার মহাজন ওহাব আলী পোদ্দার বলেন, গ্রামে ছাই থেকে যে সোনা তৈরি হয় তার কদর বেশি। শুধু মাত্র এই স্বর্ণই প্রতিমাসে ২শ’ ভরির ওপরে কেনা বেচা হয় এখানে। অথচ এক সময় এখানে স্বর্ণ বেচা কেনার কোনো মার্কেট ছিল না। সে সময় বাজারে মাদুর বিছিয়েও ছাই থেকে উৎপাদন করা সোনা বিক্রি হতো। ছাই থেকে সোনা উৎপাদনের কারণেই এই আজো পাড়া গায়ে একটি স্বর্ণ বেচা কেনার মার্কেট হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ওহাব আলী পোদ্দার বলেন,এই শিল্প আমাদের এলাকার শতবছরের ঐতিহ্য। কিন্ত এলাকার কিছু প্রশাসনের দালাল থাকায় প্রতিনিয়ত সোনা উৎপাদন কারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। যা এই শিল্পের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামে যারা ছাই থেকে সোনা বের করার কাজ করে থাকেন আমরা মহাজনের তাদের অগ্রিম বায়না করার জন্য টাকা দিয়ে থাকি। ঠিক আমারা যারা স্থানীয় মহাজন তারা ঢাকার বড় বড় মহাজনদের কাছ থেকে অগ্রিম বায়না এনে তাদের কাছে সোনা বিক্রি করে থাকি।
চারিগ্রাম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সাজেদুল আলম স্বাধীন জানান, বৃটিশ আমল থেকে এই এলাকায় ছাই থেকে সোনা বানানোর কাজটি করা হচ্ছে। স্বর্ণের দোকানের পরিত্যক্ত ছাই থেকে খুব পরিশ্রম করে কারিগররা সোনা বের করছে। এরা দেশের অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার সাপোর্ট দিলেও নানা কারণে তারা খুব একটা ভালো নেই। কয়েক হাজার পরিবার এই পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এমজমিন
২৭ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি