মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০১৬, ০১:৪৩:২৭

‘ক্ষতিপূরণের আশায় ঘুরতে ঘুরতে একবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি’

 ‘ক্ষতিপূরণের আশায় ঘুরতে ঘুরতে একবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি’

রোকনুজ্জামান পিয়াস: কত জায়গায় গেলাম, কত কান্নাকাটি করলাম, মানবাধিকার সংগঠনের দ্বারে দ্বারে ঘুরলাম, কোনো কাজ হলো না। টাকা ফেরত পেতে দুই দুইবার করে রায়ও দিলো, কিন্তু টাকা পেলাম না। প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশ গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছিলাম, আর ফেরত আসার পর ক্ষতিপূরণের আশায় ঘুরতে ঘুরতে একবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছি। কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে তাহাজ উদ্দিনের। তিনি ২০০৯ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। দেশটিতে গিয়েই জানতে পারেন তিনি রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণার শিকার। তাকে চুক্তি মোতাবেক কাজ, বেতন-ভাতাদি কিছুই দেয়া হয়নি। নানা হয়রানির শিকার হয়ে অবশেষে তিনি দেশে ফেরত আসেন।

ফেরত এসেই ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি সত্যতা পেয়ে ২০০৯ সালের ২৭শে  সেপ্টেম্বর ক্ষতিপূরণের ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ১৫ দিনের মধ্যে ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিলেও অজ্ঞাত কারণে সেই টাকা আজও পাননি তিনি। গত ৫ বছর ধরে ওই টাকা পেতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঘুরছেন তাহাজ। বলেন, রায় হওয়ার পরও কেন ক্ষতিপূরণ পাইলাম না, তা বুঝতে পারলাম না। আদৌ ওই টাকা পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে সহায়-সম্বলহীন এ মানুষটির। শুধু তাহাজ-ই নয়, ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে পেতে বছরের পর বছর ঘুরছেন তার মতো অনেকেই। সহায়-সম্বলহীন এ মানুষগুলো ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার আশায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, বিভিন্ন এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এখন ক্লান্ত। রায় হওয়ার পরও কেন তারা ওই টাকা পাচ্ছেন না তার কারণ তাদের অজানা।


২০০৯ সালের ২৭শে নভেম্বর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-৩ এর এক পত্রে দেখা যায়, তাহাজকে মালয়েশিয়া প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আল আব্বাস ইন্টারন্যাশনালকে টাকা পরিশোধের জন্য ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মানিকগঞ্জের বাসিন্দা তাহাজকে মালয়েশিয়া প্রেরণ করা হয়। কিন্তু চুক্তি মোতাবেক কাজ, বেতন ও ভাতাদি না পাওয়ায় তিনি দেশে ফেরত আসেন। ব্যুরোর (বিএমইটি) তদন্তে অভিযোগটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অবস্থায় অভিযোগকারীর ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হইলো। ব্যর্থতায় বহির্গমন অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী জামানত বাজেয়াপ্তসহ লাইসেন্সের কার্যক্রম স্থগিত/বাতিল করা হবে। উল্লেখ্য, এই রায়ের আগেও ক্ষতিপূরণ দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু ওই ক্ষতিপূরণের টাকা আজও পাননি তিনি।


এদিকে ২০০৮ সালের ১৭ই জুন মেসার্স আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এজেন্সির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর গিয়ে প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরেন ৫ যুবক- মো. বেল্লাল হোসেন, মো. কামরুল ইসলাম, মো. এনামুল, মোমিন ও মো. সুরুজ। তারা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)তে গিয়ে ২০১১ সালের ১৫ই মে অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিএমইটি’র ২ জন কর্মকর্তার তদন্তের শুনানিতে বিভিন্ন সময় মোট ৭টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তদন্তে ও শুনানিতে অভিযোগটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রেক্ষিতে আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনালকে ভুক্তভোগী ৫ ব্যক্তির প্রতিজনকে ২০১১ সালের ২১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ৮৪ হাজার করে মোট ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়। ব্যর্থতায় এজেন্সিটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়।

কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কোন টাকা পরিশোধ না করায় ২০১২ সালের ৫ই জানুয়ারি ওই ৫ যুবক আবারও বিএমইটিকে লিখিতভাবে জানান। দ্বিতীয়বার বিএমইটি চিঠি দিয়ে ২০১২ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারির মধ্যে রিক্রুটিং মেসার্স আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনালকে জনপ্রতি ৮৪ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে বলে। এরপরও ওই টাকা পরিশোধ না করলে মন্ত্রণালয় আবারও ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করতে তাগিদ দেয়। একইসঙ্গে এজেন্সির টাকা পরিশোধ করা না হলে কেন এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হবে না- এই মর্মে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। এরপরও কোন কর্ণপাত না করায় ওই বছরের ১৬ই জুলাই এজেন্সিকে চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়।

এতে মেসার্স আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনালকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে টাকা পরিশোধ করার জন্য বলা হয়। অন্যথায় লাইসেন্স বাতিল এবং জামানত বাজেয়াপ্তসহ বাজেয়াপ্তকৃত টাকা হতে পরিশোধ করা হবে বলে এজেন্সিকে জানানো হয়। কিন্তু এই চূড়ান্ত নোটিশের পর আবারও অভিযোগের ব্যাপারে ২৮শে আগস্ট শুনানির জন্য ভুক্তভোগীদের নোটিশ দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২৭শে নভেম্বর আরো একটি নোটিশের মাধ্যমে একই সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। তবে বারবার সিদ্ধান্ত হলেও কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। ফলে ২০১২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর লাইসেন্স বাতিল করা হয়। এ সংক্রান্ত অফিস আদেশে বলা হয়, অভিযোগের বিষয়ে কারণ দর্শানো এবং টাকা প্রদানের পত্র দেয়া দেয়া হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি বাদীগণের প্রাপ্য টাকা পরিশোধ করেনি। এ অবস্থায় আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স বাতিল এবং জামানত বাজেয়াপ্ত করা হলো।

কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের পরও আজ পর্যন্ত কেউ-ই কোন টাকা পাননি। বিএমইটিতে যোগাযোগ করলে ভুক্তভোগীদের বলা হয়েছে, আল ওয়াসী ইন্টারন্যাশনাল হাইকোর্টে রিট করেছে। এ ব্যাপারে কোর্টের নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ওই এজেন্সির জামানত বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হবে না। এই ঘটনার ৪২ মাস পার হলেও তার নিষ্পত্তি হয়নি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর আন্তরিক না। আন্তরিক হলে এতোদিনে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে তারা ক্ষতিপূরণ পেতেন।-এমজমিন

১২জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে